বাবা
২৬ এপ্রিল ২০২৩ ২১:২৪
নিবাত নিস্তরঙ্গ জমাট অন্ধকার আর শ্রাবণের দাবদাহে তন্দুর রুটির উনুনের মতো তপ্ত রুমের মেঝেতে শুয়ে কালচে দূরাকাশের নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তাকিয়ে আছে চিন্তাক্লিষ্ট রাহাত। হঠাৎ করেই, মনে হয় অন্তহীন নক্ষত্রপুঞ্জের ভেতরে বাবার হাসোজ্জ্বল মুখচ্ছবিটি ভেসে ওঠে রাহাতের চোখে। বাবা যেন হাসতে হাসতে বলছে, ঘুম আসছে না রাহা? আমার কাছে আয় মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। ঘুম আসবে।
কোনো রাতে ঘুম না এলে বাবা তো এভাবেই বলতেন। রাহাত কী উত্তর দিত?
শীতের শেষে গ্রীষ্মের খরতাপের সময় টপফ্লোরের বাসাটিতে টিকা দায়, আবার ঘুম আসে কী করে? গরমের সময়ই আবার লোডশেডিং হাতপা ছড়িয়ে অন্ধকারে ঢেকে দিয়ে বিরামহীন বিশ্রামের আয়োজন করে; বিদায় হতে চায় না। এমন কত না নিবাত তপ্ত রাতে বাবাকে কত বার বলেছে বাসাটি বদল করার জন্য। কিন্তু হাসতেন। বড় অবোধ ও নিষ্পাপ ছিল সেই হাসি।
লোডশেডিংয়ের সময় গরমটা উছলে উঠলে বাবা বাথরুম থেকে বালতি ভরে কয়েক বালতি পানি নিয়ে ছাদে ঢেলে আসতেন রুমটি ঠাণ্ডা করার জন্য। ছাদে পানি ঢালতেন শুধু রাহাতকে গাপোড়া গরম থেকে নিষ্কৃতি দেওয়ার জন্য। এই কাজটি করতেন রাহাতের চোখ এড়িয়ে গোপনে। পাছে রাহা কষ্ট পায়, ছেলেটার যদি ঘুম না হয়। তবে বেশি দিন নয় গোপনে এ কাজ চালাতে পারেননি, একদিন ঠিকই ধরা পড়ে রাহাতের চোখে। সেদিন বাবার সঙ্গে একচোট ঝগড়াও করেছিল রাহাত। কেন এই বাসায় পড়ে থাকতে হবে? নিচতলায় আরেকটি বাসায় কি আমরা যেতে পারি না? কেন এত কষ্ট করতে হবে?
বাসাটি বাবা ছাড়তে চাইতেন না কেন? কেন জেদ ধরে এখানেই থাকা। আজকের মতো এমন একটি ঘন অন্ধকার আর দাবদাহের রাতে গরমে অস্থির, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অবিরাম লোডশেডিংয়ের সময় মেঝেতেও পিঠ লাগানো দায়, সে রাতের মধ্যভাগে রাহাত ছাদে গিয়ে দেখে বাবা বালতি দিয়ে ছাদে পানি ঢালছে। রাহাতকে দেখে বাবা হেসে বলেছিলেন, একটু ঠাণ্ডা যদি হয়। স্তব্ধ রাতের গাঢ় অন্ধকারেই রাহাতের চোখ থেকে পানি ঝরেছিল নিঃশব্দে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে রাহাতের কাঁদতে ইচ্ছে করেছিল কিন্তু পারেনি। রাহাত তখন কিশোর। রুমের ভিতর এসে মেঝেতে শুয়ে থাকে স্তব্ধ হয়ে। নির্ঘুম রাতে রাহাত বুঝতে পারে এই বাসাতেই মাকে নিয়ে বাবা এসে উঠেছিলেন বিয়ের পর। রাহাতের জন্মের এক বছর পরেই মা মারা যায় ভুল চিকিৎসায়, হয়তো মায়ের স্মৃতিকে বাবার বুকে জিইয়ে রাখার জন্যই বাসাটি ছাড়তে চাননি। থাক, বাবাকে আর কোনো দিন বাসা বদলাতে বলবে না রাহাত।
সেই ছোট রাহাতকে কি বাবা বুঝতে দিয়েছিলেন মায়ের অভাব? নিজেই তো সব করতেন, নাওয়া-খাওয়া থেকে শুরু করে বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়ানোসহ কোনটা বাদ দিতেন? মায়ের মৃত্যুর আগে বাবা একটা ছোটখাটো কোম্পানিতে চাকরি করতেন, মায়ের মৃত্যুর পর রাহাতের জন্য চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে জমানো টাকা গুনে গুনে খরচ করে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বড় করে রাহাতকে স্কুলে ভর্তি করানোর আবার এক বন্ধুকে ধরে একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে খুব অল্প বেতনের একটা চাকরি নিলেন। ভালো বেতনের চাকরি পাওয়ার যোগ্যতাও তো ছিল না। কী করে পাবে ভালো বেতনের চাকরি। আর যোগ্যতা অর্জন করাও তার পক্ষে কি সম্ভব ছিল?
রাহাত তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র, একদিন বড় ফুফু বলেছিলেন, তোর বাবার জীবনটা বড় কষ্টের বুঝলে রাহাত।
কেন ফুফুমা?
ফুফু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আমাদের যা সম্পত্তি ছিল তা দিয়ে সংসার টেনেটুনে চলত। কারও কাছে হাত পাততে হতো না। আমার বাবা, মানে তোর দাদা খুব পরিশ্রমী কৃষক ছিলেন। শ্রাবণের এক রাতে বিলে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন বাবা, সকালে ফিরলেন লাশ হয়ে। সাপের কামড়ে বাবা মারা গিয়েছিলেন। তখন মিয়াভাই, মানে তোর বাপ, ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়, ওই বছরই এসএসসি পাস করেছিল আর্টস থেকে ফার্স্ট ডিভিশনে। অঙ্কে লেটার মার্কস পেয়েছিল। আর আমরা পাঁচ ভাইবোন প্রাইমারি আর হাইস্কুলে পড়তাম। আমাদের মানুষ করার জন্য নিজের বইখাতা ফেলে দিয়ে বাবার রেখে যাওয়া লাঙল-জোয়াল কাঁধে নিল। বাবার অভাব আমাদেরকে একটুও বুঝতে দেয়নি। কঠোর পরিশ্রম করে মিয়াভাই সবাইকে লেখাপড়া করাল। আমরা সবাই বিএ, এমএ পাস করলাম, আর মিয়াভাই… কথাটি শেষ না করেই ফুফু বললেন, তুই বোস আমি আসছি।
আসলে ফুফু যখন কথা বলছিলেন তখন তার গলা জড়িয়ে এসেছিল বলে সেদিন আর জীবনের গল্পটি বাড়তে দেননি। অনুভূতিপ্রবণ রাহাত ছোট হলেও এতটা অবোধ নয় যে সে ফুফুর অপ্রকাশিত আবেগ বুঝতে পারেনি। ফুফু সরকারি চাকরি করেন, ফুফাও একটি টেক্সটাইল মিলের বড় অফিসার। তাদের বাসাটিকে রাহাতের কাছে রাজকীয় বাসা মনে হয়। এত বড় বড় চার রুমের বাসা, দুটি বিশাল বারান্দা, ড্রয়িং রুমটা যেন ঘোড়দৌড়ের মাঠ। নিজেদের গাড়ি আছে, দুই ছেলেমেয়ে ভালো স্কুলে পড়ে। ফুফুমা পাথরের মতো শান্ত, তার মন মেঘের মতো কোমল ও আকাশের মতো বিশাল। রাহাতের বাবার কথা বলতে গেলেই বড় ফুফু কেমন যেন হয়ে যান, মনে হয় কষ্টের উত্তাপে তার মনের ভেতরের বরফ গলতে থাকে।
রাহাতের বাবা শুধু এই ফুফুর বাসাতেই আসতেন। অন্য কারও বাসায় যেতেন না। কেন যেতেন না এ ব্যাপারে গোয়েন্দাগিরি করার ইচ্ছে হয়নি রাহাতের। রাহাত যখন ছোট ছিল তখন প্রতি শুক্রবারেই রান্না করে রাহাতদের বাসায় যেতেন বড় ফুফু। নিজের হাতে বাপছেলেকে খাওয়ায়ে বাসায় ফিরতেন। কোনো শুক্রবারে যেতে না পারলে রাহাতকে নিয়ে আসতে হতো। ফুফুমার আবদার বাবা না রেখে পারতেন না। ফুফাও তেমন এক বিশাল মনের মানুষ। ঈদপার্বনে কোনো কিছু নিজের সন্তানের জন্য কিনলে রাহাতকে বাদ দিতেন না। তিনি মাঝে মাঝেই ঢাকার বাইরে যান। আর যেখানেই যান গ্রামের বাজার থেকে শাক-সব্জি, ফলমূল, ঘানিভাঙা খাঁটি সরিষার তেল, দেশি মাছ, খাঁটি ছানার সন্দেশ নিয়ে আসতেন দুইভাগে। একভাগ রাহাতদের জন্য আর অন্যভাগ নিজেদের জন্য। এই সম্পর্কটুকু যদি ফুফু না রাখতেন তাহলে বাবার আর কে থাকত পৃথিবীতে? অন্য ভাইবোনরা নিজেদের মতো করেই আছে, একবারও খোঁজটা পর্যন্ত নেয়নি।
আরেকদিন, মনে হয় বুদ্ধিমতী ফুফুমা জানেন ছেলেটার ইতিহাস জানা দরকার। তাই হয়তো সময় সুযোগ বুঝে পারিবারিক ইতিহাস স্লাইস করে বলেন। বাবার জীবনগাথাকে স্লাইস করে স্যান্ডুইয়েসের মতো টুকরো টুকরো করে খাওয়ান রাহাতকে। একসঙ্গে বেশি খাওয়ালে হয়ত বদহজম হতে পারে, অথবা ফুফুমা নিজেও শেষ করতে পারবেন বলেও মনে হয় না।
আষাঢ়ের এক ঝুম বৃষ্টির দিনে বাবা মিষ্টি কুমড়ো কুঁচো চিংড়ি দিয়ে রান্না করেছিলেন। রাহাতকে নিয়ে বাবা রান্না করেন ওকে শেখানোর জন্য। রান্না শেষ হলে রাহাতকে ডেকে বললেন, রাহা, তুই তোর ফুফুকে এক বাটি তরকারি দিয়ে আয়।
এত অল্প তরকারি ফুফুর বাসায় নিব? কী ভাববে তারা?
কিছু ভাববে না।
বাবার মুখটা বড় মলিন দেখে রাহাত করুণ চোখে বাবার দিকে তাকলে খুব শান্তভাবে তিনি বললেন, এই তরকারিটা যে আমাদের বড় স্মৃতি।
মিষ্টি কুমড়োর আবার স্মৃতি কী বাবা?
আছে। জানিস, রাহা… বাবা খুব শান্ত গলায় বললেন, আমরা গরিব ছিলাম। এক সময় মাঝে মাঝে আমরা মিষ্টি কুমড়ো সিদ্ধ করে খেয়ে দিন পার করেছি। এখন মিষ্টি কুমড়ো রান্না করলে সেই দিনগুলোর কথা মনে হয়। তুই রিকশায় করে গিয়ে বাটিটি দিয়েই চলে আসবি। আমি তোর জন্য ভাত বেড়ে অপেক্ষা করব।
বাবার কথায় রাহাত আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু মনে মনে বলল, আমরা কি এখন খুব বড় লোক? আমরা তো এখনও গরিব। হয়তো তোমার ভাইবোনরা বড়লোক হয়েছে কিন্তু তুমি তো গরিবই রয়ে গেলে বাবা। কিন্তু বাবা মনে কষ্ট পাবেন ভেবে রাহাত এসব কথা শুধু মনের ভেতরেই আওড়ায়। প্রকাশ করতে পারেনি।
রাহাতদের বাসার কাছেই নূরজাহানদের বাসা। নূরজাহানকে রাহাতের বাবা নূরু ডাকেন, পিঠাপিঠি হওয়াতে সংসারের আর জীবনের সুখ-দুঃখ দুই ভাইবোন ভাগাভাগি করেই বড় হয়েছেন। সুখ-দুঃখের ভাগাভাগির আবেগই তো মধ্যবিত্তের জীবনের অটুট বন্ধন, এছাড়া আর কী আছে? রাহাতের হাতের বাটি দেখে বড় ফুফু হাসলেও সেই হাসির পেছনে চাপা কষ্টের জলছাপ রাহাতের চোখে ধরা পড়ে। একদিকে আষাঢ়ের বৃষ্টি, আর ছুটির দিন থাকাতে ফুফুমার বাসাতে রান্না হয়েছে খিচুরি-ইলিশ। বোনকে রেখে ভাই খেতে না পারলে বোন কি পারবে ভাইকে রেখে খেতে? মধ্যবিত্তের রেওয়াজ—শূন্য বাটি তো আর দেওয়া যায় না, কিছু দিয়ে পূর্ণ করে দিতে হয়। রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে বললেন, নে রে রাহাত। মিয়াভাইকে বলবি আমি রান্না করেছি।
হ্যাঁ, ফুফুর রান্না বাবা খুব পছন্দ করে তা রাহাত জানে। বাবা তো প্রায়ই বলতেন, তোর বড় ফুফুর রান্নাতেই আমি মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ ও গন্ধ পাই। তোর ছোট ফুফুর রান্নাটা তেমন হয় না। অবশ্যই রাহাতের যাচাই করার কোনো সুযোগ হয়নি কোনো দিন। তবে বাবাকে খোঁচা দিয়ে রাহাত বলত, ছোট ফুফুর রান্না তো খাইনি। কী করে বুঝব?
বাবার দীর্ঘশ্বাস শোনা যেত। মুখ ফুটে কিছুই বলতেন না। একি দুঃখ নাকি সুখের প্রকাশ তা রাহাত বুঝতে পারত না, এখনও পারে না। ছোট ফুফু নাকি প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন বাবাকে না জানিয়ে। তারপর তারা একদিন ইতালিতে থিতু হলেন। একবারও দেশের আসার নাম গন্ধটিও নেননি। উপর্যুপরি একবার চিঠি লিখেছিল গ্রামের বাড়ির সম্পত্তি বিক্রি করে তাদের ভাগটুকু দিয়ে দিতে। ছাড় দেয়নি কথা বলতে। বাবার সম্পত্তি তো একা একা অনেকদিন ভোগ করেছো, আর কত? এখন আমাদের পাওনা দিয়ে দাও।
বাবার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না। ফিরতি চিঠিতে লিখেছিলেন, একবার দেশে এসে যা পাস বিক্রি করে নিয়ে যা। আমি নিজে কিনে রাখতে পারব না। আমার কাছে টাকা নেই।
বড় ফুফু একথা শুনে অনেক কেঁদেছিলেন। রাহাতকে শুধু বলেছিলেন, তোর বাবা খুব ভালো ছাত্র ছিলেন, জানিস রাহাত। কিন্তু আমাদের লেখাপড়া করানোর জন্য নিজে কলেজে ভর্তি হননি। বিয়ের বয়সে বিয়েও করেননি। আমাদের সবাইকে বিয়ে দেওয়ার পর তোর বাবা বিয়ে করেছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে। তবু ভাগ্য ভালো যে, তোর মা রাজি হয়েছিলেন। না-হয় হয়তো অকৃতদারই থেকে যেতেন। আর তোর মা তো টিকল না। ভুল চিকিৎসায় তুই এতিম হলি। মানুষ বড় বেঈমান।
রাহাত এসব ভারি কথাগুলোকে হালকা করতে শিখেছে। সে জানে বাবা ও বড় ফুফুর মনে অনেক কষ্ট আছে। কিন্তু কষ্টকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ? যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে ততক্ষণ আনন্দ নিয়েই বাঁচা উচিত। রাহাত হাসতে হাসতে বলল, সবাই তো আর বেঈমান হয় না ফুফু মা। এই তো তুমি কত ভালো!
মানুষের চরিত্রকে এমন জেনারেলাইজ করা ঠিক হলো কিনা বড় ফুফু ভাবে। একেকটি মানুষ একেক রকম, একেকটা মানুষের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব-নিকাশ একেক রকম। প্রতিটি মানুষের জীবনের লেনদেন আলাদা। প্রকৃতির এই অমোঘ সত্যই অবিনশ্বর, নির্ভেজাল ও অনিবার্য।
তোর বাবার কাঁধ দেখেছিস কোনো দিন?
দেখেছি।
কী দেখেছিস?
থাক না ফুফুমা। সব কথা বলার কী প্রয়োজন? মানুষের জীবন তো একভাবে যায় না। এই যে তোমরা যে বাসাটিতে থাক সেটি তো দিনমজুররাই তৈরি করে দিয়েছে। এসব বলে কী হবে?
রাহাতের দিকে তাকিয়ে বড় ফুফু আর কিছু বলেননি। তবে এটুকু আজকে উপলব্ধি করেছেন যে, রাহাতের ভেতরে যেন মিয়াভাই ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। বাবার মতোই হচ্ছে রাহাত।
জানিস রাহাত, মিয়াভাই কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে দিলেও বাড়িতে অনেক বই পড়তেন। রাজনীতি, দর্শন, সাহিত্য… শহরের পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়তেন রাত জেগে। আর আমার মা-ও মিয়াভাইকে খুব উৎসাহ দিতেন।
আমি জানি ফুফুমা।
জীবন কেন এভাবে থমকে যায়? রাহাতের তো অন্য দশটি ছেলের মতো কোনো চাওয়া ছিল না। কোনো দিন বাবার কাছে কিছু চায়নি। বাবা মাঝে মাঝেই বলতেন, আমার কাছ তুই কোনো দিন কিছু চাস না কেন? তোর কি কোনো কিছুর সাধ-আহ্লাদ হয় না রাহা? প্রতি উত্তরে রাহাত কিছুই বলত না। কী বলবে রাহাত?
মাতৃহারা শিশুটি যে ছোট থেকে জীবনের বাস্তবতা বুঝতে শিখেছে তাও বাবার কাছে, বুঝতে শিখেছে কীভাবে বিরুদ্ধ স্রোতে হাল ধরতে হয়, হাড়মাংস পানি করে বাবার রোজগারই বা কত—বাবার কাছে কী চাইবে সে? শুধু বাবার আদরটুকু নিয়েই সে বড় হচ্ছিল। তাও শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার পোষাল না।
এমন সুখের জীবনও মানুষের হয়? সন্ধ্যার পর অফিস থেকে এসে বাবা রান্না করে রাহাতকে পড়াতে বসতেন। রাত দশটায় দুজনে খেয়ে থালাবাসন ধুয়ে সকালের নাশতার ব্যবস্থা পাকা করে শুতেন। রাহাতকে দুনিয়ার গল্প বলতেন। ছড়া শোনাতেন। রাহাতও কি কম যেতো! সিক্সে পড়ার সময়ও বাবাকে অসংখ্য চুমু খেত। আদরে আদরে ভরিয়ে দিত বাবাকে। কদিন আগেও তো বাবার বুকে মাথা রেখে ঘুমাত। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক বড় মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। কত প্রবচন, কত ছন্দ, কত মহামানবদের বাণী শোনাতেন শুধু বড় মানুষ হওয়ার জন্য। বড় মানুষ মানে বড় মনের মানুষ। এমন সুখ আর কোথায় মিলে?
‘তুমি যদি পাহাড়ের উপরের পাইন গাছের মতো না হতে পারো, তাহলে অন্তত সমতলের গোলাপ হইও। তবু নর্দমার কীট হয়ো না।’ হ্যাঁ, বাবা যেন কার উক্তিটি এভাবেই বলতেন। এসব স্বপ্নের কথা যে বাবার কাছ শোনা হয় সে বাবার কাছে কিছু কি চাওয়া যায়?
স্কুলে রাহাত খুব রেজাল্ট করতে পারত না। গড়পড়তার ছাত্র। এজন্য রাহাতের বা বাবার কোনো আক্ষেপ বা ক্ষোভ ছিল না। বড় ফুফুর ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি নম্বর পেয়ে ক্লাস উৎড়াচ্ছে। একদিন রাহাত বলেছিল, আমি যদি ওদের মতো নাম্বার পেতাম! বাবাকে তখন খুব দুঃখিত মনে হয়েছিল। বাবা অস্ফুট উচ্চারণে বলেছিল, কেন? ওদের মতো হতে হবে কেন? তুমি তোমার মতো হও। স্বকীয়তা ছাড়া মানবজীবন মূল্যহীন।
একথা নিরেট সত্য। বড় ফুফু একদিন বলেছিলেন, তোর ছোট চাচা মাহতাবও খুব ভালো ছাত্র ছিল। এমএ পাস করার পর আমেরিকা চলে যাওয়ার জন্য গোঁ ধরেছে। অনেক চেষ্টা তদবির করে কোনো স্কলারশীপ ম্যানেজ করতে না পেরে শেষে মিয়াভাইকে ধরল জমি বিক্রি করে টাকা দিতে। আসলে আমাদের কিছু সম্পত্তি ছিল যেটুকু বিক্রি করে মাহতাবকে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল। তখন সে বলেছিল এটুকু জমির দাম হবে আমার তিন মাসের রোজগার। অবশ্যই মিয়াভাইয়ের একার সিদ্ধান্তে জমি বিক্রি হয়নি। আমরা ভাইবোন আর তখন মা-ও ছিল, সবার সিদ্ধান্তই ছিল। কিন্তু এখন…
বড় ফুফুর গলা জড়িয়ে যায়। এখন সবাই মিয়াভাইকেই দোষারূপ করে। আর মাহতাব কোনো দিন আমাদের খোঁজ-খবরও নেয়নি। শুনেছি এক আমেরিকানকে বিয়ে করে গ্রিন কার্ড নিয়েছে, আর দেশমুখো হয়নি।
বাবা অবশ্যই এসব কথা কখনই বলতেন না রাহাতকে। যতটুকু শোনা গেল বড় ফুফুর কাছ থেকে।
নিজের চেষ্টায় রাহাত ক্লাস উৎরিয়ে যাচ্ছিল। কোনো কষ্ট থাকলেও কখনই প্রকাশ করত না বাবাকে।
বাবা কি শুধু বাবাই ছিল? এমন বাবা কয়জন পেয়েছে জীবনে? বাবা তো ছিল বড় বন্ধু। জীবনের প্রতিটি পদে পদে, ঘাটে ঘাটে যা জানার দরকার সবই তো বাবা শিখিয়েছে।
রাতের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে আসে। নিতল কালচে আকাশের অনন্ত দূরের তারকারাজি ছাড়া পৃথিবীর কোনো আলো নেই এই শহরে। সেই সন্ধ্যা থেকে লোভ শেডিং চলছে, হয়ত আজ রাতেও বিদ্যুতের দেখা নাও মিলতে পারে। এমন রাত এই শহরে নিত্যপুরাণ। বিদ্যুৎহীন রাতে বাবা রাহাতকে সারা রাত তালপাখা দিয়ে বাতাস করতেন। তপ্তপ্রাণে ঢেলে দিতেন শীতল শান্তির পরশ। এখন এমন শান্তির পরশ আর কোথায় পাবে? গহিন রাতে গোপনে ছাদে পানি ঢালতেন রুম ঠাণ্ডা করার জন্য, এমন গোপন সুখ আর কোথায় মিলবে?
রাহাতের পাশে পড়ে আছে একটি তালপাখা। আজকে এটি হাতে নিতে ইচ্ছে করেনি। গত বছর বাবাকে নিয়ে বৈশাখী মেলা গিয়েছিল, হাতপাখাটি কিনেছিল। এবারের মেলায় যায়নি রাহাত। যেতে ইচ্ছে করেনি। বড় ফুফু বলেছিল, সকাল আর দুপুরের সঙ্গে মেলা থেকে ঘুরে আয়। সকাল বড় ফুফুর ছেলের নাম আর দুপুর মেয়ের নাম। বড় আধুনিক নাম ওদের। পুরো নাম সারা সকাল, আর সারা দুপুর। রাহাতের খুব ভালো লাগে এই নাম দুটি।
বৈশাখী মেলায় যায়নি দেখে বড় ফুফু বৈশাখে যা রান্না হয় সেগুলো নিয়ে এসেছিলেন বাসায়। বাসাটি বড় বিষন্ন, বড় রুগ্ন। এই কয়দিনেই কোনায়কানায় মাকড়সার কলোনি হয়ে গেছে। ঝুলকালিতে একাকার। রাহাতও সারাক্ষণই বিষন্ন থাকে বলে বাসাটি পরিষ্কার করে না, পরিচ্ছন্ন করে না।
একা একা বাসায় থেকে তুই যে অসুস্থ হয়ে পড়বি। না-হয় আমার বাসায় চলে আয় রাহাত।
না, ফুফু। আমি এখানেই থাকব যতদিন থাকা যায়। তবে মনে হয় বেশি থাকা যাবে না। এত ভাড়া কোথা থেকে দেব? তাছাড়া শুনেছি বাড়িওয়ালা বাসাটিকে ডেভেলপারের কাছে দিয়ে দিবে। বাবার স্মৃতিময় বাসাটি ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে। কী আর করব বলো?
আমি জানি তুই মিয়াভাইয়ের মতো। কিন্তু কীভাবে চলবি? মিয়াভাই এসএসসি পাস করার বাবা মারা গেলেন, আর তুইও…। বড় ফুফু আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকলেন।
বাবা আমার, লক্ষ্মীসোনা, চল আমার বাসায়। মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছিস, কীভাবে চলবি তুই? আমি কি তোর পর?
বাবা তো সব শিখিয়ে দিয়ে গেছে। তুমি চিন্তা করো না ফুফুমা। দেখো আমি ঠিকই মানিয়ে নেব।
রাত শেষ হয়ে গেছে। দুর্ভেদ্য আঁধারের প্রাচীর ভেঙে যাচ্ছে, নিস্তরঙ্গ রাতের বুকে হিমেল মৃদুমন্দ হিল্লোল বইছে। রাহাতের খোলা জানালা দিয়ে ফুলেরা সেই বার্তা দিয়েছে।
‘আসসালাতু খায়রুম মিনান নাউম…।’
বাবা শিখিয়েছিল সকালে ঘুম থেকে ওঠার জন্য। রাহাত বিছানা ছেড়ে বাইরে যায়। প্রদোষের আলো পুবাকাশ ছাপিয়ে আসে। দু-একজন মানুষ পথে নেমেছে, রাস্তার পাশে কয়েকটি কুকুর জটলা পাকিয়ে আছে, প্রায় জনহীন পথের পাশে দাঁড়িয়ে বুক ভরে হিমেল সতেজ বাতাস টেনে নেয় রাহাত।
আত্মবিশ্বাসের নিশ্বাস নিয়ে রাহাত সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর সংখ্যা ২০২৩ গল্প বাবা মোজাম্মেল হক নিয়োগী মোজাম্মেল হক নিয়োগীর গল্প 'বাবা' সাহিত্য