Wednesday 20 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিল্পীলোকের উজ্জ্বল নক্ষত্র আচার্য জয়নুল


২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২০:০৮

যিনি সংকল্প ও রহস্য শিক্ষা দেন তিনিই আচার্য। জয়নুল আবেদিন বাংলাদেশে চিত্রকলার ক্ষেত্রে এক মহান সংকল্প এবং সংকল্প বাস্তবে রুপদানের জন্য মন ও হাতের যে নিখুঁত প্রযুক্তি দরকার সেই রহস্য প্রচার ও প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ২৯ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলায়। কিন্তু জেলা ও দেশের গন্ডী পেরিয়ে নিজেকে বিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত বাঙালী হিসেবে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ব্যপ্ত করে সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

সমাজে একজন চিত্রশিল্পীর প্রধান কাজই হলো তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে সুন্দরকে উপস্থাপন করা। শাস্ত্রীয় মতে একমাত্র সুন্দর ও সৌন্দর্যকে নিয়ে শিল্পকলা চর্চার দায়িত্ব পালনই শিল্পীর পেশাগত কর্তব্য। রকমারি রং বিন্যাস করে ভাবনায়, অনুভূতিতে রঙ্গিন আবেশ সৃষ্টি করার মত দৃষ্টি নন্দন মনোমুগ্ধকর চিত্র রচনাই শিল্পীর কাছে সবার কাম্য। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন ও গতানুগতিক অন্যান্য শিল্পীদের মত দৃষ্টিনন্দন চিত্রসম্ভার দিয়ে শিল্পবোদ্ধা ও দর্শক সাধারনকে তৃপ্ত করে নিজে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন। কিন্তু তিনি শুধু নান্দনিক কলাকৌশল দিয়ে চিত্ররাজি সৃষ্টিতেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি। নিজের অন্তরানুভূতিকে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন নানা দিকে। ক্যানভাসকে, চিত্রকে রং তুলিকে তিনি প্রতিবাদী বক্তব্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছিলেন। মানুষের দুঃখ দুর্দশা, নির্যাতন, নিপীড়নের আকুতিকে ছবির বিষয়ে রূপান্তরিত করে তুলেছিলেন। তাঁর সংবেদনশীল মনকে মানবতাবাদী ভূমিকায় ব্যবহার করেছিলেন। নান্দনিক দিকগুলোকে গ্রাহ্য করেই এবং চিত্রের মান আর গুনগত বৈশিষ্ট্যকে বজায় রেখেই তিনি এই সব চিত্র রচনা করেছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধারার সংমিশ্রনে তিনি একটি নির্দিষ্ট ধারার ও সৃষ্টি করেছিলেন যা তাঁর সমসাময়িক ও উত্তরসূরীদের প্রভাবিত করেছে।

বিজ্ঞাপন

আচার্য জয়নুলের শিল্পীজীবনের শিল্পকর্ম বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তাঁর বক্তব্য ও বিষয় প্রধানত তিনটি । প্রথমত প্রকৃতিকে তার চেনারূপে সুন্দরভাবে প্রকাশ করা, দ্বিতীয়ত সাধারন গনজীবনকে চিত্রে তুলে ধরা, তৃতীয়ত সুন্দর ও সৃষ্টিতে মানুষের অসহায়তাকে তুলে ধরা । তাঁর ‘৪৩ এর দুর্ভিক্ষ চিত্রাবলী এবং নবান্ন (’৬৯)’ বা ‘মনপুরা- ৭০’ জাতীয় সুদীর্ঘ স্ক্রলচিত্র যেন মানুষের নির্লিপ্ততার ব্যর্থতার প্রতি ব্যঙ্গ । তবে তিনি আজীবন আশাবাদী ছিলেন । চিত্র কলার ভবিষ্যত সম্পর্কে যেমন জীবনে সুন্দর প্রতিষ্ঠায় যেমন, তেমনই মানুষের ভবিষ্যত সম্বন্ধেও । তাই তাঁর মহৎ চিত্র ‘মনপুরা-৭০’-এ দেখা যায়, মৃতের মিছিলের শেষ এক প্রান্তে এক জীবিত পুরুষ, যার ভবিষ্যৎ কন্টকময়, দুর্লঙ্ঘ, সংগ্রামী কিন্তু বাস্তব ও জীবন্ত ।

ছেলেবেলা থেকেই নৈসর্গিক প্রকৃতির সংগে জয়নুল মিশে থাকতেন । সাদাকালোতে আঁকা গ্রাম্যবধূ, নদী, নৌকা, ধানক্ষেত কি অপরূপ রূপে তিনি উদ্ভাসিত করতেন – রঙের মেলা ছড়িয়েও সেই রূপ ফোটানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয় । রেখার পরিমিতি, তুলির সাবলীল গতির মধ্যে দূরনিকটের অভিঘাত অদ্ভূত ব্যঞ্জনার জন্ম দেয় । বাংলাদেশের গ্রাম্যজীবনের নানা টুকরো ছবি তাঁর ড্রয়িংয়ে ধরা দিয়েছে । পাকিস্তান আমলে করাচিতে সরকারি কাগজ মাহে নও, পাকিস্তান কোয়ার্টালিতে ও তাঁর প্রচুর ড্রয়িং প্রকাশ হতো । মোটা তুলির আঁচড়ে সরু তুলির রেখায় স্থাপিত হতো ছবির বিষয়বস্তু, সংগীতের মত আবহ তৈরি হতো – যার রেশ সহজে মিলিয়ে যেত না চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠতো দূর গ্রামের সীমান্ত রেখায় দুটি তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সামনে বিকৃত ধানক্ষেত জৈষ্ঠের বাতাস আন্দোলিত, ক্ষেতের আলি বেয়ে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে ছুটে যাওয়া গ্রাম্য বালিকা শুধু দুটি তুলির টানে ম্যাজিক বলে প্রতীয়মান হতো, ভারতীয় রীতির রৈখিক অভিব্যক্তির সাথে ইউরোপীয় একাডেমিক ড্রয়িংয়ের কম্বিনেশন ঘটিয়েছিলেন তাঁর ড্রয়িংয়ে । গভীরভাবে দেখতেন তিনি, অনুভব করতেন বিষয়বস্তুকে, সাযুজ্য ঘটাতেন প্রকাশ ক্ষতমার সংগে এ দুয়ের। দেখার প্রত্যুত্তর কাগজের উপর বলিষ্ঠভাবে ফুটে উঠাতো কালো কালির আঁচড়ে । , বাংলাদেশের নৈসর্গিক দৃশ্যের মাধুরিমায় তিনি ছিলেন আবিষ্ট। তাঁর মনে ঝড় তুলতো আদিবাসী সাঁওতালদের ছন্দোময় জীবনযাত্রা। ব্রহ্মপুত্রের দুকূল ছাপানো স্রোতধারা, মাঝনদীতে ভেসে থাকা চরের বুকে সাদা কাশফুলের সমারোহ, দূর নদীতে যেখানে পানির রং দোয়াতের কালির মতো, সেখানে জেলেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত, তাঁর ছবিতে উঠে এসেছে । ‘৫০ এর মন্বন্তর এক ধাক্কায় জয়নুল আবেদিনকে এই মোহাবিষ্টতা থেকে কঠিন পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনলো । ত্রিশের দশকের অর্থনৈতিক মন্দা সারা পৃথিবীতে পরিব্যপ্ত । তার ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ বাহিনীর উপমহাদেশে উপস্থিতি-জয়নুল স্বাসরুদ্ধকর কোলকাতা থেকে জন্মভূমি ময়মনসিংহে ফিরে এলেন । তখন এক শ্রেনীর কালোবাজারির সহায়তায় বাজার থেকে ধান- চাল উধাও হয়ে গেল অধিক মুনাফার লোভে । মানুষ না খেতে পেরে মারা যেতে লাগলো অসহায়ের মতো । জয়নুল আবার চলে গেলেন কোলকাতায় । পিছু পিছু ধেয়ে এলা তাঁর ছবির সুখী, সমৃদ্ধ চরিত্ররা-কৃষক, শ্রমিক, জেলে অস্থিচর্মসার-খাদ্যের সন্ধানে রাজধানী কোলকাতায় । খাবারের দোকানের সামনে সজ্জিত খাবারের দিকে তাকিয়ে তারা পথে পড়ে মারা যেতে লাগলো । জয়নুল আবেদিন পাথর হয়ে গেলেন ।

মনুষ্য সৃষ্ট এই দূর্ভিক্ষকে তিনি দলিল করে রাখতে চাইলেন । যুদ্ধের বাজারে কাগজের দূর্মূল্য ও দুস্প্রাপ্যতার কারনে তিনি বেছে নিলেন ঈষৎ হলুদ রংয়ের মোটা প্যাকেজিং কাগজ । মোটা তুলিতেই কালো রংয়ের মনুষ্য ইতিহাসের এই জঘন্যতম ঘটনাকে চিত্রয়াতি করলেন মোট কুড়ি খানা ছবিতে । জয়নুল আবেদিনের চোখে তখন রং নেই শুধু মৃত্যুর কালো ছায়া । ড্রয়িংয়ের অসাধারন পরিমিতিবোধ, আলো ছায়ার সাযুজ্য এবং স্পেসের বিভাজন, ছবিগুলো হয়ে উঠলো গভীর, বাঙ্ময় । সারাবিশ্ব শিহরিত হলো তাঁর সৃষ্টি ম্যাডোনা দেখে উর্দ্ধ আকাশে শূন্য দৃষ্টি মেলে অর্ধশায়িত মাতা, যার একহাত রক্ষিত শূন্য থালায়, কোলে হাড্ডিসার শিশু, শুকনো স্তনের প্রতি তার আকুতি- রাফায়েল-মাইকেলেঞ্জেলোর ম্যাডোনাকে যেন ব্যঙ্গ করে । নর্থ-সাউথের ম্যাডোনার এই চিত্রমালার মাধ্যমেই জয়নুল আবেদিন বিশ্বপরিচিতি লাভ করেন । কোলকাতায় এ ছবির প্রদর্শনীতে এসেছিলেন শিল্পপতি বিড়লা ।

ছবিগুলো ছেপে তিনি দুহাতে চোখ ঢেকে চিৎকার করে উঠেছিলেন, সরিয়ে নিয়ে যাও ছবিগুলো । কারন এ দুর্ভিক্ষতো তাদেরই সৃষ্ট। প্রখ্যাত ব্রিটিশ চিত্র সমালোচক এরিক নিউটনের ভাষায় ছবিগুলো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক সমন্বয়, যাহা অনেকের কাছে অসাধ্য মনে হতে পারে। দুর্ভিক্ষের এ চিত্র মালা জয়নুলের খুবই প্রিয় ছিল । একটি ছবিকে ও তিনি হাত ছাড়া করেননি । তখনকার কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপত্র ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে ছবিগুলো । ২০ খানা ছবি থেকে ১২ খানা ছবি ব্যবহৃত হয়েছে ইলা সেন রচিত ‘ডার্কেনিং ডেজ’ নামক বইতে । টাইটেল পেজে উল্লেখ ছিল, ‘ডার্কেনিং ডেজ বিইং এ ন্যারেটিভ অফ ফেমিন স্ট্রিকেন বেঙ্গল বাই ইলা সেন ইউথ ড্রয়িং ফ্রম লাইফ বাই জয়নুল আবেদিন’ । বইটির প্রকাশক ছিলেন কোলকাতার সুনিল গুপ্ত । ড্রয়িংয়ের মধ্য দিয়ে পুরো পরিবেশ ফুটিয়ে তোলার মুন্সিয়ানা ছিল তাঁর কাছে । বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে তাঁর এমন একটি চিত্রিত বই শামসুদ্দিন আবুল কালামের লেখা ‘কাশ বনের কন্যা’ এখনও অপ্রতিদ্বন্দ্বী । তুলির আঁচড়ে কি নিপুনতায় রেখা আশ্চর্য সংবেদনশীল হয়ে উঠছে । প্রকৃতিকে করেছে বাঙ্ময় । পত্রহিন বিশাল বৃক্ষসারির নির্জনতার মত কলঙ্কিনী নায়িকার একাকিত্ব কি সুন্দর প্রতীকে ধরা দিয়েছে । তেমনি আর একটি ছবি-বর্ষার পুঞ্জিভূত মেঘের ছায়ায় অন্ধকার নদীর বুকে সারি সারি নৌকা ঝালকাঠি বন্দরে টিপ টিপ বৃষ্টিতে অপেক্ষমান । অন্য সব ছবির কথা ছেড়ে দিলেও শুধু কালো কালিতে আঁকা ড্রয়িংগুলোর জন্য জয়নুল আবেদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবেন । ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের পর ১৯৪৭ এর স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা সংঘাত ও টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কোলকাতা তথা সারা বাংলার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে কমিউনিষ্ট পার্টি ও ফ্যাসি বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল । জয়নুল আবেদিন সরাসরি কমিউনিষ্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না । কিন্তু এই প্রগতিশীল আন্দোলনের সংগে তাঁর প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল । স্বাধীনতার আন্দোলন যত এগোতে থাকে, ততই নানা রকম সামাজিক সংহতির পাশা পাশি হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ ও ঘনীভূত হতে থাকে । এই বিভেদ চুড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৪৬ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় । এর প্রভাব পড়ে শিল্পের ক্ষেত্রেও । ১৯৪৬ এর শেষ দিকে মুসলমান শিল্পীদের ছবি নিয়ে আলাদা প্রদর্শিনী অনুষ্ঠিত হয় কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজে । জয়নুল ছিলেন এই প্রদর্শনীর প্রধান শিল্পী । এরকম সংঘাত ও সংহতির টানাপোড়েনের পরিমন্ডলের মধ্যে ১৯৪৭ এর ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন ও বিভাজিত হলো । ঘটনাটি জয়নুলের জীবনেও ভারতীয় শিল্পের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ন । দেশ ভাগের ফলে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো-পূর্ব বাংলায় চলে যাওয়ার । কেননা এখানেই তাঁর জন্ম এবং এদেশের সংগেই তাঁর নাড়ীর যোগ । ১৯৪৭ এর আগস্টেই তিনি কোলকাতার চাকুরী ছেড়ে ঢাকায় যান ।

ঢাকায় আসার পর জয়নুলের প্রধান কৃতিত্ব ঢাকায় একটি শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা । ১৯৪৮ এর নভেম্বরে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্ট । তিনি তাঁর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন । ১৯৪৮ এর ১৪ আগস্ট পকিস্তানের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল ভিন্ন ধরনের এক প্রদর্শনী । ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম কৃতিত্বের বিষয়টি পর্যালোচনা করতে একটি পোষ্টার প্রদর্শনীর পরিকল্পনা করা হয় । সেসব পোষ্টারের বিষয় ছিল ভারতবর্ষে মুসলিম আধিপত্য বিস্তারের শুরু থেকে অর্থাৎ সুলতান মাহমুদের দিল্লি বিজয় থেকে মহম্মদ আলী জিন্নার পাকিস্তান গড়ে তোলা পর্যন্ত মুসলিম কৃতিত্বের দিকচিহ্নগুলি । এ সব পোষ্টারের ড্রয়িংগুলি করেন জয়নুল আবেদিন । এই মুসলিম আত্ম পরিচয় থেকে বাঙ্গালি আত্মপরিচয়ের মধ্যে দিয়ে সামগ্রিকভাবে আত্মপরিচয় সঞ্চালনই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক কার্য্যক্রমের প্রধান এক প্রকল্প, এই প্রকল্পের সংগে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন জয়নুল । বাংলায় শিল্পকলায় এটাই তাঁর প্রধান এক অবদান । ঢাকায় এসে জয়নুলের মন গেল চিত্রশিক্ষা সংগঠন কার্যে । তিনি শিল্পী হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সুন্তুষ্ট হননি । তিনি ছিলেন একজন একরোখা সংগঠক । মূর্খ অশিক্ষিত গ্রাম্য সরকার, জয়নুলকে যথামূল্য দেবার ক্ষমতা ছিল না তার । চিত্র যে শিল্প এবং শিল্প যে সমাজের প্রাণ সে গূঢ় কথা তাঁর বোধের অতিত ছিল । যে সমস্ত ঠেলে চারুকলা কলেজ তো দাডড়য়েই গেল পঞ্চাশ দশকের গোড়ায় জয়নুলেই অমানুষিক জেদের ধাক্কায় । জয়নুল থেকেই বাংলাদেশের সকল শিল্পী, সকল চিত্র শিল্পী । এত বিরাট সম্ভাবনার ব্যাপারটি সম্পন্ন করতে গিয়ে শিক্ষক সংগঠক জয়নুলের নিচে শিল্পী জয়নুল কিঞ্চিত চাপা পড়বে, এ কিছু অস্বাভাবিক নয় । এ কাজ উদ্ধার করতে তাঁকে রাজনৈতিক নেতা, উর্দ্ধতন আমলা, নয়নাতর সাংস্কৃতিক দালাল ও গলাবাজদের সহবৎ করতে হয়েছে । , চারুকলা ইনষ্টিটিউট সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুকলা হবার পরে তাঁর কর্মবীরোচিত প্রেরণা ভিন্ন অবলম্বন খুঁজতে আরম্ভ করল । পেয়ে গেল সোনারগাঁয়ের শিল্পী কলোনী ও জাদুঘরের স্বপ্নের ভিতরে তাঁর ছবি তৈরি ধ্যানময় ঘোর যেন আর তাঁর মধ্যে তেমন করে ফিরলো না । এখানাইে আমরা পেয়ে যাই শিল্পী থেকে শিল্পাচার্যে উত্তরনকে । আমাদের এই পোড়া দেশে যেখানে কোন ভাস্কর্য প্রকাশ্যে স্থাপন করা যায় না, সেখানে চিত্রকলাকে বিতর্কের অতীত করে জনজীবনে, রাষ্টীয় জীবনে, ব্যক্তির অর্ন্তজীবনে আসন করে দেওয়া গেল । সমগ্র মানব জাতীর জন্য সুন্দর জীবন নির্মান করাই হচ্ছে শিল্পকলার মৌলিক উদ্দেশ্য । তিনি প্রায়ই বলতেন একটি সুন্দর রং সুন্দর, কিন্তু তাঁর চেয়ে সুন্দর একটি সুন্দর মন বা সুন্দর চরিত্র । মন ও চরিত্রকে সুন্দর করার জন্য অন্যান্য অনেক গুনের সংগে শৈল্পিক গুন থাকা এবং শিল্পকলার প্রতি গভীর অনুরাগ থাকা বাঞ্ছনীয় । তিনি ছবি আঁকতেন প্রকৃতির সৌন্দর্যকে তুলে ধরার জন্য, জীবনে যা সুন্দর এবং জীবনে যা সুন্দর নয় তাকেও দেখানোর জন্য, জীবনে সুন্দরের প্রতিষ্ঠায় যে শক্তি বিরোধীতা করে, তাকেও চিহ্নিত করার জন্য । যে ছবি মানুষকে সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সেটাই হচ্ছে মহৎ ছবি, যে শিল্পী তাহা পারেন তিনিই মহৎ। তাঁর সারাজীবনের শিল্প সাধনা ও শিল্প আন্দোলন ও তাঁর জীবনে এবং আমাদের সবার জীবনকে সেই সুন্দরের দিকে নিয়ে যাবার আন্দোলন । সুন্দর জীবন তাঁর কাছে সৎ ও সুষমজীবন যেখানে সব কিছু রুচি সম্মত এবং ভারসাম্য বিশিষ্ট । নিজের প্রতি, সমাজের প্রতি, জাতীর প্রতি, বিশ্ব মানবতার প্রতি এবং প্রকৃতি বা পরিবেশের প্রতি সততা ও সচেতনা এই সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করে । শুধু নিজের কথা ভাবলেই চলে না, সবার কথা, সমাজের কথা, ভবিষ্যতের কথা ও এক সংগে ভাবতে হয় । প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে সুন্দর-সুষ্ঠু সমন্বয় একান্তই দরকার । এর পিছনে ও কাজ করে সৌন্দর্যবোধ ও মাধবতাবোধ । জয়নুল আবেদিন আজীবন এই বোধ দ্বারা তাডড়ত হয়েছেন এবং নিজের জীবনকে সুন্দর করতে চেয়েছেন । অন্য সবার জীবনেও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন । এই বোধ তাঁকে শিল্পী করেছে, এই বোধ তাঁকে প্রকৃতিপ্রেমী করেছে । এই বোধ থেকে তিনি ছবি এঁকেছেন, ছবি আঁকার আন্দোলন করেছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং আর্ন্তজাতিক সৌহার্দ্য ও মানবতার ডাকে সাড়া দিয়েছেন । ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধি নয়, বরং সমষ্টির কল্যাণে পরার্থপরতায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন জয়নুল । তাঁর অবদান মূল্যায়ন করতে গেলে তাঁর জীবনের আরো কয়েকটি তথ্যের দিকে এবং তাঁর চিন্তাচেতনার রূপান্তরশিলতার দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন । একটি মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলিম পরিবারের সদস্য হিসেবে জয়নুল শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন । সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আর্থিক সামর্থ্য তাঁর পরিবারের ছিল না । তবুও তিনি প্রবল ইচ্ছা ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে শিল্পী হওয়ার অভীপ্সায় ময়মনসিংহ থেকে কোলকাতায় গিয়েছিলেন । কঠোর সংগ্রাম করেই তাঁর সেই আকাঙ্খা পূরন করতে হয়েছে । ব্যক্তিগত এই স্বপ্ন পূরনের সংগ্রামশীল কমিউনিষ্ট যাত্রাপথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বাংলার মন্বন্তর, লাখ লাখ অনাহারি মানুষের মৃত্যু, দূর্ভিক্ষ-চিত্র অংকন, লেখক শিল্পী সাহিত্যিকদের সংগে সংযোগ প্রভৃতি তাঁর চেতনায় যে অভিঘাত সৃষ্টি করে, তাতে তিনি এক সম্পূর্ন ভিন্ন মানুষে পরিনত হন । ব্যক্তি অভীপ্সা শেষ পর্যন্ত সমষ্টির কল্যান কামনার সংগে যুক্ত হয়ে পড়ে। প্রবল হয়ে ওঠে সামাজিক দায়বোধ । ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্দ্ধে উঠে শেষ পর্যন্ত তিনি সমষ্টির স্বার্থ চিন্তায় নিজেকে উৎসর্গ করেন । ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে ‘আমি’ থেকে ‘আমরা’য় এই যে উত্তরণ ও রূপান্তর, সেটাই তাঁর জীবনকে মহিমান্বিত করেছে । সর্বোপরি তিনি তাঁর স্বক্রিয়তাকে ধরে রেখেছেন । তাঁর আঞ্চলিক কথ্যভাষা, তাঁর নিজ এলাকার লোকশিল্প তথা দেশজ শিল্পকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন । প্রাচ্যের সংগে পাশ্চাত্যের রীতির সংমিশ্রনে নতুন ধারা সৃষ্টি করে তাঁর শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে মানবতাবোধ, দেশাত্মবোধকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করেছেন । জয় গান করি তাঁর এই শিল্পদর্শনের ।

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ চিত্রকলা শিল্প শিল্পীলোকের উজ্জ্বল নক্ষত্র আচার্য জয়নুল সাহিত্য হিমা আক্তার হিরামনি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর