যখন এসেছিলে অন্ধকারে
২৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:২১
আজকের সকালটা একদমই অন্যরকম। একপা দু’পা করে শীত এগিয়ে আসছে। কুয়াশার পর্দাটা এখনও ফিনফিনে হলেও সকালের এই সময়টাতে এক ধরণের আরামদায়ক আলস্য জড়িয়ে ধরে। চায়ের মগ হাতে বাগান বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাবছিল হৃদিতা। বাগানের টবে লাগানো শিউলি গাছে এবারই প্রথম ফুল এসেছে। ফুটতে শুরু করেছে হেমন্তের শেষদিকে। রাতে ফোটা কয়েকটা শিউলি এখনও পড়ে আছে অবহেলায়। ঝরে পড়া ফুল তুলে নিয়ে সযত্নে মালা না গাঁথলে কি তার মূল্য থাকে! ভাবতে ভাবতেই অন্যমনস্কভাবে হৃদি গরম চায়ে চুমুক দেয়। আর তখনই দরজায় কেউ আলতো শব্দে নক করে। কে? বলতে বলতে দরজা খুলে চমকে ওঠে হৃদি। রাসেল দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ফোলা, চুল উস্কো-খুশকো। কী রকম উদভ্রান্তের মতো লাগছে ওকে। সে হৃদির দিকে না তাকিয়েই বলল,
ভেতরে আসতে দাও! অনেকটা হুকুমের সুরেই যেন বলে রাসেল।
সরে দাঁড়ায় হৃদিতা। রাসেল ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে নিজেই সিটকিনি তুলে দিতে দিতে বলে, বাসায় আর কেউ নেই তো?
না। ওরা সব ঘুরতে গেছে পাহাড়ে। কাল তো বললাম তোমাকে। কিন্তু দারোয়ান তোমাকে আসতে দিলো? ফোন না করে? হৃদি বলে।
তাই তো এলাম তোমার কাছে, বলেই রাসেল এক পা এগিয়ে এক ঝটকায় বুকে টেনে নেয় হৃদিকে। তারপর ওকে শক্ত করে চেপে ধরে চুমু খায়। দীর্ঘ চুম্বন। মাঝে মাঝে শুধু শ্বাস নিচ্ছে যেন। কোনও প্রতিরোধের চেষ্টা করে না হৃদি। ওর শরীরটা কেবল কিশোরীর প্রথম প্রণয়ের মতো কেঁপে কেঁপে ওঠে রাসেলের বুকের ভেতর। রাসেলের ডান হাতটা তখন চষে বেড়ায় হৃদির পিঠময়। আর হৃদির দু’হাত রাসেলের কোমড় আঁকড়ে থাকে।
খানিকক্ষণ পর একটু যেন শান্ত হয় রাসেল। বলে, দারোয়ানের সাধ্য কি আমাকে আটকায়! বললাম আমি তোমাদের ম্যাডামের অফিসের বস। ব্যস! দরজা খুলে দিলো। হৃদি মৃদুকণ্ঠে মেঝের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, হঠাৎ কেন এলে বললে না তো? আর তোমাকে অমন ঝোড়ো কাকের মতো দেখাচ্ছে কেন?
সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি আমি!
কেন? কী হলো!
কী হয়েছে তুমি বোঝ না? তোমার কাছে আসতে ইচ্ছে করছিল খুব। বলতে বলতে রাসেল হৃদির হাত ধরে বেডরুমের দিকে নিয়ে যায়। যেন এ বাসাটা ওরই। অথচ হৃদির ফ্ল্যাটে এই প্রথম এলো রাসেল। বেডরুমে ঢুকে ওকে দুই বাহু ধরে খাটে বসিয়ে দেয়। আর নিজেই গিয়ে দরজা-জানালার পর্দা টেনে দিয়ে থাই গ্লাসটাও টেনে দেয়। তারপর শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলে, তোমার বাসায় আলো-হাওয়ার অবাধ যাতায়াত দেখছি। আর এটা যে মাঝে মাঝে সমস্যারও সৃষ্টি করে, আজ বুঝতে পারছি।
হৃদির পরনে তখনও রাতের পোশাক। পাশে বসে রাসেল গাঢ় চোখে তাকায়। তারপর হাতে হাত রেখে গল্প করতে করতে ওরা ঢুকে পড়ে স্বর্গের এক আশ্চর্য বাগানে। যেখানে ছড়িয়ে আছে অপার সুখসুধা। থাইগ্লাসের ওপারে তখন ঝকঝকে রোদ। আর দরজার এ পাশে এক সঙ্গে পাপড়ি মেলে ফুটে উঠছে কৃষ্ণচুড়া-রাধাচূড়া। নখের আঁচড়ে ভরে উঠছে বিমূর্ত ক্যানভাস। কী এক অলীক ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে দুজন কাটিয়ে দেয় বেহিসেবি মুহূর্তগুলো! তবু এই খুনসুটি, ভালো লাগা, ভালবাসা ছাপিয়ে হৃদির দু’চোখ বেয়ে নেমে আসে বানভাসি জলের ধারা। আরও কিছুটা সময় নেয় ও। হঠাৎ ঝড়ে বিশৃঙ্খল নিজেকে সামলে নিতে কিছুটা সময় তো নিজেকেও দিতেই হয়। বিষ্ময়ে হৃদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রাসেল।
হৃদি একটা এনজিওতে কাজ করে। প্রতিদিন সকাল ন’টার মধ্যে গোসল সেরে, নাশতা খেয়ে বেরিয়ে যেতে হয় ওকে। আজ সব রুটিনই এলোমেলো হয়ে গেল। অবশ্য এ নিয়ে খুব বেশি দুঃশ্চিন্তা ও করল না। আজ না হয় একবেলা অফিস কামাই হোক। এমনিও অনেক ছুটি পাওনা আছে। প্রয়োজন হলে না হয় ছুটি নিয়ে নেবে। বাথরুমে সাওয়ার নিতে নিতে অফিসের কাজের তালিকাটা ও ঠিক করে নেয় মনে মনে। রাসেল বসার ঘরে টিভি চালিয়ে কি একটা টকশোর পুনঃপ্রচার দেখছে। হৃদি ডাইনিংয়ে চা-নাশতা সাজিয়ে ডাকে ওকে, এসো নাশতা খাবে।
হুম! ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। বলে কোনো রকম ভনিতা না করে পরোটার টুকরোয় অমলেট পুরে মুখে দেয় রাসেল। এটুকু সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকপদ খাবার তৈরি করেছে হৃদি। পরোটা, ডিমের অমলেট, কষা মাংস, সালাদ, সেমাইয়ের জর্দা। খেতে খেতে রাসেল দেখে হৃদিকে। খুব সুন্দর লাগছে ওকে। বোধ হয় বাইরে যাওয়ার পোশাক পরেছে হৃদি। কালচে লাল ভি-গলার একটা ফতুয়া পড়েছে ও। সঙ্গে বাদামি রঙের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। বাম কাঁধে ঝুলে আছে রাঙামাটির আদিবাসীদের তৈরি মেরুন- কালো চেকের ওড়না। মুখে হালকা পাউডার, চোখে কাজল, ঠোঁটে লিপস্টিকও লাগিয়েছে। জামার থ্রি কোয়াটার হাতার নিচে ঘড়ি দেখা যাচ্ছে। তার মানে বাইরে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি। কিন্তু ওর পিঠময় ছড়িয়ে থাকা ভেজাচুল থেকে ফোটা ফোটা জল ঝরছে তখনও। রাসেল মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চায়ে চুমুক দিতেও ভুলে যায়।
এই যে মশাই! কী ভাবছেন? হৃদির কথায় ঠাট্টার সুর।
ভাবছি না, দেখছি।
কী দেখছেন?
আপনাকেই। ইচ্ছে করছে…!
থাক! থাক! আর ইচ্ছে টিচ্ছে করে কাজ নেই। চলুন এবার বেরিয়ে পড়ি। আমার অনেক কাজ আছে।
হুম! যেতে তো হবেই। তুমি তো আর আমাকে থাকতে দেবে না তোমার বাসায়।
আজ্ঞে আপনার নিজের একটা ভালোবাসা আছে। আমার এই ছোট্ট বাসায় আপনার মতো অত বড় মানুষের জায়গা কি হয়!
তুমিও তো আমার ভালোবাসা!
তাই বুঝি! খুব হয়েছে! এবার চলো বেরোই। আর কিছুক্ষণ থাকলে কৌতুহল চাপতে না পেরে সিকিউরিটি গার্ড ওপরে চলে আসবে।
রিক্সায় যেতে যেতে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায় হৃদি। ওর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে মৃদু চাপ দিয়ে রাসেল জানতে চায়,
কী হলো তোমার?
যদি কিছু হয়ে যায়? বলেই জলে ভরা চোখ তুলে তাকায় হৃদি। ওদের এই মেলামেশা তো আজই প্রথম নয়। ঘনিষ্ঠ হবার পর গত এক বছরে বেশ ক’বার এমন হয়েছে। কিন্তু আগে কখনো এতটা আতঙ্ক হৃদির চোখে দ্যাখেনি রাসেল। ওর আতঙ্ক দূর করতেই রাসেল হেসে বলে, ধূর! এত ভাবনার কী আছে। একটা ইমারজেন্সি পিল খেয়ে নিলেই হবে। হৃদির বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তারপর দু’জন চুপচাপ। হঠাৎই বেজে ওঠে রাসেলের সেলফোন। ও হ্যালো বলতেই ও পাশ থেকে কে কী বলে বোঝা যায় না। কিন্তু রাসেলের মুখের রঙ ফ্যাকাশে হতে থাকে। আমাকে এখনই একবার যেতে হবে হুদি! বলে ও ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে রিক্সা থামিয়ে নেমে যেতে যেতে বলে, কিছু মনে কোরো না! বাসায় একটু সমস্যা হয়েছে। তোমাকে পরে ফোন করব!
হৃদি আর কিছু বলার সুযোগই পেল না। রাসেল হারিয়ে যায় ডানদিকের জনস্রোতে। আর হৃদির রিক্সা ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে সামনের দিকে।
রাসেল চেয়ারটা টেনে বসে রিমির মাথার কাছে। তারপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আস্তে আস্তে। প্রায় ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল ওকে পোস্ট অপারেটিভ থেকে রুমে দিয়ে গেছে। এখনো পুরোপুরি চেতনা ফেরেনি রিমির। ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে ঠোঁট নড়ে উঠছে কেবল। কিন্তু শব্দ করে কিছু বলছে না। অপারেশনের পর একবার জ্ঞান ফিরেছিল। ডাক্তার তখনই রোগীর বাড়ির লোকদের ডাকল। রাসেল, ওদের ছেলে লিওন, রিমির বোন সবাই এগিয়ে গেল। ডাক্তার রোগীকে উদ্দেশ্য করেই বললেন, শুনতে পাচ্ছেন? আপনার অপারেশন হয়ে গেছে। অপারেশন খুব ভালো হয়েছে! রিমি তখন খুব আস্তে কী যেন বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছুই শোনা গেল না! শুধু লিওনের নামটাই বোঝা গেল। লিওন ছুটে গিয়ে মায়ের হাত ধরল। তারপর রিমির খুব শ্বাস কষ্ট শুরু হলো। ও মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ করতেই ডাক্তার সবাইকে বের করে দিয়ে আবার অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলো। ডাক্তার বলেছিল ল্যাপারোস্কোপি নাকি খুব ছোট একটা অপারেশন। রোগীর তেমন কষ্ট হয় না। সময়ও বেশি লাগে না। অথচ রিমির বেলায় যথেষ্ট সময় নিয়েছে ডাক্তার। তাহলে কি ওর কোনো কপ্লিকেশনস ছিল? অথচ সকালেও তো সব ঠিক ছিল। যখন হৃদির সঙ্গে রাসেল রিক্সায় ছিল তখনই ছেলে ফোন দিয়ে বলল, বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় এসো! মা পেটের ব্যথায় কান্না করছে। রাসেলের মনে পড়ল কিছুদিন থেকেই রিমি পেট ব্যথার কথা বলছিল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও কয়েকবার বলেছে। অথচ যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি। আজ যখন দেখল রিমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তখন আর দেরি না করে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে। ডাক্তাররা নানা রকম টেস্ট করে জানালো গলব্লাডারে পাথর হয়েছে। তারপর আরও কিছু টেস্ট লিখে দিয়ে বললেন, সম্ভব হলে কালই অপারেশন করাতে হবে। রাসেল কয়েক মুহূর্ত ভাবল রিমি হাসপাতালে থাকলে বাসায় কে থাকবে? লিওনকে কে দেখবে। তখনই মনে হলো যদি রিমির কিছু হয়ে যায়! তখন লিওনকে কে দেখাশোনা করবে? চিকিৎসা দেরি হলে বরং খারাপ কিছু হওয়ার আশংকা বেশি। তারচেয়ে অপারেশন করিয়ে নেওয়া ভালো। তাছাড়া ডাক্তার জানালো এটা জটিল কোনও অপারেশন না। তেমন কষ্ট নেই। অপারেশনের দু’দিন পরই রোগী বাড়ি যেতে পারবে। রিমি কি তাহলে কাল অথবা পরশু বাড়ি যেতে পারবে? ছেলেটা রয়েছে তার খালার বাসায়। অপারেশনের আগ পর্যন্ত ওরা এখানেই ছিল। পরে রাসেল ওদের জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা মায়ের অবস্থা দেখে ভয়ই পেয়েছে। এগারো বছরের বাচ্চা এতটা মানসিক চাপ নিতে পারে! পরের দিন রিমিকে ছাড়েনি ওরা। রাসেল যখন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে কথা বলল, ডাক্তার জানালেন, ওনার প্রেসারটা বেশ হাই হয়ে আছে। কাল অপারেশনের সময়ও পালস রেট হাই হয়ে গিয়েছিল। ওর কন্ডিশনের কারণেই অপারেশনটা করতে সময় বেশি লেগেছে। বায়োপসির রিপোর্টটাও আজ আসবে। সব দেখে শুনে কাল বরং নিয়ে যাবেন।
রাসেল আর ডাক্তারের সঙ্গে দ্বিমত করে না। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতেই ওর হঠাৎ ক্ষিধে পেয়ে যায়। দুপুরে হাসপাতালের ক্যান্টিনে খেয়েছিল বটে। কিন্তু হাসপাতালে ঠিক তৃপ্তি করে খাওয়া যায় না। প্লেট, গ্লাস, খাবার সব কিছুতেই মনে হয় জীবাণু গিজগিজ করছে। গতকাল থেকে আর বাসায় যাওয়া হয়নি। অপারেশনের আগে লিওনের খালাই গিয়ে বোনের কিছু জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে এসেছে। আজ দুপুরেও সে বোনের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। যদিও হাসপাতাল থেকেই রোগীর খাবার দেয়। তাই সে বাসা থেকে আনা খাবার রাসেলকে খেতে বলেছিল। ও খায়নি। বলেছে, আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব। কেবিনে ঢুকে দেখল রিমি বোনের সঙ্গে হেসে হেসে গল্প করছে। ছেলে খালাতো বোনের সঙ্গে কি সব খেলছে। দেখে আশ্বস্তবোধ করে রাসেল। রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলে, আমি একবার বাসা ঘুরে আসি। ওরা তো এখানে আছেই। আমি বরং গোসল করে একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। বলেই ও বেরিয়ে যায়। গোসল করে পরিস্কার জামা কাপড় পরে যখন বেরিয়ে এলো, রাসেলের তখন বেশ হালকা আর ফুরফুরে লাগছিল। গতকাল সারাদিন- সারারাত, আজকের দিনের সব দুঃশ্চিন্তা, ক্লান্তি যেন একেবারে ধুয়ে-মুছে গেছে। এখন কিছু খাওয়া দরকার। হঠাৎই মনে পড়ে হৃদির কথা। সেই যে কিছু না বলে রিক্সা থেকে নেমে আসার পর ওর সঙ্গে আর কথাই হয়নি। গত রাতেও মেয়েটা কয়েকবার ফোন দিয়েছে । কিন্তু রিসিভ না করে ‘কল ইউ লেটার’ ম্যাসেজ দিয়েছে রাসেল। আজ সারাদিন হৃদি আর ফোন করেনি। যে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মেয়ে সে তাতে আর ফোন দেওয়ার কথাও না। গত বছর যখন ওর সঙ্গে পরিচয় হলো তখনই জেনেছে শর্ট ডিভোর্সড হৃদি মা আর ছোট ভাই বোন নিয়ে থাকে নিজের ফ্ল্যাটে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার বড় পদে চাকরি করে। লেখালেখিতেও বেশ নাম করেছে। ঐ সুবাদেই রাসেলের সঙ্গে ওর পরিচয়। এক কবির সঙ্গে এসেছিল নিজের লেখা উপন্যাসের প্রচ্ছদ করাতে। ভীষণ খুঁতখুঁতে স্বভাবের। যা চায় তা স্পষ্ট করেই পেতে চায় অসংকোচে। সবটুকুই। ঐ প্রচ্ছদটা নিয়েই কয়েকবার দেখা হয়েছিল ওদের। তারপর আরো দুটি উপন্যাস বেরিয়েছে হৃদির। সবগুলোর প্রচ্ছদই রাসেল করেছে। এখন ওদের বন্ধুত্ব এমন পর্যায়ে গেছে যে কাজ ছাড়াও ওদের দেখা হয়। ফোনে কথা হয় প্রায় সবসময়। ফোনের কথা মনে হতেই পকেটে হাত দেয় রাসেল। আর তখনই ফোনটা বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করে আবারও ওকে হাসপাতালের দিকেই ছুটতে হয়। রিমিকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। অ্যাজমা ওর আগে থেকেই ছিল। হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। প্রেসার এখনও ওঠানামা করছে। কাজেই স্ট্যাবল না হওয়া পর্যন্ত এ রোগী ছাড়া যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। হঠাৎই বুকে চাপ অনুভব করে রাসেল। রিমি না থাকলে কী হবে ভাবতেই লিওনের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ছেলেটা একেবারে মা অন্তঃপ্রাণ। আর হবে নাই বা কেন? বাবাকে ও কতটুকুই বা কাছে পায়। সব সময়ই কাজ নিয়ে থাকে। বাসায় থাকলেও কম্পিউটারে মুখ গুঁজে থাকে। সব সময় লোকজন এসে ভিড় করে। আড্ডা দেয়, চা খায়। লিওন তখন বাবার কাছে যায় না। মা বলেছে, বড়দের আড্ডায় ছোটদের থাকতে নেই। লিওনের সব আবদার মায়ের কাছেই। ছেলের স্কুলে নেওয়া-আনা, কোচিং, গানের স্কুল সব কিছু তার মা-ই সামলায়। রিমি না থাকলে এইসব কিছু রাসেলের পক্ষে একা করা সম্ভব না। আর শুধু লিওনই বা কেন। রাসেলেরও ছন্নছাড়া এলোমেলো জীবনটাও তো গুছিয়ে রাখে রিমিই। তা না হলে কি নিজের কাজে অতটা সময় দিতে পারত সে। নাহ! যে করেই হোক রিমিকে বাঁচাতেই হবে। ভাবতে ভাবতেই ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে মনে হলো, রিমির কাছে তো একবার যাওয়া হলো না। দূর থেকেই ওকে দেখে আসাটা ঠিক হয়নি। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার আগে নিজে একবার রোগীর অবস্থা দেখে এলে বুঝতে সুবিধা হতো। রিমির খারাপ কিছু হবে না তো! হঠাৎ ই বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে ওঠে! রাসেল কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।
ছয় সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না। দু’দিন আগে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল হৃদি। ডাক্তার ইউরিন টেষ্ট করে পজিটিভ বলেছেন। নাহ, হৃদি খুব একটা অবাক হয়নি। কারণ ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এই তথ্যটা তার মস্তিষ্কে আগেই সরবরাহ করে রেখেছে। নিজেকে শান্ত রেখে ও ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে ডেট ঠিক করে নিলো।
আজই সেই দিন। হৃদি একবেলা অফিস করে বেরিয়ে এসেছে। অফিসের গাড়িই তাকে আনা-নেওয়া করে। কিন্তু আজ সে গাড়ি নেয়নি। ভীষণ দমবন্ধ লাগছে। একটা রিক্সা ডেকে ও উঠে বসল। লম্বা করে শ্বাস নিচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, মা! চমকে ওঠে হৃদি। তারপর আকুল হয়ে জানতে চায়, কে!
মা আমি তোমার সন্তান।
সন্তান! কোথায় তুমি?
তোমার ভেতরেই তো আমি মা! তোমার গর্ভের ভেতরে যে অথৈ সমুদ্র সেখানেই সাঁতার কাটছি আমি। মা, আমাকে তুমি তোমার বুকের ওম দেবে না! তোমার বুকে মুখ গুঁজে তোমার গায়ের গন্ধ নেব না আমি!
ওরে আমার সোনা! ওভাবে বলিস না! আমি খুব খারাপ মা। খুনি মা। পারলে আমায় তুই ক্ষমা করিস!
না মা। মা কখনো খুনি হয় না। আমি জানি, একটা ক্ষুদ্র জগত থেকে মুক্ত করে আমাকে তুমি ছড়িয়ে দিচ্ছ অসীম শূন্যতায়। এটা তো একটা রূপান্তর মাত্র। কোনো সৃষ্টিই তো মিথ্যে হতে পারে না। অসীমে থেকেও আমি মিশে থাকব তোমাতেই। রোদে গেলে আমি তোমায় ছুঁয়ে দেব। বাতাসে পাবে আমার গায়ের গন্ধ। তোমাকে ঘিরেই আবর্তিত হতে থাকব আমি!
শব্দগুলো উচ্চারিত হতে থাকে ওর বুকের খাঁচার গভীরে। কী এক নিদারণ কষ্টে কুঁকড়ে যায় হৃদির শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। হঠাৎই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে হৃদি। রাসেলের কথা মনে পড়ে। সেই ঘটনার কয়েকদিন পর রাসেলের সঙ্গে কথা হয়েছিল হৃদির। বউয়ের শরীর খারাপ। তাই ওকে রেখে বের হতে পারছে না। হৃদি তাতে কোনো আপত্তি করেনি। আপত্তি করার আছেই বা কী! ওদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা ছিল শর্তহীন। দুজনেই স্বাবলম্বী। কাউকে কারো দায়িত্ব নিতে হবে না। তবু আজ হৃদি মনে মনে রাসেলকে তার অলিখিত দায় থেকে মুক্তি দিয়ে নির্ভার মনে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো ডাক্তারের চেম্বারের দিকে। ডাক্তার ওর জন্যে অপেক্ষা করছে।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প যখন এসেছিলে অন্ধকারে লাবণ্য লিপি লাবণ্য লিপির গল্প 'যখন এসেছিলে অন্ধকারে' সাহিত্য