Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঊনিশশো সাতচল্লিশ থেকে ষাইট


২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৩৪

আমার আব্বা ফজলুর রহমান ১৯৩০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাশ করে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিরেক্টর সব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন অফিসে চাকরিতে যোগ দেন। দেশ বিভাগের কার্যক্রম আরম্ভের সময় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে কে কোন দেশে যেতে ইচ্ছুক এমন একটা প্রশ্নের জবাবে অন্য অনেক মুসলমান সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মতো আব্বাও পাকিস্তানে চলে যেতে মত প্রকাশ করেন।
১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে কলকাতা থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজনীয় ও বিপুল পরিমান অপ্রয়োজনীয় নথিপত্র, ব্যবহারযোগ্য আসবাবপত্র ও বিপুল পরিমান অযোগ্য আসবাবপত্র প্রভৃতি মালামাল বোঝাই কয়েকটি জাহাজের বিশাল বহর পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে নদীপথে রওনা দেয়। এ বহরটি ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ ঘুরে সুন্দরবনের ধার ঘেঁষে পটুয়াখালী, বরিশাল, ভোলা ও নারায়ণগঞ্জ পার হয়ে ঢাকার সদরঘাটে উপস্থিত হয় আগস্টের শেষ সপ্তাহে। এই বহরের আর একটি অংশ চট্টগ্রামে গিয়ে নোঙ্গর করে।
ঢাকায় এসে আব্বা ডিরেক্টর সব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন অফিসে চাকরিতে যোগ দেন। এ সময়ে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন অব বেঙ্গলী ল্যাঙ্গুয়েজে প্রকল্পের কাজ নিয়ে তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। পরে আব্বার কাছে শুনেছি এই স্টাণ্ডার্ডাইজেশনের নাম করে কিভাবে এক শ্রেণীর বিজ্ঞজন বাংলা ভাষা নিয়ে খেলায় মেতেছিলেন। তার কাছে শুনেছি এর মধ্যে এক দল উর্দু বর্ণ দিয়ে বাংলা লেখার পক্ষে জোর প্রচারণা চালাতে থাকে। আর একটা প্রস্তাব ছিল আমরা মুখে বলার সময় যেভাবে বানান করি, লেখার সময় সেভাবেই লেখার পদ্ধতি চালু করা অর্থাৎ ডিরেক্টর শব্দটি লিখতে হবে ডরিক্টের (ড+হ্রস্বই+র++ক+ট+র)। এই সব প্রস্তাব ও উদাহরণের মুদ্রিত কপি বহুকাল আমাদের বসায় ছিল, পরে বহুবার শহর বদল, বাসা বদলের দাপটে এই সব উল্লেখযোগ্য তথ্য কিভাবে যেন হারিয়ে গিয়েছে।
আমার যখন সাড়ে চার বছর তখন আমার সাড়ে তিন বৎসরের বড় বড়ভাইকে আব্বা ওয়েস্ট এন্ড স্কুলে ভর্তি করতে নিয়ে যান। ঐ দিন আমিও জেদ ধরলাম আমিও স্কুলে পড়বো। কোনও নিষেধেও আমাকে টলাতে না পেরে এবং সম্ভবত আমার মার প্রচ্ছন্ন সমর্থনে আব্বা বাধ্য হলেন আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতে। বড় ভাইয়ের ক্লাস থ্রির ভর্তি প্রক্রিয়া সহজই ছিল। কিন্তু হেড মাষ্টার আমাকে কিছুতেই ভর্তি করতে রাজি হলেন না। আমি এমন কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিলাম যে শেষে ঠিক হল আমার ভর্তির জন্য আমাকে বুদ্ধিবৃত্তির পরীক্ষা দিতে হবে। দুইজন শিক্ষক অনেকক্ষণ ধরে বিভিন্ন প্রশ্ন করেও আমাকে বিপদে ফেলতে পারলেন না। আমি তাদের সব কটি প্রশ্নের উত্তরই দিতে পেরেছিলাম। তখন প্রধান শিক্ষক বাধ্য হয়ে আমাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করতে সম্মত হলেন। আমিও মহা উৎসাহে আমার স্কুল জীবন আরম্ভ করে দিলাম।
স্কুলে যাওয়া-আসার অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলা ভাষা নিয়ে উত্তেজনা বিরাট আকার ধারণ করল। প্রায় প্রতি দিনই স্কুলে গেলে উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা আমাদের বোঝাতো বিদেশি শত্রুরা আমাদের মুখের কথা কেড়ে নিতে চায়। ওরা আমাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলতে দেবে না। ওদেরকে আমাদের তাড়াতে হবে। ঐসব ছেলেদের কাছ থেকেই প্রথম শিখলাম সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই। নূরুল আমিনের কল্লা চাই।’ আমার কয়েকজন সহপাঠী আর প্রতিবেশীদের ছেলেদের নিয়ে আমি মহা উৎসাহে পাড়ার রাস্তায় চিৎকার করে বলতে থাকতাম, ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই…’
এরই মধ্যে একদিন আমরা কয়েকজন চিৎকার করতে করতে বড় রাস্তার মোড় পর্যস্ত চলে গিয়েছি। হঠাৎ সামনে দেখি পুলিশের গাড়ি। গাড়িটা দ্রুত বেগে আমাদের সামনে এসে থেমে যেতে কয়েকজন সিপাহী লাফিয়ে নেমে আমাদেরকে ধরে ফেলল। আমি তখনও এর পরিণতির কথা কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
পুলিশরা আমাদের নিয়ে কি করত জানি না। আমাদের বয়স দেখে কোনও নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা হয়তো তাদের মনে আসেনি। এমন সময় জানি না কিভাবে আব্বা ওখানে এসে হাজির হলেন। আমাকে দলের মধ্যে দেখে এগিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ছোট, তুই কি করছিস এখানে?
আমি কোনও উত্তর দেওয়ার আগে অফিসার আব্বার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ আপনার ছেলে?
আব্বা তখন তার পরিচয়পত্র দেখিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। অফিসার একটু হেসে বললেন, আপনার ছেলে মহা বিপ্লবী হয়ে উঠেছে। সামলান ওকে, না হলে এ বয়সেও ওর বিপদে পড়তে দেরী হবে না।
আব্বা ঐ সময় অকুস্থলে উপস্থিত হওয়াতেই সম্ভবত আমরা রক্ষা পেলাম।
আমলিগোলা থেকে আজিমপুর হয়ে চানখাঁর পুল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, গুলিস্তান এবং ঠাঁঠারি বাজার, ওয়ারী হয়ে টিকাটুলীর প্রায় শেষ মাথায় হাটখোলাতে আমার ছোট খালার বাড়ি। বাড়ির সামনে দিয়ে ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে নারায়ণগঞ্জের দিকে রাস্তা চলে গিয়েছে। একপাশে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরী। বাড়ির ডান দিকে একটুখানি গেলে বলধা গার্ডেন।
চারপাশে বাগানের মধ্যে একতলা বিরাট বড় বাড়ি। অনেকগুলো ঘর আর বিশাল ছাদ। আমার অনেকটা টান ছিল বাড়ির পাশের ছাপাখানটার দিকে। ঝম ঝম শব্দ করে ট্রেডল আর ফ্ল্যাট মেশিনগুলো চলত আর বড় বড় কাগজের শিটে লেখা আর ছবি ছাপা হয়ে যেত চোখের পলকে। প্রেসটার নাম ছিল, প্যারামাউন্ট প্রেস।
এই প্রেস থেকে পঞ্চাশের দশকে সরকারের পাকিস্তান খবর আর মাহে নও পত্রিকা। ইত্তেফাক পত্রিকাটা প্রথমে সাপ্তাহিক হিসেবে ও পরে দৈনিক হিসাবে ছাপা হতো। আমার সবচেয়ে ভাল লাগত প্রেসের কাটিং মেশিনের পাশে জমে থাকা কুঁচি কুঁচি টুকরো কাগজের বিশাল স্তুপটাকে। লুকোচুরী খেলার জন্য ঐ কাগজের টুকরোর স্তুপের মধ্যে ডুবে গেলে সহজে কেউ খুঁজে পেত না।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ও ভিসা চালু হওয়ার পর কলকাতায় প্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য কলকাতায় যে অফিস চালু করা হলে তাতে কিছু লোক নিয়োগের প্রক্রিয়া আরম্ভ হওয়ায় আব্বা সেখানে দরখাস্ত করেন ও তিনি নির্বাচিত হয়ে কলকাতার ঐ ডেপুটি হাই কমিশন অফিসে যোগদান করেন। আমরা ঢাকার আমলিগোলাতে থাকি। আব্বা কলকাতাতে চলে যাওয়ার পর আমরা এখানেই থেকে গেলাম। আব্বার ইচ্ছা ছিল পররাষ্ট্র দপ্তরের অধীনে বিদেশে বেশি মাইনের চাকরি করে দেশে আমাদের রেখে গেলে তিনি কিছু বেশী অর্থ সঞ্চয় করতে পারবেন।
আব্বা কলকাতায় যাবার পর পরই মা বুঝতে পারলেন, আমরা যদি ঢাকার ঐ আবহাওয়ায় থাকি, তবে আমাদের উচ্চ শিক্ষা হবে না। বড়ভাই তখন বড় হয়ে উঠছে, পাড়ার ছেলেদের সাথে মিশে ও বখে যাবে। মা তাকে (এবং আমাকে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। তাছাড়া ঢাকার আমলিগোলার পঞ্চাশের দশকের পরিবেশে বড় আপার পড়াশুনা চালানো মোটেই সম্ভব হবে না। বরং পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেদের দাপটে হয়তো দুই-এক বছরের মধ্যে মেয়েকে বিয়েও দিয়ে দিতে হবে। তিনি দেখলেন ঢাকায় আমাদের যে সব আত্মীয়স্বজন ছিল, তাদের কাছ থেকেও মা আমাদের উচ্চশিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কোনও সহায়তা পাবেন না। বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে মা সিদ্ধাস্ত নিলেন যে আমাদেরকে এই পরিবেশে না রেখে কলকাতায় নিয়ে গেলে উচ্চশিক্ষা দেওয়া সুবিধা হবে।
মা ঢাকার সাথে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়েই কলকাতায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। আব্বা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রথমে অসন্তুষ্ট হলেও প্রায় দেড়-দুই মাস খোঁজাখুঁজির পর আব্বা পার্ক সার্কাস ও গড়িয়াহাটার মাঝামাঝি এলাকায় একটা তিন তলা বাড়ির একতলা ভাড়া নিলে আমরা এখানে এসে উঠলাম।
বাড়িটার ঠিকানা ৮বি, তারক দত্ত রোড।
তারক দত্ত রোড আর সার্কাস রেঞ্জ রাস্তার সংযোগস্থলের ঠিক উল্টো পাশের এক গলির শেষ মাথায় এই বাড়িটা। বাড়ির মালিক কাজী আব্দুল ওদুদ। কিছুদিন পরে জানতে পারলাম তিনি প্রসিদ্ধ গবেষক, সাহিত্য বিশেষজ্ঞ ও সাহিত্যিক।
ফ্ল্যাটটা অনেকটা ইংরেজি জেড আকৃতির। বাইরের ঘরটা বৈঠকখানা, ওখান দিয়ে বাইরের গলিতে বের হওয়া যায়। তার পাশে ডান দিকে আর একটা ঘর এখানে আব্বা, বড় ভাই আর আমার শোয়ার ব্যবস্থা। এ ঘর থেকে বের হলেই বাম দিকে একটা ছোট গলি ওখান দিয়েও বাড়ি থেকে বের হওয়া যেত। পাশে দোতলা-তিনতলায় ওঠার সিঁড়ি। দোতলা-তিনতলার লোকজন এ গলি দিয়েই বাইরে যাওয়া-আসা করত। এইখান থেকে একেবারে বাড়ির পশ্চিমের শেষ মাথা পর্যস্ত চওড়া ঘোরানো বারান্দা। সিঁড়িটা পার হলে আর একটা ঘর এখানে মা আর আপা থাকতেন। এ ঘরটার শেষ মাথায় ডান দিকে দুটো ছোট ছোট ঘর, পাশাপাশি, ওর একটা রান্নাঘর আর একটা হাঁড়ি-পাতাল, থালা-গ্লাস, খাবার পানির কলসি আর রান্না-করা খাবার রাখার জায়গা। অনেক সময় আমরা এখানে বসেও খেতাম। তবে অধিকাংশ সময় মা-আপার শোবার ঘরের মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করা হতো। এর সব কিছু পার হয়ে ডান দিকের শেষ মাথায় একটা গোসলখানা আর একটা টয়লেট। গোসলখানার এক পাশটায় একটা মাঝারী পানি রাখার চৌবাচ্চা।
বাড়ির বাইরে পশ্চিম কোণায় একটা বিরাট চৌবাচ্চা। ওটাতে মিউনিসিপ্যালিটির সরবরাহ করা পানি এসে ভরতো। আর সেখান থেকে বালতিতে করে পানি নিয়ে গোসলখানার চৌবাচ্চা ভরে রাখা হতো। বাইরের চৌবাচ্চার পেছন দিকে আর একটা কল, সেটা দিয়ে গঙ্গার ঘোলাটে পানি সরবরাহ করা হতো। মা-আপার শোবার ঘরের সামনে একটা বেশ খোলামেলা উঠানমতো জায়গা। বিকেলবেলা বা ছুটির দিন ওখানে বসে গল্প-গুজব করতাম। আব্বা বাজার থেকে আনাজপাতি আনলে মা এখানে বসেই মাছ-মুরগী কাটাকুটি করতেন আর আমরা বারান্দায় বসে কথাবার্তা বলে মাকে সঙ্গ দিতাম। শীতকালে আমরা ওখানটায় বসে সূর্যের আলোয় পানি গরম করে গোসল করতাম।
এই বাড়িটার কয়েকটা বাড়ির পশ্চিমে গিয়ে উত্তর দিকে দুটি বাড়ি পরে পার্ক সার্কাস এলাকার কড়েয়া থানা। আর পূবে দশ বারটা বাড়ি পার হয়ে সৈয়দ আমির আলী এভিনিউ-এর ট্রাম রাস্তা। আমাদের বৈঠকখানার ঠিক উপরে দোতলার ঘরটা ছিল কাজী আব্দুল ওদুদ সাহেবের স্টাডি। যেহেতু পক্ককেশ বয়স্ক ব্যক্তি, তাই আমরা ছোটরা তাকে নানা বলে সম্বোধন করতাম।
কাজী নানার সংসারে তখন ছিলেন তার স্ত্রী যিনি সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, তার জগৎ-সংসার ছিল কেবল বিছানার চারপাশ। সেখানে শুয়ে শুয়েই তিনি তিন-চার জন কাজের বুয়াকে দিয়ে বাড়ির বাজার-ঘাট, রান্না, খাওয়ানো সব তদারক করতেন। তাদের সন্তানদের মধ্যে বড় এক মেয়ে, যার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, স্বামী কলেজের অধ্যাপক, তার পরের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। সে বোম্বাইয়ে কর্মরত। আর সব থেকে ছোট ছেলে তখন মেডিকেল কলেজে পড়ত। কাজী নানা বড় ছেলেকে ডাকতেন বুদ্ধ বলে, গৌতম বুদ্ধের কথা মনে করে আর ছোট ছেলের নাম ছিল জীবু গৌতম বুদ্ধের সময়ের অন্যতম বিখ্যাত চিকিৎসক জীবক শব্দের অপভ্রংশ।
এই জীবক বুদ্ধকে একবার হত্যা প্রচেষ্টায় পাহাড়ের ওপর থেকে বিরুদ্ধ শক্তি পাথর ছুঁড়ে মারলে পাথরটি তার পায়ে আঘাত করে। পায়ের দুটি আঙুল থেঁতলে যায়। কিন্তু তিনি কোনও অষুধ খেতে সম্মত ছিলেন না। বিষয়টি জানতে পেরে জীবক একটি অষুধ আটটি পদ্মফুলের কুঁড়ির ডাঁটার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ফুলের কুঁড়িগুলো নিয়ে বুদ্ধের সাথে দেখা করতে গেলেন। বুদ্ধ পদ্মফুল খুব পছন্দ করতেন।
বুদ্ধ জানতেন জীবক অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ভীষক, চিকিৎসক, তাই তাকে দেখে তিনি আগেই বললেন, আমি কিন্তু তোমার কোনও ঔষধ সেবন করব না বৎস।
জীবক বললেন, না, প্রভু, আমি কোনও ঔষধ নিয়ে আসিনি। আমি আপনার প্রিয় ফুল নিয়ে এসেছি। আমার বিনীত অনুরোধ, আগামী আট দিন প্রতিদিন প্রত্যুষে একটি করে ফুলের সুবাস আপনি গ্রহণ করবেন।
বুদ্ধ বললেন, তথাস্তু।
আশ্চর্যের বিষয় কুঁড়ির ডাঁটার ভেতর প্রবেশ করিয়ে দেওয়া ঔষধের প্রভাব ফুলের সুবাসে এমনভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল, যে ঐ সুবাস গ্রহণ করেই বুদ্ধ পরের আটদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে গেলেন।
এ গল্পটা আমি এ সময়েই একটা শারদীয় কিশোর সাময়িকীতে পড়েছিলাম। মজার বিষয় জীবু মামাও ডাক্তারী পড়ছিলেন।
কাজী নানা আব্বার সামনে দুঃখ করে বলতেন, আমার দুই ছেলেই অশিক্ষিত। তার দুঃখ ছিল ছেলে দুটির কোনওটিই তার মতো বিদ্বান হয়নি। তারা শিক্ষিত হয়ে জীবন ধারণের অর্থ উপার্জন করতে পারে, কিন্তু জ্ঞানের চর্চ্চা করে না কেউই।
কাজী নানার সাথে দেখা করতে নানা বিশিষ্টজনেরা আসতেন। এর মধ্যে মাঝে মাঝে আসতেন মনোজ বসু। তিনি যেহেতু পূর্ব বাংলার মানুষ সেই সুবাদে মাঝে মাঝে পুর্ব পাকিস্তানে তিনি বেড়াতে আসতেন। অর আব্বা ভিসা সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন বলে আব্বার সাথে তার বেশ সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল। একদিন শুনি তিনি চীন দেখে এলাম নামে একটি বই লিখেছেন। বইটা আব্বাকে এক কপি উপহারও দিলেন তিনি। আমরা সবাই মিলে সেই চমৎকার ভ্রমণ কাহিনী পড়ে খুব আনন্দ পেলাম।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন রেডিওতে শুনি ভারত ও চীনের মধ্যে পশ্চিমে লাদাখ আর পূবে নেফা অঞ্চল নিয়ে বিরোধের ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সারা দেশে সে কি উত্তেজনা। প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহেরু সারা দেশে জরুরী অবস্থা জারী করলেন। সারা দেশ থেকে সমস্ত সোনা বাজেয়াপ্ত করা হল, সোনার দোকানগুলো বন্ধ হয়ে গেল। চৌরঙ্গীর ফুটপাতগুলোতে অভাবি রোগা স্বর্ণকাররা কাগজ সেলাই করা বড় বড় সুঁই-ভ্রমর তৈরী করে বেচতো আর আকুতি করত, দাদা, একটা কিনে আমাদেরকে সাহায্য করুন। আমরা তো ভিক্ষা চাচ্ছি না। শুনেছি, অনেকে অভাব সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যাও করেছিল। সমস্ত বিদেশি আমদানি নিষিদ্ধি হয়ে গেল।
প্রধানমন্ত্রী আরও ঘোষণা করলেন, ভারত নিজের জিনিস নিজে বানাবে না হলে সে জিনিস বিদেশ থেকে এনে ব্যবহার করবে না। মনে পড়ে বালিগঞ্জের একটা গ্যারেজে তখন ঊষা ফ্যান তৈরী হতো, অত্যন্ত নিন্মমানের, ফ্যানের ব্লেড খুলে অনেকে আহত হয়েছেন বলেও শোনা গেল। বাজার থেকে বহু খাদ্যদ্রব্য উধাও হয়ে গেল। চাল-ডাল-তেলের জন্য রেশন পদ্ধতি চালু হল। আব্বা অবশ্য দূতাবাসের কর্মকর্তা বলে মিশন থেকে রেশন পেতেন।
প্রতি পনেরদিন পর পর আব্বা আমাকে নিয়ে রেশন তুলতে যেতেন দূতাবাসের পেছনের একটি ভবনে। রেশন তুলে বাড়ি ফিরলে মা অবধারিতভাবে গম ঝেড়ে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতেন। গমের দানা ঝনঝনে হয়ে উঠলে থলেতে ভরে আমাকে দিতেন পাড়ার গম ভাঙানোর মেশিন থেকে ভাঙিয়ে আটা তৈরি করে আনতে।
এ সময়ে আমাদের খাওয়ার নিয়মও বদলে গেল। রেশনে চাল কম পাওয়া যেত বলে সকালে ও রাতে আমাদের রুটি খেতে হতো। দুপুরে অবশ্য ভাত থাকত। প্রতিদিন সবার জন্য রুটি বেলতে বেলতে মায়ের হাতের তালুর ত্বক শক্ত হয়ে গেল।
মজার ঘটনা ঘটলো এই সময়। একদিন বিকালে মনোজ বসু হস্তদস্ত হয়ে কাজী নানার বাসায় এসে বললেন, ওদুদ সাহেব আমাকে কিছুদিন একটু আশ্রয় দেন।
কাজী নানা জিজ্ঞেস করলেন, কেন কি হয়েছে।
মনোজ বসু বললেন, আমার চীন দেখে এলাম বইয়ের জন্য আমাকে চীনের দালাল আর গুপ্তচর সন্দেহ করে লোকজন আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে, আমি কোনও রকম পালিয়ে এসেছি। বাড়িতে তখন আর কেউ ছিল না বলে রক্ষা না হলে সবাইকে মারধর করত।
মনোজ বসু অবশ্য একা চীন সফরে যাননি। ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধির একজন সদস্য হিসেবেই চীন যুদ্ধের বছরখানেক আগে চীন সফর করেছিলেন। মাও জেদং-এর সাথে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎকারের অংশটুকু খুবই মজার করে লেখা ছিল। চীন দেখে এলাম বইটি যখন বের হয়, তখন ওটা প্রায় হট কেক হয়ে উঠেছিল। অনেকেই তার মজাদার বিবরণ খুব প্রশংসা করেছিল। আমরা সবাই বইটা পড়েছিলাম।
মনোজ বসু কয়েকদিন আমাদের ড্রইং রুমে, কাজী নানার স্টাডিতে কাটানোর পর কাজী নানারই উদ্যোগে আয়োজিত একটা সংবাদ সম্মেলনে, আমি প্রতারিত হইয়াছি। আমাকে ভুল বুঝানো হইয়াছিল- প্রভৃতি বিবৃতি দিয়ে কোনও রকমে আত্মরক্ষা করতে পারলেন। কিন্তু মজার ব্যপার কাজী নানা একদিন আব্বাকে বললেন, সে সময়ের বড় সাহিত্যিকদের কেউই মনোজ বসুকে কোনও রকম সহায়তা করা দূরে থাক, সহানুভূতিশীল কথাও উচ্চারণ করেননি।
কলকাতায় একটা চীনে পাড়া ছিল। সেখান দিয়ে হাঁটলে মনে হতো না আমরা কলকাতায় আছি। দোকান আর বাড়ির দরজা জানালায় চীনে লেখা। চারপাশে নানা বয়সের চীনম্যান, চ্যাপটা চোখ-নাক-মুখওয়ালা মানুষ ঘোরাফেরা করছে। ওদের প্রধান পেশা ছিল জুতো বানানো, লন্ড্রি আর রেস্টুরেন্ট ব্যাবসা।
চীন-ভারত যুদ্ধের ফলে বংশ পরম্পরায় ভারতে বাস করা এই সব চীনামানুষের দোকান আর বাড়ি লুট হল, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হল। যেন ওরাই ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। অল্পবয়স্ক চীনা ছেলে-মেয়েদের নানাভাবে অত্যাচার করা হতো পথেঘাটে। বেশ কিছু চীনা মেয়ে হারিয়ে গেল চিরতরে, কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। এত কিছু ঘটনা ঘটে গেলেও পুলিশ থাকল নির্লিপ্ত। দৈনিক পত্রিকাগুলো সে সময়ে খুবই দায়সারাভাবে খবরগুলো প্রচার করেছিল।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ ঊনিশশো সাতচল্লিশ থেকে ষাইট জীবনস্মৃতি সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান