কবিতাগুচ্ছ
২৪ এপ্রিল ২০২৩ ২১:২৬
জন্মান্ধের আইফেল টাওয়ার
ক্ষেত মাঠজুড়ে এখন মানুষের বসতঘর।
অথচ এখানে থাকার কথা ছিল শর্ষে ফুলের বাড়ি-
ধান আর বাতাসের গানের খোলা বারান্দা
টমেটো, বিট, গাজর বাঁধাকপিদের অভয়াশ্রম।
কিন্তু এখানে দৈত্যের মতো দাঁত কেলিয়ে
হাসছে মানুষের ঘরবাড়ি। প্রাচীন গল্পে যেমন
রাজার সবকিছু সোনা হয়ে যাচ্ছিল, এমনকি খাবারসহ
তার খাবারের প্লেট, আর এখন সবকিছু বাড়ি, ইন্ডাস্ট্রি
শপিংমল হয়ে গেলে সেই রাজার মতো আমাদেরও
না খেয়ে থাকতে হবে। রাখতে হবে আজীবন দীর্ঘ
এক রোজা। রাজার মতোই চাইতে হবে সব আবার
ফিরে পাওয়ার বর। ছোট্ট টুনটুনি- সেও হারিয়েছে ঘর।
কেননা গাছ কাটা হয়ে গেছে। গাছের চোখে অশ্রু নদী।
তুমি একটা পাখি হতে যদি বা একটা গাছ বা মৌমাছি
তাহলে এই নগরায়নের ষড়যন্ত্রের ম্যাপ ভাঁজ করে
হয়তো একটা ছোট্ট নৌকা বানিয়ে ছেড়ে দিতে
বৃষ্টি জমা জলে। আর তোমার চোখকে দিতে আকাশ
দেখার অধিকার। কিছুদিন পরে এই আকাশ হবে
পূর্বপুরুষের ধারণা মাত্র। জানালা দিয়ে অন্য বাড়ির
জানালার গ্লাসে যে প্রতিফলন দেখা যাবে,
আকাশের দৈর্ঘ্য হবে ঠিক ততোটুকু। আর চোখ
কখনও দিগন্ত দেখতে পাবে না। তাই চোখে পরে নিই
জন্মান্ধের চশমা। যে চশমা পরলে শর্ষে ক্ষেতকে
আবাসিক প্রকল্প মনে হয় আর গরু ছাগলের
চারণভূমিকে মনে হয় আইফেল টাওয়ার।
অগ্নিকুন্ডের অক্ষর
কিছুই করি না তবু একটু একটু এগোই।
দীর্ঘক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি
কিছু দূর এগিয়ে গেছে কচ্ছপ
সবুজ গ্রামের পথে। হাল ছেড়ে মাঝ সাগরে
জেলে দেখে অদ্ভুত তারা খসার দৃশ্য।
যেমন একটা নকশিকাঁথা সেলাই করতে করতে
পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শতবর্ষী বৃদ্ধা,
কিংবা খাবার খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ে
নির্বাক শিশু, তেমন আনমনে হারিয়ে যাই।
পথ খুঁজে ফিরে আসে বিড়াল
দিগন্তের আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। কিন্তু তুমি থাকলে
হয়তো সবকিছু অন্যভাবে ঘটতো। মহাকাশেও
ফুটে থাকতো বসন্তকাল। একটা কবিতা হয়তো
এভাবেই লেখা হয়, কিছু অক্ষর কুড়িয়ে
কিছু শব্দ যোগ করে। তাই করে যাই-
দীর্ঘক্ষণ পর তাকিয়ে দেখি
কিছু দূর এগিয়ে গেছে কচ্ছপ।
কিছু দূর এগিয়ে আসি আমিও
অগ্নিকুন্ডের অক্ষর দিয়ে লেখা কবিতা ছেড়ে।
হাসিমুখের ভাস্কর্য
এখন কাউকে কেমন আছো জিজ্ঞেস করতে ভয় লাগে। কারণ সে হয়তো তার যাবতীয় সমস্যা ও ক্ষয়ক্ষতির প্রদর্শনী শুরু করে দেবে। অথচ কেমন আছো বলাটা আমাদের কালচারে একটা নর্মাল ভদ্রতা। মাঝে মাঝে ভাবি, এই ভদ্রতা থেকে বাইর হতে হবে। কিন্তু অনেক সময় আবার এই ভদ্রতার কাছে ফিরে যাই পুরনো অভ্যাসে। যেমন নদী তীরে আচমকা ফিরে আসে পুরনো বাতাস। তখন পরম যত্নে ক্ষয়ক্ষতির পসরা নিয়ে বসে মানব সমাজ। আর আমাকে মুখে মৃদু হাসি ধরে রেখে দীর্ঘক্ষণ এসব শুনতে হয়। শুনে সেই বেদনায় মমতার হাত বোলাতে হয়। অথচ আমার নিজেরই ভেতরে আছে কিছু অমূল্য ক্ষত। অন্ধকার বনপথে দিক হারালে তারাই পথ দেখায় আকাশ ভরা তারা হয়ে। তাই চারিপাশে এতো ক্ষতের প্রদর্শনী দেখতে দেখতে আতঙ্কে থাকি, কেমন আছো বলার সাথে সাথে সে হয়তো খুলে বসবে তার আহাজারি আর গুমোট কান্নার দোকান। মানুষকে জিজ্ঞেস করলে কেমন আছো, তারা হৃদয় খুঁড়ে বের করে সাপুড়িয়ার ঝুড়ি, যে ঝুড়ি ভর্তি চিটিং, বঞ্চনা আর ভোগান্তির সাপ। ইদানিং তাই মানুষ থেকে বরং গাছ বা প্রজাপতি হওয়ার সাধনা করি। কিংবা রংধনুর সমুদ্র তরঙ্গ। মহাশূণ্যে বেদনা মন্থন করে যারা বানায় অগুনতি হাসিমুখের ভাস্কর্য।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ কবিতা কবিতাগুচ্ছ লুবনা চর্যা লুবনা চর্যার 'কবিতাগুচ্ছ' সাহিত্য