যা দেখি তাতেই ঘোর, তাতেই বিস্ময়
২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২০:২৫
২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে সিঙ্গাপুরে আমার প্রথম রাত কেটেছে প্রায় নির্ঘুম। সারাটা রাত জেগে কাটলো বলে খুব সকালেই স্নান সেরে নিলাম। নিচে নেমে সাড়ে সাতটার মধ্যে নাস্তা করতে হবে। তারপর আমরা রওনা দেবো সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট ভবনের দিকে। সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি কর্মসূচি শুরু হবে।
হোটেলে খাবার ঘরে গিয়ে দেখি আমাদের আগে অনেকেই উপস্থিত। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদসহ অনেকেই ব্রেকফাস্ট টেবিলে উপস্থিত। ব্রেকফাস্টের জন্য কোনও কুপন নিতে হয় না। আগে বিলও দিতে হয় না। ব্রেকফাস্ট হোটেলের সৌজন্যে।
কাউন্টারে কম্পিউটার নিয়ে দুজন নারী কর্মী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। রুম নম্বর বলতেই আর একজন হাস্যোজ্জ্বল তরুণী এসে বসিয়ে দিলেন একটি খালি টেবিলে। জিজ্ঞেস করলেন, টি অর কফি? চা বা কফি যেটা বলা হবে সেটা তিনি এনে পরিবেশন করবেন। কিন্তু তার আগে থরে থরে সাজানো অসংখ্য খাবারের আইটেম থেকে নিজের পছন্দের আইটেমগুলো প্লেটে তুলে নিতে হবে। বুফে সিস্টেম। শতাধিক পদের খাবার থেকে পছন্দ করতেও তো দীর্ঘ সময় লাগার কথা। হালকা, ভারী সব ধরনের খাবার আছে। যতো খুশি নাও আর খাও। যারা একটু ভোজনরসিক তাদের জন্য একটা মোক্ষম আয়োজন। আমি স্বল্পাহারী। সকালে নাস্তা খাই দুটো রুটি, একটু ভাজি আর সঙ্গে বড় জোর একটি ডিমের পোচ অথবা মামলেট কিংবা সেদ্ধ। অথচ এখানে সাজানো কতো রকম আইটেম। আছে হরেক রকম ফল আর ফলের জুস।
আমি বেশি ঘোরাঘুরি না করে হাতের কাছে পাওয়া দু’চার পদ নিয়ে এসে টেবিলে বসলাম। কিছু ফল, বিশেষ করে ড্রাগন ফল এবং এক গ্লাস জুস নিলাম। নিতে ভুল করলাম না আমার পছন্দের ডিমের মামলেট। একজনকে চিড়া-দুধও খেতে দেখলাম। কেউ আবার ঘুরে ঘরে কি কি সব টেস্ট করে দেখছেন। আমি ঠিক করলাম, পরেরদিন আমিও একটু বেশি আইটেম ট্রাই করব।
নাস্তা সেরে লবিতে এসে দেখি একাত্তর টেলিভিশনের ফারজানা রূপা। রূপা আমাদের সঙ্গে যাননি। রূপা এবং সময় টেলিভিশনের প্রতিনিধি নিজস্ব উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রীর সফর কভার করতে সিঙ্গাপুর পৌঁছেছেন।
ওখানে গিয়ে সমস্যা হয়েছে, রূপার প্রেসিডেন্ট ভবনে যাওয়ার অনুমতি নেই। আমাদের দূতাবাস থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে অনুমতির। কিন্তু পাওয়া যাবে কি না সেটা অনিশ্চিত। ওখানে নিরাপত্তা কড়াকড়ি আমাদের দেশের চেয়ে ঢের বেশি।
রূপা আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন। রূপার সাংবাদিকতা জীবন শুরু আমার মাধ্যমে। আমি প্রথম ওকে মাতৃভূমিতে রিপোর্টার হিসেবে নিয়েছিলাম। রূপা খুবই সাহসী, পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে। মাতৃভূমিতে থাকতে একরাতে ডিউটি শেষে বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন। ছিনতাইকারীকে ধরে আচ্ছাছে ধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে ওই রাতেই এ খবর আমাকে জানানোর জন্য অফিসে এসেছিলেন।
রূপা কাছে এসে প্রথমেই জানতে চাইলেন, আমার কোনও অসুবিধা আছে কি না এবং ও কোনওভাবে আমাকে সহযোগিতা করতে পারে কি না। ওর আন্তরিকতা আমার মন ছুঁয়ে গেল। উপস্থিত সবাইকে এটা বলতে ভুললেন না যে আমি ওর প্রথম সম্পাদক।
রূপার এই বিনয়টাও ভাল লাগল। দেশে কয়েকজন তারকা সাংবাদিক আছেন যাদের হাতেখড়ি হয়েছিল আমার মাধ্যমে। কিন্তু তারা এখন সেটা অকপটে স্বীকার করবেন কি না জানি না।
রূপা সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রপতি ভবনের সরকারি অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হতে পারবেন কি না তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেও ওকে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে নেওয়া হলো। আশা, যদি শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া যায়! কিন্তু আসলে শেষ পর্যন্ত ও ভেতরে ঢুকতে পারেনি। পুরোটা সময় গেটে বসে থেকেও বিশেষ ব্যবস্থায় একাত্তর টিভিতে খবর ঠিকই পাঠিয়েছিলেন। চেষ্টা ও আগ্রহ থাকলে যে অসাধ্যসাধন করা যায় তা রূপা সেদিন আবার প্রমাণ করেছেন।
অরচার্ড রোডে অবস্থিত সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি ভবন ইস্তানায় আমরা ঢুকলাম প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা তল্লাশির পর। রাষ্ট্রপতি ভবনটি সিঙ্গাপুরের প্রাচীন ভবনগুলোর একটি। প্রায় দেড়শ বছর আগে তৈরি ভবনটি এর আগের আদলেই রাখা হয়েছে। ১৯৫৯ সালে সিঙ্গাপুরে নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা চালুর আগ পর্যন্ত এটি বৃটিশ গভর্নর হাউজ হিসেবে পরিচিত ছিল। ৪০ হেক্টর জমির ওপর এই ভবন এবং প্রাঙ্গন। সবুজে ছাওয়া পাহাড়ি এলাকার মতো এই রাষ্ট্রপতি ভবনে একসময় সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। সিঙ্গাপুরের বর্তমান রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুব দায়িত্ব গ্রহণের পর নাগরিকদের জন্য বছরে মোট ছয় দিন এই ভবন এলাকা দর্শন উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তবে ছবি তোলা এখনও বারণ।
নিরাপত্তা তল্লাশি শেষ করে আমরা আমাদের বহনকারী মাইক্রোবাসে উঠলাম। প্রেস ও মিডিয়া টিমের আমরা মোট ১৪ জন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, অতিরিক্ত প্রেস সচিব মো. নজরুল ইসলামও এই টিমের সদস্য। রাষ্ট্রপতি ভবনের সদর দরোজায় গিয়ে আমাদের গাড়ি থামল। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং তার অন্য সফরসঙ্গীরা তখনও পৌঁছেননি।
আমাদের ওখানে একদফা চেকের পর ভেতরে নিয়ে বসানো হলো। আমাদের দূতাবাস থেকে যে প্রেসকার্ড দেওয়া হয়েছে, তার বাইরেও এখানে আর একটি কার্ড দেওয়া হলো। রাষ্ট্রপতি ভাবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেকগুলো কর্মসূচি ছিল। রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মকর্তারা জানালেন, আমরা মিডিয়া টিমের সদস্যরা সবগুলো কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে পারব না। মাত্র দুজন ক্যামেরা পারসনকে সব অনুষ্ঠানে থাকার বিশেষ পাস দেওয়া হবে। আমাদের কর্মকর্তারা একটু দেনদরবার করলেন। কিন্তু ওপক্ষ সিদ্ধান্তে অনঢ়। কি আর করা, আমাদের নিয়ে ভেতরে একটি রুমে বসানো হলো। স্টেট রুম নামের ওই রুমে সমঝোতা স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে। ওই অনুষ্ঠানটিই শুধু আমাদের অবলোকন যোগ্য। ওই ভবনে প্রধানমন্ত্রীর অন্য সব কার্যক্রম গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য উন্মুক্ত নয়। কোথায় কি হচ্ছে সে তথ্য সংবাদকর্মীদের জানিয়ে দেওয়া হবে।
আমরা স্টেট রুমে বসে একটু ফটোসেশন করলাম। যে মঞ্চে বসে সমঝোতা স্বাক্ষর হবে তার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। একসময় স্বচ্ছ কাঁচের দরোজা দিয়ে দেখলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাগত অভ্যর্থনায় অংশ নিয়েছেন। তার সঙ্গে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লং। একটি চৌকশ দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অফ অনার প্রদান করলেন। এই বাহিনীর মহড়া আমরা আগেই দেখেছি।
অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান শেষে আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে যাওয়া হলো রাষ্ট্রপতি ভবনের ওয়েস্ট ড্রয়িংরুমে। সেখানে তিনি সিঙ্গাপুরের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হালিমা ইয়াকুবের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও আলোচনায় মিলিত হন।
এই সাক্ষাৎপর্ব ছিল মিনিট ত্রিশের।
রাষ্ট্রপতি ভবনের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা হোটেলের দিকে যাত্রা করি। গেট থেকে ফারজানা রূপাকেও আমাদের গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। ভেতরে ঢোকার অনুমতি না পেয়ে ও গেটেই অপেক্ষায় ছিল। এখন আমাদের ফেরার সঙ্গী হলো। রূপা উঠেছে অন্য হোটেলে। কিন্তু কাজের সুবিধার জন্য আমাদের সঙ্গেই বেশিটা সময় কাটান।
দুপুরের খাওয়া যেহেতু হোটেল রুমেই আছে তাই সবারই হোটেলে ফেরার তাড়া দেখা গেল। কারণ দুপুর তখন দুটো গড়িয়ে গেছে।
বিকেলে আবার আলেকজান্দ্রা রোডে পিএসএ (Port Authority of Singapore) ভবনে যেতে হবে। সেখানে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কর্মসূচি রয়েছে।
হোটেলে ফিরতে আমাদের ১৫ মিনিটের বেশি সময় লাগল না।
ঢাকা থেকে শুনে গিয়েছিলাম সিঙ্গাপুরে এখন ভীষণ গরম। গিয়ে বুঝেছি, সব শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই। আমরা সিঙ্গাপুরে চমৎকার আবহাওয়া পেয়েছি। রৌদ্র মেঘের খেলা চলছিল। এই প্রখর সূর্য তাপ তো কিছুক্ষণ পর আবার একটু হালকা বৃষ্টি। আমরা সকাল থেকে যতোটুকু সময় ঘরের বাইরে ছিলাম ততোক্ষণ মেঘের লক্ষণ দেখিনি। হোটেলে ফিরলাম পরিষ্কার আকাশ দেখেই।
হোটেল রুমে গিয়ে দেখি টেবিলে দুটো বড়সড় প্যাকেট। বুঝলাম, ওতেই আমার এবং সঙ্গী মাগুরার সাংবাদিক শামীম খানের লাঞ্চ।
ঢাকায় বাইরে থেকে ঘরে ফিরে হাত-মুখে পানি না দিলে স্বস্তি পাওয়া যায় না। কারণ ঢাকায় এক ঘণ্টা বাইরে থাকলে মাটির দেহ ধুলোমাখা হয়ে যায়। কিন্তু সিঙ্গাপুরে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে ধুলা নিবারণ করা হয়েছে। মাটি যেটুকু দেখা যায় তা সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত। রাস্তায় ধুলা ওড়ে না। হোটেলে ফিরে তাই হাতেমুখে পানি দেওয়ার গরজ বোধ করলাম না। শুধু আমার জন্য চরম বিরক্তির গায়ের ব্লেজার এবং পায়ের জুতা তাড়াতাড়ি খুলে ফেললাম। ওহ! কয় ঘণ্টা ওসব পরে কি চাপের মধ্যেই না ছিলাম। জুতা পরলে আমার মনে হয়, কে যেন আমার পা শৃঙ্খলিত করেছে। শৃঙ্খলমুক্ত হয়ে আর কোনও দিকে না তাকিয়ে খাবার প্যাকেট খুলে বসলাম।
খাবার দেখে যে খুব খুশি হলাম তা কিন্তু নয়। একটি ভোমা সাইজের সরমা। পরিমাণে যথেষ্ট হলেও দুপুরে ভাত না খেলে আমার কেন যেন মনে হয় কিছুই খাওয়া হলো না।
ভাত আমার খুব প্রিয় খাদ্য। তবে গত কয়েক বছর ধরে শারীরিক কারণে ডাক্তারের পরামর্শে শুধু দুপুরেই অল্প দুমুঠো ভাত খাই।
সিঙ্গাপুরে সেটাও বন্ধ হলো! কিন্তু তখন আর বাইরে গিয়ে ভাতের খোঁজ করার কোনও উৎসাহ পেলাম না।
কোনও অস্বস্তি না রেখে অতোবড় একটা সরমার সদ্ব্যবহার করলাম। না, ভাতের অভাব বোধ হলো না। বিষয়টা যেন সেই ছোটবেলায় পড়া কবিতার একটি লাইনের মতো, ‘সেথা দেখি একজন পদ নাহি তার তার, অমনি জুতার খেদ খুঁচিলো আমার!’
যেটা নেই, সেটার জন্য খেদ পুষে না রাখলেই কোনও সমস্যা নেই।
সরমার সদ্গতি করে তারপর একটু চায়ের তেষ্টা অনুভব করলাম। আমি চা-খোর নই। তবে দিনে অন্তত দুকাপ চা না হলে কেমন যেন লাগে!
চা পান নিয়ে একটি মজার ঘটনা মনে পড়ল। সেই সত্তর দশকের শেষ দিকে একদিন প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক শওকত ওসমান এবং লেখক-সাংবাদিক আবু জাফর শামসুদ্দিনকে একটি অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পেয়েছিলাম আমি। তারা দুজন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের উল্টোদিকে কাছাকাছি বাসায় থাকতেন। প্রথমে শওকত ওসমানকে তার বাসা থেকে নিয়ে আবু জাফর শামসুদ্দিনের বাসায় গেলাম। আমাদের একটু বসতে বলে তিনি তৈরি হওয়ার জন্য ভেতরে গেলেন। বসতে না বসতেই আমাদের জন্য চা এল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শওকত ওসমান আমাকে বললেন, আচ্ছা বলো তো, চা খাইয়ে বাঙালি এটাকে আপ্যায়ন বলে কেন? একে তো বলা উচিত চাপ্যায়ন!
হ্যাঁ, এমন সরস কথাবার্তাই বলতেন শওকত ওসমান।
চা বানাতে গিয়ে মনে হলো, বিনে পয়সায় যখন খাবো তখন কফি থাকতে চা কেন? ব্যস, এক মগ কফি নিয়ে আরামসে দিলাম এক সুখচুমুক। আচ্ছা, তাহলে অতিথিকে কেউ কফি দিয়ে সমাদর করলে তার নাম কি দেওয়া হবে? কফ্যায়ন?
কফির মগ খালি করে একটু গড়িয়ে নেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু ঘড়ির কাটা যে ততোক্ষণে চারটা ছুঁয়ে ফেলেছে, সেটা বুঝতে পারিনি। চারটায় আমাদের নিচে নামার কথা সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটির কার্যালয়ের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মসূচি সেখানে সাড়ে পাঁচটায়। আমাদের যেতে হবে আগেই। শামীমকে তাগাদা দিয়ে নিজেও তৈরি হয়ে নিলাম।
সব কিছু নিয়ম মেনে হচ্ছে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। নিচে নেমে দেখি দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি। পড়ন্ত বিকেল। এবারও আমাদের সঙ্গী হলেন একাত্তর টিভির রূপা ফারজানা। বেচারা নিজস্ব উদ্যোগে নিউজ কভার করতে এসে বেশ খাটাখাটনি করছে। ভাল ধকল যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে। ক্যামেরাট্যামেরা বহন করা একটু শ্রমসাধ্য বৈকি! রূপা দেখলাম সব হাসিমুখেই করছে।
গন্তব্যে পৌঁছতে যে ১৫/২০ মিনিট সময় লাগে সে সময়টুকু কেটে যায় নানা রকম মজাদার গল্পসল্পের মধ্য দিয়ে। সবার ঝুড়িতে মজুদ আছে রসালো সব গল্প। কেউ একটা রিলিজ করলেই গাড়িশুদ্ধ কেঁপে ওঠে হাসির দমকে।
পিএসএ ভবনে পৌঁছে ভবনের শীর্ষে নজর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ওরে বাপ, কতো বড় বিল্ডিং! এরই ৪০ তলায় প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি একটু মেঘ জমেছে। আমরা লিফটে ৪০তলায় উঠেই দেখি বৃষ্টি পড়ছে। এতো উঁচু ভবনে আগে উঠিনি। ওপর থেকে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। যারা পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছেন, নানা আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান দেখেছেন তাদের কাছে সিঙ্গাপুরের সৌন্দর্য মনে না-ও ধরতে পারে! কিন্তু আমি তো কুয়োর ব্যাঙ। যা দেখি তাতেই ঘোর, তাতেই বিস্ময়!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথাসময়ে এসে পৌঁছলেন। এখানে নিরাপত্তার কড়াকড়ি একটু কম মনে হলো। প্রধানমন্ত্রীকে সভাস্থলে নিয়ে যাওয়ার আগে চারদিক ঘুরিয়ে দেখানো হলো। তিনি বেশ হাসিখুশি মুডেই ছিলেন। এবার আমাদের সুযোগ হলো তার বেশ কাছে যাওয়ার। মোবাইলে একটি ছবিও তুললাম। যদিও তার কাছাকাছি গিয়ে মোবাইল বের করতে বাধা দেন তার নিরাপত্তাদল।
আনুষ্ঠানিক সভাস্থলে আমরা সবাই যেতে পারব না বলা হলেও শেষপর্যন্ত সে সুযোগ পাওয়া গেল। সিঙ্গাপুর বন্দরের ওপর একটি সুন্দর প্রেজেন্টেশন দেওয়া হলো। একটি তথ্যচিত্র দেখানো হলো বন্দরের ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে ধরে। আমাদের কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের বন্দরগুলোর জন্য সহযোগিতা চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চমৎকারভাবে তার বক্তব্য দিলেন। সবশেষে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হলো। সিঙ্গাপুর বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের চট্টগ্রাম নৌবন্দর আধুনিকায়ন, দক্ষতা বৃদ্ধিসহ নানাভাবে কারিগরি ও অন্যান্য সহযোগিতা করবে।
সিঙ্গাপুর বন্দর বিশ্বের অন্যতম ট্রানজিট পয়েন্ট। আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় এই বন্দরের স্থান দ্বিতীয়। এই বন্দরে ৩০ হাজার শ্রমিক নিয়মিত কাজ করেন। মালামাল ওঠানো-নামানোর জন্য ২ হাজার ১০০ ক্রেন ব্যবহার করা হয়। সে এক মহাকর্মযজ্ঞ। শ্রমিকদের মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকও আছেন। তবে তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সংখ্যা জানতে পারিনি।
বন্দরের অনুষ্ঠান শেষে আমাদের আবার হোটেলে ফেরার পালা। আর কোনও কর্মসূচি না থাকায় সন্ধ্যায় যার যার মতো ঘোরাঘুরি করার কথা। কোথায় যাওয়া যায় এবং সঙ্গী হিসেবে কাকে পাওয়া যায় গাড়িতে বসে তাই ভাবছিলাম। হঠাৎ রূপা প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠল, সর্বনাশ, নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ইউএস বাংলার একটি যাত্রীবাহী বিমান দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। প্রাথমিকভাবে হতাহতের খবর নেই। তবে আশঙ্কা ব্যাপক প্রাণহানির। রূপা তার ফেসবুকে বা ফোনে এই প্রাথমিক খবরটি পেয়েছেন।
সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট নগর রাষ্ট্র। বর্তমানে জনসংখ্যা ৫৫ থেকে ৬০ লাখের মতো। ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট মালয় ফেডারেশন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সিঙ্গাপুর যখন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তখন এটি ছিল একটি জেলেপল্লী মাত্র। এই জেলে পল্লীসম দ্বীপ রাষ্ট্রটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ। তিনি তখন ছিলেন ২০ লাখ মানুষের নেতা। মূলত লি কুয়ানই হচ্ছেন আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধ সিঙ্গাপুরের স্রষ্টা। তার সুযোগ্য নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর মাত্র কয়েকবছরের মধ্যেই প্রথমে উন্নতশীল এবং বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে চলে আসে। লি কুয়ান ন্যায়সঙ্গত শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদী ধাঁচে সিঙ্গাপুরকে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি একজন শক্তিধর রাষ্ট্রনায়ক তথা সফল সরকার পরিচালক হিসেবে দুনিয়াজুড়েই পরিচিতি অর্জন করেছিলেন।
লি কুয়ান মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৫৯ সালে স্বায়ত্তশাসিত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। স্বাধীন সিঙ্গাপুরের যখন প্রধানমন্ত্রী হন তখন তার বয়স ৪২ বছর। তার সহকর্মীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী।
লি কুয়ান পরবর্তী সময়ে তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন: আমি তাদের সকলের চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলাম। তারপরেও তারা কখনও আমার কোনও কাজে বাধা দেননি। নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেননি। এমন কি আমি যখন কোনও ভুল করেছি, তখনও তারা আমার বিরোধিতা করেননি। তার সবসময় আমাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করতে সহায়তা করেছেন এবং আমার ভেতরে যেন মুই কি হনু রে ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আত্মম্ভরিতার প্রকাশ না ঘটে সে বিষয়ে সচেতন থেকেছেন। অর্থাৎ লি কুয়ানের সাফল্যের পেছনে একটি বড় কারণ তিনি একদল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাদের সমর্থন-সহযোগিতা তার পথ চলায় শক্তি যুগিয়েছিল।
শুধু কি তাই? লি কুয়ান সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বুঝেছিলেন, দেশের উন্নয়ন করতে হলে রাজনৈতিক স্থিরতা একটি জরুরি বিষয়। তিনি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য যে কোনও ধরনের কঠোরতা দেখাতে পিছপা হননি।
উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন তিনি। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্য শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বজায় রাখতে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণে কোনও দ্বিধা করেননি।
ইউরোপ-আমেরিকার মতো সিঙ্গাপুরে এতো মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদির চর্চা নেই। সেখানে গণতন্ত্রের নামে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হয় না কাউকে। বিশৃঙ্খলা কঠোর হাতে দমন করা হয়। সিঙ্গাপুরে রাজনৈতিক দল আছে অনেক। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একটি দলই শাসন ক্ষমতায় আছে। ভোটে নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতাসীন দল সরকার গঠন করে। বিরোধী দলের জনসমর্থন একেবারেই কম। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। পুরো নগর রাষ্ট্রটি কঠোর নিয়ম-নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত।
আইনের কড়াকড়ি সিঙ্গাপুরে প্রবল। আইন না মানা বা অমান্য করার সুযোগ কারও নেই। আইনের প্রশ্নে কারও কোনও ছাড় নেই। এখনও বেত্রাঘাত, মৃত্যুদণ্ডসহ কঠিন শাস্তি বহাল আছে। নিজেদের ভালমন্দের ব্যাপারে সিঙ্গাপুর পরদেশের পরামর্শ শোনে না, গ্রাহ্য করে না।
উন্নয়নের জন্য লি কুয়ান বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েও মানবাধিকার প্রশ্নে সমালোচিত হলেও শক্ত হাতে দেশ শাসনের নীতি থেকে তিনি পিছু হটেননি। বিরোধীদের ব্যাপারে তার উদারতা, সহনশীলতা ছিল কম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণবিক্ষোভ, মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি নিয়ে কাউকে খুব উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না। তারপরও সিঙ্গাপুরের মানুষ কেন সরকারবিরোধী নয়? এক দলকেই কেন বারবার ক্ষমতায় রাখা হচ্ছে? মানুষ কেন পরিবর্তন-প্রত্যাশী নয়?
অনেকেরই হয়তো জানা নেই যে একসময় সিঙ্গাপুরে মাত্র ১২০ টি জেলে পরিবার বাস করত। অথচ এখন সিঙ্গাপুর পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে। সিঙ্গাপুর যখন স্বাধীনতা পায় তখন সেখানে মাথাপিছু আয় ছিল ৫১১ মার্কিন ডলার। এখন মাথাপিছু গড় আয় প্রায় ৬২ হাজার মার্কিন ডলার। ২০১০ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৪.৫ শতাংশ। জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন এশিয়ায় প্রথম এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ১১তম। আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশ্বের মধ্যে সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন যথাক্রমে ১৫ এবং ১৪তম স্থানে। পরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে জীবনযাপনে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন। মানুষের মনোজগৎও হয়েছে পরিবর্তিত। মানুষের গড় আয়ু ৮০.৬ বছর। শিক্ষিতের হার ৯৬ শতাংশ। ৯০.১ শতাংশ নাগরিক আবাসন সুবিধা পেয়েছেন। প্রতি এক হাজার জনে ১০৭ জন ব্যক্তিগত গাড়ির মালিক। ভাবা যায়, আদিতে মাছ ধরা ছিল সেখানকার অধিবাসীদের একমাত্র পেশা!
সিঙ্গাপুরের এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের রূপকার ও কাণ্ডারি হলেন লি কুয়ান ইউ।
১৯২৩ সালে সিঙ্গাপুরে জন্ম নেওয়া লি কুয়ান যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ থেকে আইন শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন।
লি কুয়ান অল্প বয়সেই রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপলস অ্যাকশন পার্টির ( পিএপি) লি ছিলেন সহপ্রতিষ্ঠাতা। ৪০ বছর তিনি এই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৯ সালে বৃটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় আছে পিএপি।
লি কুয়ান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৩১ বছর। ১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। ততোদিনে তিনি সিঙ্গাপুরকে বিস্ময়করভাবে বদলে দিয়েছেন। অপরাধ ও দারিদ্র্যপীড়িত একটি বন্দর শহরকে এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা খুব সহজ কাজ ছিল না।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ প্রবন্ধ বিভুরঞ্জন সরকার যা দেখি তাতেই ঘোর- তাতেই বিস্ময় সাংবাদিকতা সাহিত্য