আমার বীনু খালা
১৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৯:১০
প্রিয় আমের আচারের বৈয়ামের মধ্যে আটকা পড়ে গেলেন বীনু খালা। বীনু খালার শ্যামলা রঙ। মাথায় ঘনকালো চুল। চোখদুটো টানা টানা। গড়ন হালকা পাতলা। হাসলে অসম্ভব সুন্দর লাগে, আর কথা বলেন বাঁশির সুরে। কিন্তু এই বীনু খালার সঙ্গে আমার চাক্ষুস পরিচয় দশম শ্রেণীতে পড়ার সময়ে। আমি যখন বোথলা হাই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই তখন বীনু খালা দশম শ্রেণীতে। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে ষষ্ঠ শ্রেণীর একজন ছাত্রের পক্ষে দশম শ্রেণীর ছাত্রীর সঙ্গে আলাপ পরিচয়তো ভাল, কথা বলাও ছিল এক অসম্ভব ঘটনা। দূর থেকে অনেক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কখনও সখনও হয়তো বীনু খালাকে দেখেছি কিন্তু তার সঙ্গে একদিন আমার একটা নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠবে, ভাবিনি।
ঘটনাটা ঘটলো হঠাৎ। ততদিনে আমার স্মৃতি থেকে বীনু নামক এক মেয়ের অস্তিত্বই মুছে গেছে। কারণ, বীনু খালা মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেছেন। বীনু খালার বাবা, আমার গ্রাম সর্ম্পকের নানা মৌলভী তোজাম্মেল হোসেন ইকড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হলেন। তোজাম্মেল নানা খুব সাদাসিধে ধরনের মানুষ। সবার সঙ্গে মেশেন। কোনও অহংকার নেই। গ্রামের কয়েকজন বড় ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, আমরা তোজাম্মেল নানাকে সাপোর্ট করব। এবং তার পক্ষে কাজ করব। বড় ভাইদের একজন রফিক ভাই বললেন, আমরা জানি তোজাম্মেল চাচা হারবেন। কারণ প্রতিপক্ষের প্রচুর টাকা আছে কিন্তু আমাদের শান্তনা থাকবে আমরা একজন সৎ ও ভাল মানুষের পক্ষে কাজ করেছিলাম। যদিও আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র, বাইরের প্রচুর বই পাঠ করার সুযোগ হওয়ায় আমি বয়সের তুলনায় মননে কিছুটা এগিয়ে ছিলাম। তাই রফিক ভাইয়ের কথাটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।
স্কুলে উপস্থিত বক্তৃতা, শিক্ষকদের বিদায় অনুষ্ঠানে আমি মোটামুটি বলতে পারতাম। সেই কারণে তোজাম্মেল নানা প্রচারের মাইকের দায় পড়ল আমার ঘাড়ে। এবং নিজেকে কেউকেটা মনে হতো। আমাদের এলাকায় প্রচুর খাল। একটা টাপুরে নৌকা ভাড়া করে, নৌকায় মাইক নিয়ে সকালে উঠে পড়তাম। গলুইয়ের ছৈয়ের উপর বসানো থাকত মাইকের একটা হর্ন। আর আমি ছৈইয়ের ভেতরে বসে বা বাইরে দাঁড়িয়ে আপনমনে বলে যেতাম- ইকড়ি ইউনিয়নের সন্মানিত জনগন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একজন সৎ প্রার্থী হিসেবে মৌলভী তোজাম্মেল হোসেনকে গরুর গাড়ি মার্কায় ভোট দিয়ে আপনাদের সেবা করার সুযোগ দিন। গরুর গাড়িতে ভোট দিন, সামনে আসবে সুখের দিন। তোজাম্মেল হোসেন সৎ লোক, গরুর গাড়ি মার্কায় দিবেন ভোট।
ভাল এবং নিত্যনতুন শ্লোগান আবিষ্কারের কারণে মাইকিংয়ের খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। খ্যাতির কারণে নিজের মধ্যে একটা কালারফুল ভাবও এসে যায়। বিকেলে হাটে গেলে শত শত লোক আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এদিকে পড়াশুনা বাদ দিয়ে তোজাম্মেল হোসেনের ইলিকশনের মাইকিং করে বেড়াচ্ছি, এ বিষয়ে বাড়িতে তুমুল আপত্তি ওঠে। কিন্তু আমি তখন মোটামুটি বিখ্যাত, বাড়ির আপত্তিকে সন্মান জানানোর সময় করে উঠতে পারিনি। দ্বিতীয় গোপন কারণ, বীনু খালা।
সারাদিন মাইকিং করে রাতে বা সন্ধ্যায় মাইক নানা বাড়িতে রেখে আসতাম। সকালে আবার মাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতাম। তৃতীয় দিন সকালে নানা আমাকে বললেন, তোর নানী ভেতরে ডাকছে।
আমি ভেতরে গিয়ে দেখি, সামনে দাঁড়ানো কয়েক বছর আগে দূর থেকে দেখা বীনু খালাকে। আমাকে দেখে চমৎকার হাসলেন এবং হাত ধরে বললেন,
আমাকে চিনেছো?
মাথা নাড়লাম, চিনেছি।
খালিমুখে এতো মাইকিং করলে হবে? চল, খাবি।
আমি তার সঙ্গে পাশের ঘরে প্রবেশ করি। নানী গরম ভাত আর মুরগীর সালুন দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বীনু খালা বললেন, মা এই তোমার নাতী।
নানী হাসলেন পান খাওয়া মুখে, খেতে বসো। সারাদিন কত পরিশ্রম কর।
আমি বীনু খালার ছোট ভাই নবীনের পাশে বসে পড়লাম। নানার ডাকে নানী উঠে গেলেন আর বীনু খালাকে বললেন, মিন্টুকে ভাল করে খাওয়া।
বীনু খালা বসে গেলেন আমার সামনে- পুস্প বুয়া কেমন আছে?
ভাল আছে।
তুই এতো সুন্দর সুন্দর শ্লোগান কই পাস?
বীনু খালার কথায় আমি হাসি। নবীন জানায়, তুমি জানো আপু, মিন্টু মামা কবিতা লেখে।
আমি জানি, বলেন বীনু খালা। আমি যখন স্কুলে পড়তাম তখন ও পড়তো সিক্স-এ। সেই সময়েই ও গল্প কবিতা লেখার খবর জানতাম। কথায় কথায় আমার খাওয়া শেষ। নৌকায় মাইকও মাইকের সরঞ্জাম ওঠানোর পর মাঝি এসেছে আমার খবর নিতে। তোজাম্মেল নানা তাড়া দেয়, ও মিন্টু শীগগির যা। আজ ইকড়ি ইউনিয়নের পাইকখালিতে মাইকিং করবি। দূরের এলাকা তো, সবাইর কাছে এখনও আমি পৌঁছাতে পারি নাই।
খালা যাই বলে, আমি দ্রুত খাবারের ঘর থেকে বের হয়ে নৌকায় উঠি। উঠেই মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলতে শুরু করি, ইকড়ি ইউনিয়নের সন্মানিত জনগন, আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সব চেয়ে সৎ, নির্ভরযোগ্য, গরীর মানুষের জন্য নিবেদিত প্রাণ চেয়ারম্যান পদ প্রার্থী মৌলাবী তোজাম্মেল হোসেনকে গরুর গাড়ি মার্কায় ভোট দিন…। সারাদিন মাইকিং করে রাতে মাইক ফেরত দিয়ে চলে যাবার সময়ে বীনু খালা ডাকলেন, মিনটু!
জি খালা?
কই যাস?
বাড়ি যাই।
বাড়ি যাই, খালার কণ্ঠে অনুরাগ, এতো রাইতে তোর মায়ে খাবার নিয়ে বসে আছে? আয়, খেয়ে যা।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি চিন্তিত ছিলাম। গ্রামের রাত। অনেক দূরের পথ থেকে মাঝি উজান বেয়ে এসেছে। পাশের ঘরের ট্রানিজস্টারে রাত নটার উত্তরণ অনুষ্ঠান চলছে। শফি কামালের ভরাট গলায় কেবল বিশ্ববিচিত্রা শেষ হয়ে মিউজিক ওভার বাজছে। এতো রাতে বাড়ি গেলে কি ধরনের অভ্যর্থনা পাব, শংকিত ছিলাম। বিশেষ করে খাবার পাব কি না, এ বিষয়ে দ্বিধা ছিল। খালার আহবানে ঘরের ভেতরে গেলাম। খালা আমার হাত পা মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর শরীরে ময়লা। চল পুকুরঘাটে। হাত পা ধুয়ে খাবি।
আমার সঙ্গে হেরিকেন নিয়ে চললেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছি। পিছনের পুকুরের ঘাটটটা বাঁধানো। বীনু খালা হেরিকেন তুলে বললেন, নাম।
আমি সিঁড়ি বেয়ে নীচে পানিতে নেমে হাত মুখ ধুয়ে উঠলে খালা গামছা বাড়িয়ে দিলেন। গামছায় মুখ মুছতে মুছতে খালার পিছনে পিছনে ঘরের ভেতরে ঢকুলাম। আবার সেই খাবার ঘর। আমাকে খাবার দিলেন। আমি খেতে শুরু কলাম। খেতে খেতে সারাদিনে কোথায় কি মাইকিং করেছি, মানুষ কি রকম সাড়া দিচ্ছে গরুর গাড়ির পক্ষে তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানলেন। খাওয়ার পর চলে আসার সময়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই এতো রাতে এতোখানি পথ যেতে পারিব?
ঘাড় কাত করে বললাম, পারব।
তোর ভয় করবে না?
না।
আমি অন্ধকারের ভেতর দিয়ে গ্রামীণ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি এলাম। পরের দিন সকালে আবার নানা বাড়ি, আবার বীনু খালার হাতে খাওয়া, নৌকায় চড়া, মাইকিং করা- একনাগাড়ে একুশ বাইশ দিন চলার পর ইলেকশন হলো। রেজাল্ট যা হবার, সেটাই হয়েছে। সৎলোক তোজাম্মেল নানা বিপুল ভোটে পরাজিত হয়েছেন। কিন্ত আমি একজন বীনু খালাকে পেলাম।
সকাল বিকাল সময় পেলেই বানু খালার কাছে যেতাম। তিনি অনেক ধরনের বই পড়েন। আমিও বই পড়ি। দু’জনার মধ্যে বই পড়ার একটা প্রতিযোগিতা চলে। আর ধীরে ধীরে বীনু খালার মর্মর জগতে প্রবশে করে আমি প্রথম নারী রাজ্যের গোপন দুয়ারের সামনে দাঁড়াই। এক নিদাঘ দুপুরে গিয়ে দেখি বীনু খালা দোতালার তার ছোট্ট কিন্ত ছিমছাম ঘরের খাটের উপর বমে কাঁদছেন নিঃশব্দে।
আমাকে দেখে খুব কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তুই আমাকে বিয়ে করবি?
আমি অবাক হয়ে খালার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। খালার কোমল শ্যামল কালো মুখের উপর চিক চিক করছে থরেবিথরে সাজানো ব্যথা।
আর আমাকে বিয়ে না করলে এক শিশি বিষ এনে দিতে পারবি?
বিষ দিয়ে কি করবে?
বিষ দিয়ে মানুষ কি করে? খায়। আমিও খাবো।
কথা বলতে বলতে আমি বীনু খালার মুখোমুখি বসি। খালার এমন বিষন্ন বিপন্ন রূপ আগে দেখিনি। কিন্তু বিষন্ন বিপন্ন নারীর রূপও যে এমন সোনালু নির্মল হয়ে ওঠে, সেদিন দেখলাম। খালার সামনে বসলে আমার একটা হাত নিয়ে খেলা করতে করতে কথা বলেন। কথায় কথায় বীনু খালা স্বাভাবিক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই তো আমাকে দেখছিস। বলতো আমি দেখতে কেমন?
মানে?
মানে আবার কি? আমি দেখতে কেমন? কালো? ভূতের মতো? নাকি পেত্নীর মতো?
আপনি ভূত হতে যাবেন কেনো? আপনি খুব সুন্দর।
তোকে কে বলল আমি সুন্দর?
কে বলবে? আমি বলছি।
তাহলে আমার বিয়ে হয় না কেনো? তুই যে গল্প কবিতা লিখিস, তুই কি আমার এই বিয়ে না হওয়ার যন্ত্রনা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারবি?
পারব। আগে আমার পরীক্ষাটা হোক।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পাঁচ বছর হলো মেট্রিক পাশ করে বসে আছি। পাশ করার পর এ পর্যন্ত আমাকে অন্তত পঞ্চাশটা ছেলে দেখে গেছে। কিন্তু কেউ আমাকে পছন্দ করেনি। আগামীকাল আবার একটা ছেলে দেখতে আসবে। এখন আমার ওদের সামনে যেতে ঘৃণা করছে। ইচ্ছে করছে, মরে যাই- বলতে বলতে বীনু খালার গলাটা ভারী হয়ে যায়। তার ঠোট কাঁপছে।
আমি এতোদিন, মানে পরিচয়ের পর থেকে যে বীনু খালাকে চিনে আসছিলাম, এই বীনু খালা একেবারে অন্যরূপ, আলাদা, বেদনামথিত, বিপন্ন। আর নিজেকে নিয়ে প্রবল ভারাক্রান্ত। নিজেকেই তার কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। সারাটা দুপুর সেই বাড়ির দোতলায় আমি বীনু খালাকে প্রতি মুহুর্তে পাল্টে যেতে দেখি। আর নতুন নতুন ইতিহাসের মুখোমুখি হই। আমাকে জিজ্ঞেস করেন, তোদের বাড়ির কাছে এনামুলকে চিনিস?
চিনবো না কেনো?
জানিস, ও-ই আমার সর্বনাশ করছে।
আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না, আমাদের বাড়ির কাছে এছাহাক মিয়ার ছেলে এনামুল হক কিভাবে বীনু খালার সর্বনাশ করছে! এনামুল বিয়ে করেছে বছর দুয়েক আগে। একটা বাচ্চাও আছে। আমার নির্বুদ্ধিতায় বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, এতো কম বুদ্ধি নিয়ে তুই লেখক হবি কি করে? লেখকদের অনেক বুদ্ধি থাকতে হয়। শোন, আমার দু বছর আগে এনামুল মেট্রিক পাশ করেছে। ও যখন নাইনে, আমি তখন সেভেন-এ। সেই সময় থেকে ও আমার পিছনে লেগেছে। আমাকে বিয়ে করবে। আমাকে শত শত চিঠি দিয়েছে। আমি একটারও উত্তর দিইনি। বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে, বাবা না করে দিয়েছে। এক পুরুষ আগে নাকি এনামুলেরা চোর ছিল। বিখ্যাত চোর। এলাকায় ওদের নিয়ে অনেক ঘটনা আছে। আমার বাবায় বিয়ে দিতে না চাইলে আমি করতে পারি? বিয়ে করেছে, বাচ্চা হয়েছে কিন্তু এখনও আমার বিরুদ্ধে লেগে আছে। বল, আমি ওর কি ক্ষতি করেছি?
কিন্তু ও তোমার ক্ষতি করলো কিভাবে?
ঠাস করে আমার গালে একটা থাপ্পর মারলেন, তুই আমার ডান হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বললেন, এইটার লেখক! ওই হারামজাদা আমার প্রত্যেকটা বিয়ের ভাঙ্গানি দেয়।
এতোক্ষণে বুঝতে পারলাম, ঘটনার পেছনের ঘটনা। আমি আসলে একার মধ্যে থাকি। আমার প্রিয় আশ্রয় বই। সে ক্লাশের হোক আর বাইরের হোক। আমার একটাই নেশা, বই পড়া। নইলে একা একা রাস্তায় ঘুরে বেড়াই। নয়তো কচানদীর পাড়ে বসে থাকি। এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগটা কম। আছি সবার মাঝে, আবার নেই। একা একজন। সে কারণে গ্রামের মধ্যে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা থেকে আমি বিচ্ছিন্ন।
বীনু খালা আমার কাছে এলেন, গালে হাত রাখলেন- ব্যথা পেয়েছিস! আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন- আমি এই এতো বড় বাড়িতে একা। কারও সঙ্গে আমার কথা হয় না। কেউ আমাকে বুঝতে পারে না। এই বাড়িতে ছোট বড় এগারোটি গৃহস্থ ঘর। আমি ছাড়া কোনও মেয়ে নেই অবিবাহিত। আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট মেয়েরও বিয়ে হয়ে গেছে। সবাই আমার দিকে কেমন করে তাকায়, মিন্টু তুই বুঝবি না।
অন্যদিকে আমি এক যৌবনবতী নারীর কোমল বুকের মখমল থেকে অজানা ঘ্রাণে পাগলপ্রায়। নারীর বুকের গোপন গভীর বাগান থেকে এমন বকুলের সুগন্ধ আসে, প্রথম জানলাম। মনে হচ্ছিল আমি সুঘ্রাণে গলে যাচ্ছি, ফোঁটা ফোঁটা মধুর মতো ঝরে পড়ছি আমি আমার শেকড় থেকে। আমি যখন বীনু খালার বুকের অথৈ গন্ধে পাগলপ্রায়, আমাকে আচমকা ছেড়ে দিয়ে বললেন, চল খাবি।
সেই দুপুর, সেই দিনের বিকেল, সেই দিনের পরে রাত আমার জীবনে অভাবনীয় কল্পনার এক লাগামহীন ঢেউ এসে আছড়ে পরেছিল। যৌবনের সিংহদুয়ারে দাঁড়িয়ে আমি, আমাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছিল কয়েকটি দিন রাত্রি বীনু খালার বুকের কয়েক মুহূর্ত। এক অস্থির যন্ত্রনা, কষ্ট এবং বিষাদ হাহাকার চক্রাকারে আমার চারপাশে ঘূর্ণির মতো পাক খাচ্ছিল। বেশ কয়েক দিন তোজাম্মেল নানার বাড়ি যাইনি। যদিও আমার ভেতরে দুপুরে ঘুঘুর ডাক শুনেছিলাম কিন্তু নিজস্ব যন্ত্রনায় নিজের ভেতরে গুটিয়ে যাচ্ছিলাম। ব্যক্তিগত এইসব ঘটনার ভেতরে পারিবারিক অবস্থাটা আমার জন্য ভয়ানক হয়ে ওঠে। সেভেনে পড়ার সময়ে পিতা ভদ্রলোক বড় অকালে পরপারে চলে গেলে গোটা পরিবার এক অনিশ্চিত ভবিষতের দিকে যাত্রা করে। কিন্তু আমার ধ্যান একটাই, যেভাবেই হোক মেট্রিক পরীক্ষাটা দিয়ে ঢাকায় চলে আসব। ঢাকায় আসলেই লেখক হিসেবে আমি আমাকে বিকশিত করতে পারব। পরিবারের চিন্তা মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হলে খুলনায় পাঠাবে। সেই সময়ে খুলনা সমৃদ্ধ শিল্পশহর। আমাদের এলাকার প্রচুর মানুষ খুলনার কলে কারখানায় কাজ করে। সেখানে গেলে বদলীওয়ালা হিসেবে কোনও কাজ করলেই সংসারের দুঃসময়ে কাজে আসবে। সংসার ভাবছে সংসারের অনটন। আমি ভেবেছি আমার দিনযাপন।
পরীক্ষার দিনকয়েক আগে এক দুপুরে বীনু খালার কাছে যাই। আমি যখন বাড়ির ভেতরে ঢুকি, বীনু খালা গোসলে যাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, তুই উপরে যা। আমি গোসল সেরে আসছি।
দোতলায় বীনু খালার ঘরে ঢুকে খাটের উপর পেলাম শরৎচন্দ্রের চরিত্রহীন উপন্যাস। পড়তে শুরু করলাম- যদিও চরিত্র জিনিষটা কি, কেমন, কোথায় পাওয়া যায় তখনও যেমন বুঝিনি, এখনও বুঝতে পারিনি। পড়ায় মগ্ন থাকার সময়ে বীনু খালা ঘরে ঢুকলেন।
মিন্টু?
খালা?
আমার উপর রাগ করেছিস নাকি?
না, রাগ করব কেনো?
এতোদিন আসিসনি যে!
পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিলাম।
কেমন হচ্ছে পড়াশুনা? ভাল রেজাল্ট না হলে তোকে কেটে কচানদীতে ভাসিয়ে দেবো।
আমি হাসি।
বীনু খালা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল ঝাড়ছেন। আমি চরিত্রহীন পড়ছি। বীনু খালা প্রসাধন সারছেন, আমি চরিত্রহীন পাঠ করছি। কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছি না, প্রবল বকুলের গন্ধ পাচ্ছি। আমি আবার গলে যেতে শুরু করলাম, ঠিক এই সময়ে বীনু খালা আমার কাছে এগিয়ে এসে পিছন ফিরে দাড়ালেন, মিন্টু আমার ব্লাউজের বোতাম লাগিয়ে দেতো।
আমি চরিত্রহীন-এর পৃষ্ঠা থেকে চোখ তুলে দেখি, আমার সামনে দুধের মতো মসৃণ আকুল করা পিঠ। পিঠের উপর সমুদ্রের নোনা জল চুমু খাচ্ছে। আমি কি করব? আমি ওই বয়সেই আলবার্তো মোরাভিয়ার রোমের রুপসী পড়েছি, কাজী আনোয়ার হোসেনের রানা সিরিজের অনেক বই পাঠ করেছি। নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের আনোয়ারা পাঠ করেছি। হাজার উপাখ্যান আমার করোটির ভেতরে কত্থক নাচতে শুরু করেছে। এইসব বই পাঠ করতে করতে বিশেষ বিশেষ জায়গায় এলে শরীর শিউরে উঠতো আর মগ্ন হতাম। সেই আমার সামনে সুন্দরী নারীর খোলা পিঠ, আমি কি শরৎচন্দ্রের হাত ধরে পালিয়ে যাবো? নাকি ইন্দ্রের মতো বলব, মরার আবার জাত কি! কিন্তু আমি! আমি তো মানুষ। যৌবন আমার শরীরে বাঘের থাবায় নাচে, হুংকারে কাঁপায় রাতের বিদগ্ধ অন্ধকার। আমি কি করব?
কথা কানে যায় না? বীনু খালা পিঠ খুলে দাঁড়িয়েই আছেন। নীচ থেকে খাবার জন্য নানী ডাকছেন। আমি দাঁড়ালাম এবং নানীর ডাক শুনতে শুনতে বীনু খালার খোলা পিঠের ব্লাউজের বোতাম লাগিয়ে দিলাম কাঁপা কাঁপা হাতে।
মাথায় চিরুনী চালাতে চালাতে বললেন, তুই কি গোসল টোসল ঠিক মতো করিস না? তোর শরীর থেকে বোটকা গন্ধ আসে। তোর সঙ্গে বৌ থাকবে না।
আবার নানীর ডাক, ও বীনু? মিন্টুরে লইয়া খেতে আয়।
আমরা নিচে নেমে গেলাম।
আমার কাছে দেওয়া আমার কথা আমি রেখেছিলাম। যেদিন মেট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়, তার পরের দিনই বাড়ির কাউকে না বলে ছিয়াব্ব্ই টাকা সম্বল করে, মোঝা ভাইয়ের একটি প্যান্ট ও একটি শার্ট নিয়ে ঢাকার লঞ্চে উঠে বসি। রাজনৈতিক সূত্রে একটি অফিসে এসে আশ্রায় নিই। শুরু হয় আমার নাগরিক জীবন। কিন্তু ঢাকার আকাশে আমি কোনও তারা দেখতে পাই না। আকাশজুড়ে বীনু খালাকে দেখি। আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা চিঠি লিখি। বীনু খালাও উত্তর দেয়, দীর্ঘ দীর্ঘ চিঠি লেখেন। আমি টিউশনি করি, আর লেখা ছাপানোর চেষ্টা করতে করতে দু একটা পত্রিকায় লেখা ছাপাও হয়। চারটা পাঁচটা পত্রিকা কিনি। একটা বীনু খালাকে পাঠাই। আহারে আমার বীনু খালা, লেখা পড়ে আর বড় বড় চিঠি পাঠায়। অজস্র প্রশংসা করে আরও লিখতে বলেন। আমার ভেতরে তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখতে পান। আর আমি আমার ভেতরে দেখতে পাই চরিত্রহীনকে। বেচারা শরৎচন্দ্র বড় বিপদে ছিলেন, তখন।
বছরখানেক পর একটা চিঠিতে জানতে পারি, বীনু খালার বিয়ে হয়েছে। বীনু খালার বিয়ে হয়েছে! আমার ভেতরে সাত হাজার কবুতর ডানা মেলে দিয়েছিল সেদিন। মনে হলো, বীনু খালা, যাকে রেখে এসেছিলাম কচানদীর পাড়ের কাঠের বাড়ির দোতলায় ছোট্ট একটি রুমের কারাগারে। যিনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। কোথাও যান না। সবাই তার দিকে বিষাক্ত চোখে তাকায়, তার বিয়ে হয় না। তার বিয়ে হয়েছে। তিনি মুক্তি পেয়েছেন। তার মুক্তি, এ-তো আমারই মুক্তি। বীনু খালা বাপের বাড়ি ছেড়ে স্বামীর বাড়ি গেছেন। স্বাভাবিকভাবে চিঠিপত্র লেখা আগের মতো হয় না। কিন্তু যখনই তার চিঠি আসে, দুটো বিষয় থাকে। এক, গ্রামের বাড়ি এলে আমাকে দেখে যাবি। দুই, কোনওভাবে লেখা ছাড়বি না। লিখে যাবি। আমিও তো লিখে যেতে চাই। লিখছি নানা পত্রিকায়। একটা সরকারি অফিসে চুক্তিভিত্তিক একটা চাকরি পেয়েছি। চুটিয়ে টিউশনি করছি। পায়ের তলায় মাটি ক্রমশ শক্ত হচ্ছে। প্রায় আড়াই বছর পর বাড়ি গেছি। বাড়ি যাবার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে শ্রীখালি যাত্রা করলাম।
সময়টা ভাদ্র মাস। রাস্তার দুধারে কৃষকেরা জমিতে কাজ করছেন। আমার হাতে ছাতা। শ্রীখালি গ্রাম আমাদের গ্রামের তিনটি গ্রামের পর। শ্রীখালির পাশের গ্রাম আতরখালিতে আমার বড় খালার বাড়ি। অনেকবার সেখানে গিয়েছি। এইবার যাচ্ছি, বড় খালার বাড়ি নয়, বীনু খালার বাড়ি। ভাদ্রের তাতানো রোদে ঝলসে ঝলসে যখন শ্রীখালির বীনু খালার বাড়ির উঠোনে দাঁড়াই, খালা তখন উঠোনে ধান লাড়ছিলেন। আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। এক পলক, তিনি বিদ্যুতের গতিতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, মিনটু!
উঠোনে দাঁড়নো ফরসা মুখের এক নারী বিস্ফোরিত চোখে দেখছে অভাবনীয় নিষিদ্ধ এক দৃশ্য। আমার কপালে চুমু দিয়ে হাত ধরলেন, কবে এসেছিস?
কাল।
কাল! বীনু খালা খুব খুশী হলেন, চল। ঘরের ভেতরে চল। যেতে যেতে সেই বিস্ফোরিত নারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, শিমুলের মা, এটা আমার ছেলে। ঢাকায় থাকে।
অ, বিস্ফোরিত মুখে পান খাওয়া দাঁতে স্বাভাবিক হাসি। এতোবড় পোলা আপনের!
হ্যাঁ, আগের জন্মের। তুমি তাড়াড়াড়ি ঘরে আসো। অনেক কাজ আছে। বলতে বলতে আমাকে নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। বসলাম খাটে। বীনু খালা আমার গাল ধরেন তো মাথার চুলে আদর করেন। হাসেন। আমি দেখছি বীনু খালাকে, আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়েছেন। শরীরে সামান্য মাংস জমেছে কিন্তু তাতে লাবণ্য আরও খুলেছে। সারামুখে আনন্দ আর উচ্ছাস। খলবল করে হাসছেন। হ্যাঁ, আমি বীনু খালার মুখে এমনই হাসি দেখতে চেয়েছি।
মিনটু?
খালা?
তুই যখন বিয়ে করবি আমি তোর বৌ পছন্দ করে দেবো। তোর বৌ হবে আমার চেয়েও সুন্দরী।
আপনি সুন্দর নাকি?
মুখ ভার করার ভান করেন খালা, আমি সুন্দর না?
সুন্দর মানে? আপনি জগতের সুন্দরী শ্রেষ্ঠ।
খালা হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়েন। হাসি থামলে বলেন, তুই যখন বিয়ে করবি তখন অনেক বড় লেখক হবি। তোর কতো নাম ডাক হবে। এই বীনু খালাকে তখন তোর মনে পড়বে?
খুব পড়বে। আর আমি আপনার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করব।
সত্যি?
আমি ঘাড় নেড়ে জবাব দিই, সত্যি। খালু কই?
তোর খালু স্কুলে গেছে। মাস্টার না, বিএসসি মাস্টার। শ্রীখালি হাই স্কুলে অংকের ক্লাস নেয়। এইতো এসে পড়বে। তুই বস। তোর জন্য খাবার আনছি।
খালা উঠতে গেলে হাত ধরি, আপনি বসুন। আমার খিদে নেই।
হাত ছাড়িয়ে নেন খালা, আসছি। একটু বস।
খালা চলে গেলেন ভেতরে। আমার ভেতরটা অনাবিল সুখে মোচড় খাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। উঠোনে ধান খাচ্ছে কয়েকটি কবুতর। খালা ভেতর থেকে খৈ, নারকেল আর পাটালি গুড় আনলেন ডালায় করে। তুই খৈ খুব পছন্দ করিস। নে খা।
খেতে খেতে হাসি। খালা শিমুলের মাকে ডেকে মুরগী ধরতে বললেন। কলসিতে রাখা জিয়ল মাছ বের করার আদেশ দিয়ে আমার দিকে তাকালেন, তুই ডাব পছন্দ করিস, এই বাড়িতে প্রচুর ডাব আছে। কিন্তু পাড়বার লোক নেই। দেখছি।
খালা উঠতে গেলে আমি হাত ধরি, খালা আপনি বসুন। বিকেলে আমি চলে যাবো। আবার কবে আপনার সঙ্গে দেখা হয়, ঠিক আছে? আসুন, কথা বলি।
খালা আমার পাশে বসেন। বার বার মাথায় হাত রাখেন, তুই আমাকে ঢাকা থেকে এসেই দেখতে এসেছিস, আমি যে কি খুশি হয়েছি, তোকে বোঝাতে পারব না। আর শোন, তুই বিকেলে যাবি কেনো? রাতটা থাকবি। আমরা সারা রাত গল্প করব।
আমরা সারা রাত গল্প করব, খালু কি করবে? বকবে না?
আরে না, অংকের মাস্টার মানুষটা ভাল। হঠাৎ এক রাতের মধ্যে বিয়ে হয়েছে, ওই কুত্তাডায় কিছু করার সুযোগই পায় নাই।
পিছনে মোরগের কড় কড় শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ডাব পাড়া হয়েছে। ডাব খাচ্ছি। গোটা বাড়িতে একটা হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়ে দিয়েছেন বীনু খালা। বাড়ির অন্যান্য ঘরের মহিলা, ছেলেমেয়েরা এসেছে। সবার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, আমার ছেলে মিনটু। ঢাকায় থাকে। লেখক।
খালার সঙ্গে কথা বলছি, ঢাকায় কেমন করে থাকি, মেসে কে রান্না করে দেয়, কি খাই, কখন লিখি। এইসব বলতে বলতে দেখি এক লোক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা, হাতে ছাতা নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকছে। বুঝতে পারি, আমার বীনু খালার স্বামী। আমার খালু।
আমরা দুজনে একটু কাছাকাছিই বসেছিলাম। খালুকে দেখে আমি একটু সরে গেলেও খালা নির্বিকার। হাসি মুখে তাকায় খালুর দিকে, বল তো কে?
খালুর মুখের দিকে তাকাই, অনেকটা পাথরের মুখ। চোখে কোনও ভাষা নেই। মাথায় প্রচুর চুল। মানুষটা একটু খাটো। ছাতা ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে প্রশ্ন করেন, চিনলাম না তো। কে?
মিনটু। তোমাকে ওর কথা কতো বলেছি। আর তুমি চিনতেই পারলে না? খালার গলায় অভিযোগ- তোর খালু আসছে, দুজনে গল্প কর। আমি রান্নার কি অবস্থা দেখি। আমার মাথার চুলে আদর করে খালা ভেতরে চলে গেলেন। খালু আমার সামনে খাটে বসলেন। আমি ঢাকায় কি করি, কোথায় থাকি, জিজ্ঞেস করে এক সময়ে ভেতরে চলে গেলেন। আমার পেট ভরা, একটু ক্লান্তিও ভর করেছে, বিছানায় শুয়ে পড়লাম। এবং ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম থেকে উঠেই দেখি কেউ কোথাও নেই। দুপুর নয় বিকেল তিনটা। অবাক, খালা আমাকে তুললেন না? পেটে খিদেটা জেগে উঠছে। উঠোনে বড় বড় গাছের ছায়া হেলে পড়েছে।
খালা? খালা? আমি ডাকছি কিন্তু কোনও সাড়া নেই। আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিনা, সামনের ঘর থেকে ভেতরের ঘরে ঢোকার জন্য পা বাড়িয়েছি, শিমুলের মা ঢোকে।
আপনি কি নাইবেন?
না, আমি গোসল করে এসেছি। বীনু খালা কোথায়? খালাকে ডেকে দিন।
হে আপনের সামনে আর আইবে না।
কেনো?
হের জামাই আপনের সামনে আইতে না করছে। আপনের খালায় হেরে যা-তা কইছে, আপনে ঘুমাইয়া আছিলেন। শ্যাষে হেরে মারছে। মাতা ফাইড্যা রক্ত বাইর অইছে।
খালাকে মেরেছে? মুহুর্তে আমার গোটা জগৎ পাল্টে যায়। আমি আমাকে, এই বাড়ি, উঠোন, উঠোনে শুকোতে দেওয়া ধান, সামনে দাঁড়ানো শিমুলের মা- কাউকে, এবং কোনও কিছু চিনতে পারি না। আমার জন্য বীনু খালা মার খেয়েছে? মাথা ফেটে রক্ত বের হয়েছে! আর আমি তার ঘরে শুয়ে আছি? আমার সঙ্গে দেখা করলে বীনু খালার কী হবে? আমি তো তার পুত্র!
খালা কোথায় এখন?
বাড়িতে নাই। আমারে কইয়া গেছে ঘুম দিয়া ওঠলে আপনারে খাওন দিতে।
খাওন দিমু?
আমি কোনও কথা বলি না, বলতে পারি না। একজন পুরুষ হিসেবে আমি বুঝে গেছি আমার খালুর সূত্র। দ্রুত ছাতাটা হাতে নিয়ে উঠোনে নামি। শিমুলের মা পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে, আপনে কই যান?
পিছনে ফিরেও তাকাই না। দ্রুত থেকে দ্রুত হাঁটতে থাকি। এই বাড়ির কেউ আমাকে দেখুক, চাই না। হাঁটতে হাঁটতে অনুভব করি, আমি কাঁদছি। চোখ বেয়ে পানি নামছে। আমি পানি মুছি আর হাঁটি। হঠাৎ শুনি আকাশের বজ্রপাতের হুংকার। তাকিয়ে বুঝতে পারি, আকাশ ঘন কালো হয়ে গেছে মেঘে। কয়েক পা আসার পরই মুষলধারায় বৃষ্টি নামে। আমি হাতের ছাতা মেলে মাথার উপর ধরি না, বৃষ্টির পানিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটতে থাকি। পথের ছাতা মাথায় দেওয়া যাত্রীরা আমাকে অবাক চোখে দেখে, আরে- লোকটা পাগল নাকি? কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে অথচ হাতের ছাতা মেলছে না!
কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। আমি প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এবং কাঁদতে কাঁদতে হাঁটি। হাঁটতে থাকি। হাঁটাই আমার গন্তব্য। কেনো আমার এতো কান্না পাচ্ছে, বুঝতে পারি না। মনে হচেছ চোখ নয়, আমার গোটা শরীর কাঁদছে ভাদ্রের প্রবল বৃষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে- সুন্দর শোকে, অপমানের দ্রোহে।
ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। আর দেখা হয়নি বীনু খালার সঙ্গে। হয়তো আর হবেও না। কিন্তু আমি প্রায়ই একটি দৃশ্য দেখি, বীনু খালাকে তার প্রিয় আচারের বৈয়ামের মধ্যে আটকে রাখা হয়েছে। বীনু খালা বৈয়াম ভেঙ্গে বের হয়ে আসার জন্য প্রবলশক্তিতে বৈয়ামের দেওয়াল ভাঙ্গার চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে। কিন্ত বৈয়ামের দেওয়াল ভেঙ্গে বের হয়ে আসতে না পারেন, সেজন্য পাহারায় আছেন জমকালো পোষাক পরিহিত, মুখে কালো মুখোশে ঢাকা, হাতে বাঁকা লাঠি নিয়ে একজন পাটিগণিতের শিক্ষক।