রাষ্ট্রীয় দোলনায়
২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২১:২৩
এক.
এইমাত্র চলে গেল দুপুরের ট্রেন ক্লান্ত দুলুনিতে। মাত্রই শোনা হলো চড়ুইলিপি আততায়ী জবানিতে। ভ্রান্তির চিটাধান দেখে হয়রান চোখ বিঁধে আছে সুডৌল স্তনে। যেমন বিঁধে থাকে জোলি আর জুলেখা। পাথরটা পকেটেই আছে। এতেও কি আছে সেই আগুনের বাস?
একটু আগের আকাশে উড়েছিল জোড়চিল। একটু আগেই ছিল ভ্রুণহীন কাল। তারপর শুধু জাবেদা খতিয়ান। তারপর ফ্যাক্টরি-ইঞ্জিনের গাঢ় ওম। শুমারির ফাঁক গলে তবুও বাঁচে মানুষ। গাছের পৃষ্ঠার নিচে চাপা থাকে যাপনের হদিস। কাকটা ন্যাঙটা বলে তাকে আর গাল দেয় কে! বরং নিজের ছায়ারে পরাও বারোয়ারি সাজ-রং, কিম্ভুত কস্টিউম।
শেষ বাসের সাথে পাল্লা দিয়ে যে শিশুটি ছুটছে। আদতে সে সকালকে ছুঁতে চাইছে বিস্তীর্ণ দু’হাতে। যেন একটা ফুটবল। খেলবে সে দিনরাত একমনে। আর চিৎকার দিয়ে একটু পরপর বলে উঠবে- ‘কাউরে নিমু না।’ এ তো ইরাবতী নদীর তীরে সেই রাজার জবান। নাকি ওই মাহুতের, যে উড়ে গেছে অভিমানে ঐরাবতের সাথে।
দুই.
এই যেমন অহেতুক ছুটি নেমে এল শহরে-মহল্লায় আর মগজে, যেমন খেলা হচ্ছে শঙ্কার ষোলোগুটি। তাতে মাছরাঙার কী আসে যায়? আমি তো বলেছি এ কেবল তন্ত্রের মোড়কে শতকিয়া বাটোয়ারার। ক্যাপিটাল পরম্পরা, জাল বা জঞ্জাল। ভান বা ভ্রান্তির অদৃশ্য সূতোয় তার সুনিপুন সঞ্চার।
রোদহীন দিন দেখে কারে দাও গালি? এপারে যেমন এখন, ওপারেও তাই ছিল। প্রাক্তন পাটাতন দেবে এই অকাট্য প্রমাণ। থেকে যাবে এমনই জেনো যতদিন বাঁচবে এ ঘুম। কোথাও মানুষ নেই, নেই মাছরাঙা। এ যেন পুরাণ-নদী এক, দুপাশে মাংসাশী দানো আর মাঝখানে বলদকুল, আমরা যেমন, দৌড় পাড়ি, খাবি খাই, পেছনে পিরানহা অথবা এমন…।
কী দারুণ লাগছে না বলো? দু’দলই নেমেছে গণতন্ত্রের সুরক্ষায়। গণ পড়ে আছে ডিসেকশন টেবিলে আমাদের মতো আর তন্ত্রের ছুরিতে ধার দিচ্ছে চতুর মহাজনেরা। আমরাতো নাবাল, চেয়ে আছি কেলো হেসে…।
তিন.
আরেকটা পিঙ্গল ফড়িং উড়ে গেল মাথার পেছন দিয়ে। আরেকটা ড্রোন। সীথানে লুটিয়ে যে হরিণ কাঁদে, সে তো চায়নি কখনও তোমার বেষ্টনি। নিরাপত্তার নামে কোনো সিসি ক্যামেরা।
কসাইখানায় ছাল ছাড়ানোর আগে বাছুরটার সাথে ছুরিটার কী কথা হয়? তোমার টেকসই আয়নায় সে কথা অনুক্ত থেকে যায়।
চার.
ইদানীং গণতন্ত্রের সাথে দেখা হলেই পাশ কাটিয়ে যাই। এই সেদিন মাত্র তিন হাত দূরে দাঁড়িয়েছিল সে, উল্লসিত ঢঙে কাছে যেতে ডাকছিল। তাড়া ছিল বলে ছুঁয়ে দেখা হলো না। ইদানীং মাঝ দুপুরেই শ্বাপদের শ্বাস শুনি, নখের আঁচড়। ইদানীং বড় রেস্তোরাঁর বাইরে ঘুর্ণায়মান গ্রিল চিকেন দেখলেই মানুষের কথা মনে পড়ে খুব। এমনকি নিজেকেও। এমনকি গণতন্ত্র।
লোকাল বাসে ঠেলেঠুলে উঠে একটা সিট পেলেই সিংহাসনে আরোহণের আনন্দ হয়। মনে হয় বেশ আছি আজকাল। যেখানেই বসি মসনদ হয়ে যায়, ঘুমাই যেখানেই হয়ে ওঠে রাজপালঙ্ক। এমনকি আমার উন্মুক্ত মাথাতেও মাঝে মাঝে মুকুটের স্পর্শ পাই।
বড়, মেঝ, সেঝ গণতন্ত্র নিয়ে চলে দারুণ বাকোয়াজ। চ্যানেলওয়ালারা জানে না আদতে আমিই মধ্যমণি। কী মুর্খ অকাট।
আমি ঘুমাবো বলেই না এমন বারুদের বিছানা। আমাকে বাঁচাতেই তো এই সশস্ত্র প্রহরা।
পাঁচ.
এইবার হবে ঠিক এপার-ওপার। জ্যাম ঠেলে বাসগুলো পারে এসে ঝিমুবে না আর। সটান চলে যাবে তোমার মতন দাম্ভিক বাতাস ছড়িয়ে। মদের গেলাস আগলে তখন আমি বরাবরের মতোই গুনবো পদচিহ্ন। কতটুকু যাওয়া হলো, আর কত বাকি?
পৃথিবীর সাথে আমার সম্বন্ধ চড়ুইয়ের মতো, আছি, থাকি, নিকটতম দূরত্বে। তবুও সবার প্রতীক্ষায় শুধু কোকিল-সময়। বিকাল হলে রোদ পকেটে নিয়ে ঘুমুতে যাই। একটু ওম লাগে। ছায়ার সাথে কাটাকুটি খেলে হাতব্যাথা আজ তিনদিন। কেউ খোঁজ রাখেনি তবু। কেবল ওবামা বলেছে, কিছু বিচ্ছিন্নতা দিয়ে তাহাদের বিচার করা ঠিক না।
আমি তো মোমিন নই, না কোনো মাতাল। তবুও চরদের ডায়েরিজুড়ে কেবল আমারই সফরনামা। রাত নির্জন হলে ধুলোদের পাশে বসিয়ে তোমার পদচিহ্নগুলো মাপি আর ঠা ঠা করে হাসি। এই দেখে রাষ্ট্রের চোখে ঘুম নেই। নিজের মোহন বোমা খুঁজতে এরা আমার পকেট সার্চ করে।
ছয়.
এমন বিষন্ন বিষ হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখতে হয়। জানি এ অমোঘের অকাট্য আলাপ। যে রাস্তার পিঠে গাড়িরা ঘুমায় অপ্রতিহত জটবাঁধা চুলের মতো, সে পথে ফেলে এসেছি তাড়িত পায়ের ছাপ, অস্থির সাইরেন।
ঘুরে ঘুরে আসি সেই একই নিমগ্ন কানাগলিতে আমার। অন্ধকার সয়ে এলে এখানে লাফিয়ে ওঠে লুকোনো উঠোন। কেউ তার জানে না হদিস। আমিই জেনেছি শুধু এ মাটির মানচিত্র, জেনেছি তার দশটি আঙুল। অবিকল হাতের মতো সেখানে খোদিত গাছ, চৈত্রের গন্ধ চিনে দেয় চিকন বাতাস। তারপর… তারপর শুধু শ্বাসের সিম্ফনি, তারপর বিষের বিচ্যুতি।
কিন্তু সবদিন এমন নয়। কিছু রোদপোড়া বতাস আছে, যার তোড়ে দশ আঙুল ছুটে যায় দশদিক। আমি দাঁড়িয়ে থাকি, ছিন্ন পুঁতির মতো। বিপন্ন বেখেয়ালি হাতে বিষন্ন বিষ। সেও স্থির আমারই মতো। ফুরোয় না, অচঞ্চল ডেকে চলে আয় আয় আয়।
সাত.
বাতিল রুমালের ইতিহাস থেকে কতটা দূরে ওই ঝাড়বাতি? মানুষের ডানা নাই বলে দালানেরা আকাশচুম্বি। তবুও থাকে অধরা আকাশ। কোনো উড়ালপথই থামে না ওই আকাশের ঠিকানায়।
বলছিলাম বাতিল রুমালের কথা অথবা কিছু নোনতা অতীত। তার আগে সেই নদীর কথা বলা যাক, যেখানে এসে দুর্বিনীত হয়ে উঠেছে জোকারের প্রলম্ব নাক। হালহীন ভেলায় চড়ে চলে যাচ্ছে যৌথবাসের সমস্ত প্রয়াস।
বরং সেই ভেলাটার কথা বলি। যার পিঠে আমাদের তাবৎ তত্ত্ব-তালাশ, হয়েছে সওয়ার অহেতুক স্থিতির প্রবঞ্চনায়। স্থিতির হাত থেকে ঝুলে আছে প্রাক্তন মেডেল, আমাদের কালি-ঝুলি, খুনতির দীর্ঘশ্বাস। স্থিতির ডানদিকে কসাইর আড়ৎ, বামে তার ঘড়ির কাটা ছক। পরিক্রমণ শুধু পরিক্রমণ। যেন একটা লাটিম, মেনে চলছে অপ্রতিহত সেই সুতার নির্দেশনামা।
রুমালের কথা বলতে গিয়ে আর ভেলাটার কথা বলব না। কিংবা ওই নদী বা জোকার। অথবা নিরঙ্কুশ হয়ে থাকা সময় কাঁটার নিন্দানামা। জানি এইসব জমে থাকা তপ্ত বরফ গলে গেলে প্রকাশে আসে যে প্রগাঢ় কোলাহল, তার ভিতরেও পা দোলায় সেই নচ্ছাড় ক্লান্তিকর পেন্ডুলাম।
আট.
সময়ের হিসাব মেলানোর আগে আমি বরং কাগজের জামায় ঢেকে দেব পুতুল শরীর। অবরোধ চিরে বিয়ের সাইরেন বাজিয়ে আসবে যে অ্যাম্বুলেন্স, তাতে বেঁধে দেব সাদা-দুটি বেলুন শুধু মৃতদের স্মরণে। তুমি দুলতে থাকো কুটিল পেণ্ডুলাম। তুমি বাজতে থাকো টিক-টিক-টিক…।
চলতে থাকো নিজের মতো ও আমার ঘোলাটে পৃথিবীর একাগ্র আহ্নিক। ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছে ছুটতে ছুটতে নিজের শ্বাসটুকু আমি মিশিয়ে দেব সমুদ্র বাতাসে। হাতের চেটোতে আমারও আছে অজস্র রেখার গল্প। সেখানে বাঘের দিনের সাথে মিশে রোজ কুসুম-সন্ধ্যা। তোমার ও গোধূলী রঙের কাছে আর কিছু চাওয়ার নেই।
সময়ের হিসাব মেলানোর বদলে আমি জাদুকর হবো আবার। শূন্য বোঝা নিয়ে পুরোটা দুপুর ডেকে যাব ‘সিট কাপুড় এই সিট কাপুড়’, সবিশেষ বাঞ্চনাহীন। তুমি ছোটো, ছুটুক তোমার ঘোড়া। রোজ এসে কপট পসরায় নেড়ে যাব আমি দরজা তোমার। তুমি থমকাবে, ফিরে যাবে, দুলবে আবার, অবিরাম চলবে তোমার টিক, টিক, টিক… তোমার প্রতি এ হলো আমার নিষ্ঠুর অনুকম্পার খেলা।
নয়.
শিরোস্ত্রানের পাশেই রেখো ছোট শাদা ঘাসফুল। অঢেল বৈভব বড় বেশি নিসঙ্গ। যতটা মেঘ আকাশে মানায় ততটাতো দেখি না বহুদিন। এখন ধুলো-কাল। আকাশগামী সড়কের খুঁটিগুলো শুষে নিচ্ছে মেঘমুগ্ধতার বিস্তৃতি।
যে লাইটপোস্টের নিচে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে বাদাম খাও, সে গতকাল মারা গেছে। একটা আততায়ী বাস নাকি মাতাল হয়ে ঢুকে পড়েছিল হর্ন না বাজিয়েই। আজ সেখানে হুজ্জত খুব। আজ সেখানে ছিপিখোলা রোদ্দুর।
তোমার ঘুমপাড়ানি বড়ির পাশেই রেখে দিয়েছি এক মোহন চাকু। কোন ঘুম বেছে নেবে, ভাব আরেকবার। শুধু ব্যহত রাতের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ো না আর।
যতটা নৈঃশব্দ মানায় ওই নেড়িকুত্তার লেজে, তার চেয়ে ঢের জমা আছে ওই পাঁচিলের গায়। অবোধ যাপনের কাছে আমার কোনো দায় নেই। চাইলে খেয়ে নিতে পার এক দাগ নৈঃশব্দ-সিরাপ। শুধু মনে করে, ছেঁড়া জামাটার পাশেও রেখো ছোট-শাদা ঘাসফুল।
দশ.
দ্বিচারী আলোর ধারে কেট না যৌথনিবাস। এখনও অঢেল বাকি। মোছেনি এখনও ওই নদীর টেবিল। এসো তাসগুলো তুলে নাও আবার। আসো খেলি জীবন মিলান্তিস।
যেখানে ক্লান্তির নিবাসে রোজ চুরি হয় মেঘের মোড়ক, সেখানে যাব না আর। অনেক তো দেখা হলো ধনুকের দিন, পাখাদের সঞ্চারণ। এখন ঘেরাটোপ থেকে নেমে এসো তুমি। পথে এঁকে দাও গচ্ছিত ঘামের তীলক।
নিদাঘের জমিনেই জমা থাকে জলজ নির্যাস। সেখানে ফলাও তোমার আয়ুধীন চলিষ্ণু ফসল। ব্যহত রোদের নিচে এই ছায়ার সঞ্চার থেমে যাবে।
ক্লান্ত পায়ের চাপে ভেঙ না আর যাপনের বাদাম। বরং মেলে ধর কোচড়ের ফুল। বরং শুঁকে দেখ রক্তকুচের ঘ্রাণ। অহেতুক ব্যথার ভারে ভেঙ না বাদাম। ফেরিওয়ালার সবুজ ডালায় শুধু চোখ রাখ। উবে যাবে জীবনের তাবৎ হরতাল।
এগারো.
তোমার চোখের ভিতরেই আছে সেই কানাগলি, যেখানে দিনশেষে পথিকেরা ভোলে সাইরেন সময়। অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে যতগুলো বরযাত্রী গেল, তারা সব পুলিশভ্যানের জন্য অপেক্ষা করছে শেষে। তার থেকে কিছু দূরে নেড়া গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আমি কানুর চরিত্রে অভিনয় করছি। এখন আর কদম গাছ কই। তবু বেসুর বাঁশির ডাকে আমি রাধা নয় তোমাকেই ডাকছি বারবার।
পুলিশেরা একটু আগেও তামাশা করেছে খুব। বরের পাজামার গিঁট খুলে দেখছে অসুস্থতা। আমি পেয়ে গেছি নিরালম্ব নিস্তার। এখন ভালোয় ভালোয় তোমার গলিটা এলেই হয়। কানুর অভিনয় ছেড়ে ঢুকে যাব তোমার গোয়ালে।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ নেলসন নেলসনের মুক্তগদ্য 'রাষ্ট্রীয় দোলনায়' মুক্তগদ্য রাষ্ট্রীয় দোলনায়