একবিংশ শতাব্দির শুরুর এক গল্পের এলিজি
২৯ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:০৭
একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকের কথা। তখনো বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় যৌতুক এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যধি। এ দায়ে ‘দেনাগ্রস্ত’ ঘরে ঘরে শোকগাঁথা আর বিভৎস নির্মমতার কী করুণ সব কাহিনী! আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে চলা মানুষেরাও যৌতুকের এইসব ‘উপহারের’র জন্য যেন জ্ঞানকূল হারিয়ে নিমর্জ্জিত বিলাসী আকাঙ্ক্ষায়! সেই সময়কার দিনে রচিত এক নাটকের প্রদর্শনীতে ফিরে এলো আজ থেকে ঠিক দুই দশক আগের সেই চিত্র। বর্তমানের সমাজ ব্যবস্থাতেও যৌতুকের এই নিম্নচিত্ত মানুষের মাঝে যে হারিয়ে গেছে; তাও নয়। তবে কমেছে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা আর মানবিকতার চরিত্রে এই ব্যধি অনেকটা সেরেছে উঠেছে।
পাহাড়ের এক প্রগাঢ় ও বিদগ্ধ নাট্যজনের রচিত সেই ‘যৌতুক একটি অভিশাপ’ টেলিফিল্মের প্রদর্শনী হয়েছে কুড়ি বছর পরে। বছর দশেকর আগে পৃথিবীর মায়া-মমতা, পরিবার-স্বজন, গুনগ্রাহী, সতীর্থ আর উত্তরসূরিদের রেখে এক নাট্যজন এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রণজিৎ কুমার মিত্রের স্মরণে তাঁরই রচিত সেই ‘যৌতুক একটি অভিশাপ’ প্রদর্শনী হয়ে গেলো রাঙামাটি জেলা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অডিটোরিয়ামে।
শনিবারের (২৮ অক্টোবর) সন্ধ্যার এই আয়োজনে প্রয়াত নাট্য ব্যক্তিত্ব রণজিৎ কুমার মিত্রের পরিবারের সদস্য, সতীর্থ আর উত্তরসূরিদের আবেগ আর অনুভূতিতে প্রকাশ পেয়েছে রণজিতের চলে যাওয়ার বেদনা আর স্মৃতিবিধুরতার কথা। ২০০৩ সালে রচিত এই নাটকের রচয়িতাকারী রণজিৎ কুমার মিত্র ধরিণীর মায়া ত্যাগ করে পরপাড়ে পাড়ি জমান ২০১৩ সালের ২ আগস্টে। চলে যাওয়ার দশ বছর পরেও তাঁরই সতীর্থ, উত্তরসূরি ও শুভানুধ্যায়ী সাংস্কৃতিক যোদ্ধারা তাঁরই রচিত নাটকের প্রদর্শনী করে তাকে স্মরণ করেছেন আকুণ্ঠ শ্রদ্ধায়। পুরো আয়োজনের শেষের দিকেই শোকাবহ এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে ‘স্মৃতি কথা’য়।
অনুষ্ঠানের শুরুতেই রণজিৎ কুমার মিত্রকে স্মরণ করে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন তাঁরই ছাত্র, সহযোগী ও বর্তমানে রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির নাট্য প্রশিক্ষক সোহেল রানা। সোহেল রানা বলেন, ‘রণজিৎ স্যার আমাদের মতো কিছু পাগল তৈরি করে গেছেন; যারা এখনো নাটক, সংস্কৃতির জন্য কাজ করছে। আমাদের এমন কিছু মানুষ তৈরি করতে হবে, যারাও সংস্কৃতির জন্য কাজ করবেন।’
এরপরই বিরামহীন প্রায় ৪৬ মিনিট ২১ সেকেন্ড সময়ের তৈরি ‘যৌতুক একটি অভিশাপ’র প্রদর্শনী করা হয়। পুরো নাটকে ফুটে উঠেছে যৌতুক নামের সামাজিক ব্যধির ভয়াবহ চিত্র। নাটকের একটি দৃশ্যে দেখা গেছে, শ্বশুড়ালয়ের যৌতুক দাবির কাঙিক্ষত টেলিভিশনের জন্য শ্বশুড়ের টিপ্পনীতে মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া এক নববধূর মৃত্যু। আরেক দৃশ্যে ওঠে এসেছে নেশাগ্রস্ত স্বামীর ছোঁড়া এসিডে জ্বলছে গেছে আরেক গৃহবধূর মুখ।
বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় এই সব চিত্র এক বিংশ শুরুর দিকে হরমামেশাই ঘটে চলতো। অকালে প্রাণ হারিয়েছে কৈশোর পেরিয়ে সংসারের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া কত-শত বধূ। আর নাট্যজনের রচিত এই নাটকে তুলে ধরা হয়েছে সেই সব দিন-রাত ও সময়ের করুণ পরিণতির পরিণতি। নাটকের চরিত্রে অভিনয়ে ছিলেন রচয়িতা রণজিৎ কুমার মিত্র, তাঁর স্ত্রী অনিমা মিত্র ও ছেলে অজয় মিত্রও। আরও অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুনীল কান্তি দে, সন্তোষ বড়ুয়া, সোহেল রানা, সেতু, মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু, সুমি, সৈয়দা নিলুফার জাহান নিপু, জয়া দাশ, রোমান, তরুন মিত্র, অপর্না মিত্র, মোহাম্মদ আলমগীর, তারেক, মতিউর, সুমি (২)সহ আরও অনেকেই। অভিনয়ে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন এই প্রদর্শনী ও স্মৃতি কথা’র আয়োজনে। পার্বত্য চট্টগ্রামের এক অনন্য সাংস্কৃতিক জন ও নাট্য প্রশিক্ষক রণজিৎ কুমার মিত্র ছিলেন সেই সময়ে রাঙামাটি জেলা শিল্পকলা একাডেমির আবৃত্তি ও নাট্য প্রশিক্ষক।
শনিবার তাঁর রচিত নাটকের প্রদর্শনীতে উপস্থিত হয়ে ছিলেন নাটকের অভিনেতা-নেত্রী, পরিচালক, রণজিতের ছাত্র-ছাত্রী ও শুভানুধ্যায়ীরা। প্রদর্শনী অনুষ্ঠানের শেষের দিকে ছিল এই নাট্যজনের স্মরণে স্মৃতি কথা’র আয়োজন। সেখানে স্মৃতিচারণ করেছেন ছাত্র, সতীর্থ ও পরিবারের সদস্যরা। উপস্থাপক তারেক মাহমুদ বললেন বর্তমানের নাট্য জগতে রণজিৎ মিত্রের শূন্যতার কথা। স্নেহাশীষ বড়ুয়া সেন্টুও বলেছেন রণজিৎ মিত্রের সঙ্গে তার কাজ করা ও স্মৃতিমধুর দিনের কথা।
সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রণজিৎ কুমার মিত্রের সঙ্গে যে মানুষটি আশপাশে ছিলেন; সেই মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। মঞ্জুর জীবনের সঙ্গে সেই সব দিনের স্মৃতি আজও আকড়ে রয়েছে। বললেন, ‘অনুভূতি প্রকাশের ভাষা আমি এখানে এসে হারিয়ে ফেলেছি’। রণজিতের শুভার্থী ও সাংবাদিক সৈকত রঞ্জন চৌধুরী বলেছেন, তাদের নাটক, অভিনয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার মাধ্যম ছিলেন রণজিৎ মিত্র। হয়তো ‘পেছনের সারির ছাত্র’ বলে নাট্য জগতে বেশিদূর এগুতে পারেনি; এমনটিই বলেছেন সৈকত।
সৈকত, সেন্টু, রানা, তারেক, মঞ্জুর মতোই স্মৃতি প্রকাশ করেছেন দিদারুল আলম সেতু, পাম্পুসহ অন্যরা। সকলেই জানালেন এমন গুনীজনদের স্মরণে বছরে অন্তত এমন একটি আয়োজনের প্রয়োজন।। নতুন প্রজন্মকে নাটক, সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন, জড়িয়ে নিতে এই উদ্যোগের ধারাবাহিকতার আকুল আবেদন করেছেন সকলেই। রণজিতের চলে যাওয়ার ঠিক দশ বছর পরের এই দিনে পুরো অডিটোরিয়ামে জুড়ে কেবলই স্মৃতিবিধুরতা; এলিজি।
স্মৃতি কথা’র আয়োজনে রণজিৎ কুমার মিত্রের ছোট ছেলে অজয় মিত্র বললেন রণজিতের পুরো পরিবার ও তার জীবনের পুরো তার বাবার স্বত্ত্বাকে ঘিরেই। এই সময়ে এসে একসময় নাটকে অভিনয় করা অজয় মিত্র এখন আর নিয়মিত সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে নিজেকে ঠিক সেভাবে জড়িত রাখলে না পারলেও ভালোবাসার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। বলেছেন, চট্টগ্রাম শহরে বসবাসের সুবাধে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক আয়োজনে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও রাঙামাটির পুরনো সতীর্থ ও সহযোদ্ধাদের সঙ্গে আবারও একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ রয়েছে তার। ভবিষ্যতের কোনো আয়োজনে তাকেও সুযোগ করে দেওয়ার আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেই কথার শেষ করেন রণজিৎ পুত্র অজয় মিত্র।
কুড়ি বছর আগের ‘যৌতুক একটি অভিশাপ’ নামের এই নাটকের পরিচালকের দায়িত্বে যিনি ছিলেন; সেই মনোজ বাহাদুর গুর্খা’ই কুড়ি বছর পরে এসে সেই নাটক প্রদর্শনী আয়োজনের দায়িত্ব নিয়েছেন। রণজিৎ মিত্রের সঙ্গে তাঁর কাজের দিনগুলির স্মৃতিচারণ করেছেন মনোজ। বললেন রণজিৎ দা আমাকে ভীষণ ভরসা করতেন। আমরা এক সঙ্গে অনেক কাজ করেছি সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য। তখনকার সময়ে (২০০৩) এই টেলিফিল্ম তৈরির জন্য এখনকার দিনের মতো অত্যাধুনিক কিছুই ছিলো না। একটি ছোট ক্যামেরা দিয়ে এই কাজটি করেছি। অভিনয়ে অংশ নেওয়া অনেকের মাঝেও ছিল উদ্বেগ; নাটকে অভিনয় করবেন কী করবেন না। সাধারণ মানুষের কটূকথা তো ছিলোই।
মনোজ বাহাদুর বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির জন্য অবদান রেখে যাওয়াদের স্মরণ করতে হবে। নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে। আমরা যদি নতুনভাবে সৃজনশীল কিছু করতে না পারি তাহলে কিছুই হবে না। নিজের সৃজনশীলতা, প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ করতে হবে।’
স্মৃতি কথা’র আয়োজনের সব শেষেই স্মৃতিচারণ করতে মঞ্চে উঠেন রণজিৎ কুমার মিত্রের সহধর্মীনি অনিমা মিত্র। তিনি এক কথাতেই বললেন, “মানুষ বেঁচে থাকেন তাঁর কর্মে”…
সারাবাংলা/এসবিডিই