কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা [ষষ্ঠ পর্ব]
২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৪:১৬
[ষষ্ঠ পর্ব]
রাত গভীর।
সারাদিনে অনেক পরিশ্রম করেছে সাদা-কালো কুকুর। সাত আটটা বাড়িতে অভিযান চালিয়ে একটু ক্লান্ত। ক্লান্ত হলেও খুব তৃপ্তি পাচ্ছে সাদা-কালো কুকুরটা। আমপুরা গলিটা প্রায় দখলে আনা গেছে। আর মাত্র কয়েকটা বাড়ি দখলে আনা বাকি। কুকুরদের পরিকল্পনা পরিষ্কার― বৈধ কোনোও বাড়ি কুকুরেরা দখলে নেয় না। দখলে নেয়, মানুষের দখল করা বাড়ি। সেই সূত্রে আমপুরার এই গলি প্রায় নিজেদের দখলে। পৃথিবীতে হতে যাচ্ছে, প্রথম কুকুরের গলি।
সাদা-কালো কুকুর পরিকল্পনা করছে, কুকুরের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। যার শুরুটা হলো ঠাডা শহরের আমপুরার এই গলিটা থেকে। দলের কয়েক জনের সঙ্গে পরিকল্পনা সর্ম্পকে কথা হয়েছে। কয়েকটা কুকুরতো দারুণ সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু কয়েকটা কুকুর সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
লেজকাটা কুকুরটা বলেছে, মানুষেরা ছাড়বে কেনো? ওরা খুব নিষ্ঠুর। কুকুরদের এমনিতেই ঘৃণা করে। আমরা দখল করতে গেলে গুলির পর গুলি করে মেরে ফেলবে।
পৃথিবীতে এখন কয়েককোটি কুকুর― প্রতিবাদ করে ডান পা ভাঙ্গা কুকুর। আমরা একত্র হতে পারলে, পৃথিবীতে একটা কুকুররাষ্ট্র করা সম্ভব।
মানুষ কোনোওভাবেই কুকুরের রাষ্ট্র তৈরী করতে দেবে না, কাটা লেজটা মাটিতে ঘষা দিতে দিতে বলে লেজকাটা কুকুর, মানুষের অমানুষিকতা দেখেছ?
বৈঠকের সব কুকুর তাকায় লেজকাটা কুকুরটার দিকে। সাদা-কালো কুকুরটা প্রশ্ন করে, মানুষের আবার অমানুষিকতা কি?
মানুষের অমানুষিকতা তো এক দুই ঘন্টায় বলা যাবে না, বললে কয়েক দিন রাত লাগবে। যেমন ধরো, মানুষের দুনিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব চেয়ে মানবিক রাষ্ট্র বলে বিবেচিত। কিন্তু সেই রাষ্ট্রে কালো মানুষদের উপর সাদারা নিপীড়ন চালিয়ে দাস বানিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। এখনও, যখনই সময় পায়, সুযোগ পায় কালোদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাদারা। নির্মমভাবে হত্যা করে কালো মানুষদের। দুনিয়ায় যতো রকমের রাষ্ট্রবিরোধী কাজ আছে, আছে গুম হত্যা, পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং গোপন সংস্থা সিআইএ। এশিয়ায় বাংলাদেশ নামক একটা দেশের মানুষেরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, প্রাণ দিয়েছে ত্রিশ লাখ মানুষ, মা বোনেরা সম্ভ্রম হারিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে, কোনোও রাষ্ট্র দাঁড়ায়নি নির্যাতিত নিপীড়িত বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনে, ন্যায়ের পক্ষে। উপরন্তু সৌদি বাদশা বলেছে, পাকিস্তান আমার ভাই। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনোও ব্যবস্থা নিলে, সৌদি আরব মনে করবে, সৌদি আরবের বিরুদ্ধেই নেওয়া হচ্ছে। নাইজেরিয়া নামে একটি দেশে আছে― বোকো হারাম নামে একটি দেশের একটি জংগী সংগঠন প্রতিদিন নিজের দেশের মানুষদের হত্যা করছে। ভারত বলে বড় একটি দেশ আছে, সেই দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। গরুর মাংস খাওয়ার কারণে একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের কুপিয়ে পিটিয়ে মারছে। ইয়েমেন নামে একটি দেশে প্রতিবেশী সৌদি আরব প্রতিদিন টনকে টন বোমা মেরে হাজার হাজার নারী পুরুষ শিশু হত্যা করছে। আফগানিস্থানে, ইরাকে নিজেদের দেশের মানুষদের উপর আত্মঘাতি বোমা হামলা করে নিরাপরাধ হাজার হাজার মানুষ হত্যা করছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শত শত শিশু বলাৎকারের শিকার হচ্ছে। এই হচ্ছে মানুষের দুনিয়ায় মানুষের কারবার। সেই মানুষেরা কুকুর মানে আমাদের জন্য জায়গা ছাড়বে? যারা নিজেদেরই ছাড় দেয় না― ভাই ছাড় দেয় না বোনকে, সন্তান ছাড় দেয় না পিতামাতাকে… সেখানে আমাদেরকে তারা ছাড়বে ভেবেছ?
তুমি খুব জ্ঞানী কুকুর― আমরা জানি, বাড়ির সোফার উপর শরীর হেলে দিয়ে আস্তে আস্তে বলে সাদা কালো কুকুর; ওদের সর্ম্পকে অনেক পড়াশুনা করেছো। তোমার জ্ঞান ভবিষ্যতে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে লাগবে। কিন্তু তুমি এতক্ষণ যা বললে, ওটাতো মানুষদের নিজস্ব ঘটনা। আমাদের তো নয়―
আমি বলতে চাইছি, যে মানুষ নিজেদের ছাড় দেয় না মতের বা স্বার্থের সামান্য ভিন্নতার কারণে, সেই মানুষেরা কুকুরদের ছাড় দেবে? আবার অধিকাংশ মানুষ কুকুরদের ঘৃণা করে অপরিসীম।
মি. লেজকাটা কুকুর ভাই, আপনার বক্তব্য শুনলাম― তেতে ওঠে লাল কুকুর। লাল কুকুরেরা পুলিশ কুকুর। বৈঠকে উপস্থিত লাল কুকুর পুলিশ কুকুরের আইজি। আমাদের সামনে মোক্ষম সুযোগ এসেছে একটা গলি দখল করার। আমাদের নেতা সাদা-কালো কুকুর যা বলছেন, সেটাই আপাতত শোনেন। পরেরটা পরে দেখা যাবে। কি বলেন আপনারা?
সাদা-কালো কুকুরের ড্রয়িংরুমে উপস্থিত কুকুরেরা সমর্থন জানায়। শেষ রাতের দিকে ভোজন শেষে যার যার কাজে চলে যায় কুকুরেরা। সাদা কালো কুকুর ঘুমিয়ে পড়ে কুন্ডলী পাকিয়ে সোফার উপর। সকালে ঘুম ভাঙ্গে সাদা-কালো কুকুরের প্রহরী কুকুরের ডাকে।
কি ঘটনা?
আপনার সঙ্গে একজন মানুষ দেখা করতে এসেছে।
সাদা-কালো কুকুর অবাক তাকায়, তুমি ঠিক বলছ? আমার সঙ্গে মানুষ দেখা করতে এসেছে?
জি জনাব, একজন মানুষ। আমাকে বলল, আপনার সঙ্গে জরুরী গোপন পরামর্শ আছে।
একটু সময় ভাবে সাদা-কালো কুকুর, ঠিক আছে আসতে দাও। আর তোমারা প্রস্তত হয়ে আশেপাশেই থেকো। মানুষ তো, বিশ্বাস করা যায় না।
ওকে জনাব, চলে যায় প্রহরী কুকুর। কিন্তু সাদা-কালো কুকুর চিন্তিত। এই সময়ে কোনোও মানুষের দেখা করতে আসা মানেই কোনও অশুভ বার্তা। ভাবনার মধ্যে একজন মানুষ এসে দাঁড়ায় সামনে। মাথায় কালো লম্বা টুপি। শরীরেও আজানুলম্বিত কালো কোট। চোখে সুরমা। সামনের দাঁতগুলো একটু একটু ফাঁক। আঁকারে ছোট খাট গড়নের মানুষটি বলে, আমার নাম মি. খোন্দকার মোশতাক।
জি বলুন―
আমি মি. দিগ্বিজয় রায়ের প্রধান সাগরেদ। উনি আমাকে খুব বিশ্বাস করে। অনেক গোপন খবর আমি আপনাদের দিতে পারি।
সাদা-কালো কুকুর নড়ে চড়ে বসে, তাকায় মি. খোন্দকার মোশতাকের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে― ভালো খবর। বসুন আপনি।
সামনের চেয়ারে বসে মি. খোন্দকার মোশতাক, আমার কাছে ভয়ানক খবর আছে। খুবই গোপনীয়―
বলুন আপনার গোপনীয় খবর!
আমি অতীব জরুরী গোপন খবর দিলে বিনিময়ে কি পাবো?
আপনি কি চান?
দিগ্বিজয় রায়ের বাড়িটা দখল করার পর অর্ধেক আমাকে দেবেন।
যদি না দেই?
আমি গোপন খবর বলবো না।
কি ধরনের গোপন সংবাদ আপনি দেবেন মি. খোন্দকার মোশতাক, কিংবা আপনি যে খবর দেবেন, সেই খবর আমরা জেনে গেলে তো আপনার প্রয়োজন নেই।
আমি নিশ্চিত, দিগ্বিজয় রায়ের যে গোপন সংবাদ আমি আপনাকে দেব, সেই খবর আমি, দিগ্বিজয় রায় ছাড়া কেউ জানে না। কিন্তু আপনাদের জানা জরুরি। কারণ, আপনারা যখন আগামী শনিবার দিগ্বিজয় রায়ের বাড়ি যাবেন, ঠিক সেই সময়ে বিমানে প্যারাসুটে নেমে আসবে একদল কমান্ডো বাড়ির ছাদে―
সাদা-কালো কুকুর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে আছে মি. খোন্দকার মোশতাকের দিকে, কমান্ডোর খবর তো জানা ছিল না। লোকটাকে আপাতত দলে নেয়া যেতে পারে।
আপনারা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গেলেই বিমানে বসে ওরা আপনাদের উপর মেশিনগানের গুলি ছুঁড়বে। অনেক উপর থেকে গুলি ছুঁড়বে, আপনারা ঝাঁকে ঝাঁকে মারা যাবেন।
মাথা নাড়ায় সাদা-কালো কুকুর, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই চমকপ্রদ গোপন তথ্য পাচার করার জন্য। আমি আমার সঙ্গীদের সঙ্গে আলাপ করে আপনার চাহিদা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আপনাকে ফোনে জানিয়ে দেওয়া হবে কেমন?
অনেক ধন্যবাদ, দাঁড়ায় মি. খোন্দকার মোশতাক হাতজোড় করে, আপনি কি বুঝতে পারছেন মহামান্য, আমি কতোবড় ঝুঁকি নিয়েছি?
দুই গালে শব্দ করে হাসে সাদা-কালো কুকুর, আমি বুঝতে পেরেছি। মনে রাখবেন, আমরা কুকুর। একবার যদি কারও বাড়িতে অন্নগ্রহণ করে থাকি, সারা জীবন অন্নদাতার সঙ্গে থাকি। যদি কারও উপকার গ্রহণ করে থাকি, সেই উপকারীকে চিরকাল মনে রাখি। আমি নিশ্চিত, আমার সঙ্গীরা আপনার ঝুঁকির পুরষ্কার বিবেচনা করবে সততা ও ন্যায়ের সঙ্গে। আপনি আসুন।
অনেক ধন্যবাদ, আশ্বস্ত হলাম আর কি! আবারও হাতজোড় করে শ্রদ্ধা জানিয়ে দ্রুত চলে যায় মি. খোন্দকার মোশতাক। মি. খোন্দকার মোশতাকের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে সাদা-কালো কুকুর, মানুষের মধ্যে প্রচুর মীরজাফর থাকে। যেমন ছিল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর পাড়ে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজের সঙ্গে আপন খালু প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খান যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মধ্যে দিয়ে যে প্রতারণার ইতিহাস রচনা করেছে, বিস্ময়কর।উনিশশো একাত্তর সালে বাংলাদেশ নামে রাষ্ট্রের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মাতৃভূমির বিরুদ্ধে প্রচুর বাঙালি যুদ্ধ করেছে, পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষ নিয়ে নিজ দেশের অজস্র মানুষ হত্যা করেছে। রাজাকার আলবদর বাহিনী গঠন করে নিজের দেশের মানুষ, প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয়, শিক্ষকদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
সেই মানুষের একজন প্রতিনিধি মি. খোন্দকার মোশতাক! বিশ্বাসঘাতকের এমন নাম কি আগেও কারও ছিলো! সাদা-কালো কুকুরের মুখে মৃদু কিন্তু রহস্যপূর্ণ হাসির ঝলক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ উপন্যাস কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা মনি হায়দার মনি হায়দারের উপন্যাস ‘কুকুরের দখলে আমাদের গলিটা’ সাহিত্য