নৈঃশব্দের শব্দ
১৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৩
মানুষ হয়ে জন্মালে উড়া যায় না, কিন্তু বিজয় সরণির জ্যামে বসে আমি মনে মনে উড়তে থাকি। ইচ্ছে হলেই যেমনি দেড় ইঞ্চি পুরু সেগুন কাঠ ভাঙা যায় না তেমনি আমিও উড়ার ইচ্ছে মনে ধারণ করে একই জায়গায় বসে দরদর ঘামতে থাকি। আকাশটাও যেন আজ পুরুষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, কোম সমঝোতা নেই। ফেব্রুয়ারি মাস, শীতের বদলে মরুভূমির লু হাওয়া বইছে। জ্যামে আটকা পড়ে ভাবছি, এই শহরে বসবাস রত মানুষের জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বোধহয় কেটে যায় এই ট্রাফিক জ্যামে। দীর্ঘ সময় ধরে একটা গাড়িও নড়ছে না, অসহায় মানুষ সব মেনে নেয় নীরবে। এছাড়া পথ পাড়ি দেয়ার অন্য কোন উপায়ও তো নেই। দেশের গুরুত্বপূর্ণ সকল প্রতিষ্ঠান ঢাকা মুখী হওয়ায় মানুষ দলবেঁধে এই শহরের আসে জীবন ও জীবিকার তাগিদে। জ্যামে বসে চারপাশের সুদৃশ্য নানান যানগুলো দেখছি। যানগুলোকে আমার কাছে পোয়াতি নারি মনে হয়, ভেতরে যাত্রীদের তীব্র গতি থাকলেও বাইরে গতি নেই। কেউ কেউ নিজের জায়গা থেকে মাথা বের করে উঁকি মেরে সামনে দেখছে, বুঝার চেষ্টা করছে গাড়ি থামার কারণ। কারো কারো উত্তেজিত কন্ঠস্বরও কানে ভেসে আসছে, সঙ্গে অবিরত হর্ণ তো আছেই। এই শহরের মানুষ অন টাইমে স্কুল, অফিসে যায় কীভাবে? আপনমনে শব্দ করে বাক্যটি আওড়াতেই আমার চালক বললেন, ‘ আপা, মনে হয় কোন ভি.আই.পি যাচ্ছে এই রাস্তায়। ‘ তাঁর কথা শুনে এবার শব্দ না করে মনে মনে বলি, নগরকর্তা যদি নাগরিকের দু:খের কারণ হয় নাগরিকরা দু:খ পোহানো ছাড়া আর কী করবে? এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে চালকের কথাটি আমার কানে অদ্ভূত শোনালেও এটাই বাস্তবতা। নগরকর্তার সুখের পথে, ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্তরায় হয়ে কেউ দন্ড বা প্রাণ দিতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। সকলে তাই নিশ্চুপ বসে আছে। গাড়ির হর্ণ, মানুষের কোলাহল ক্রমশ আমার কান সওয়া হয়ে উঠে। গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষায় থেকে থেকে আমার চোখজোড়া ক্লান্তিতে বুঁজে আসে। সম্ভবত শুধু আমি নয়, দীর্ঘদিন ধরে ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তিটিও নগরকর্তার আয়েশি ভ্রমণের বেঁধে দেয়া জ্যামে পড়ে ঝিমুনি বোধ করছে, এতে কোন সন্দেহ নেই।
‘এসো আমার ঘরে
বাহির হয়ে এসো তুমি যে আছো অন্তরে
স্বপন দুয়ার খুলে এসো অরুণ আলোকে
মুগ্ধ এ চোখে’
খুব ভোরে তমালকে দেখেই মন ভালো হয়ে যায়। গন্তব্যহীন অসীমে চোখ রেখে ও ধ্যানমগ্ন হয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইছে, নিশ্চুপ আমি চোখ বুঁজে নিমগ্ন হয়ে শুনছি। আজ নয়, রোজ সকালেই ওর গান শুনি। আদতে ওর গান শোনার লোভেই খুব ভোরে উঠি। গান শেষ হলে চোখ মেলে দেখি তমাল কেমন ঘোরগ্রস্ত হয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। ভালোমতো আলো ফোটেনি তখনও। ও বলল,
যাবি?
কোথায়?
ফুল তুলতে।
চল।
তমালের হাতে আমি হাত রাখি। ভোরের তিরতির বাতাসে ভেসে ভেসে আমরা চলে যাই শিমুল তলে। লাল শিমুল ছেয়ে আছে পথের উপরে। আমি কোঁচড় ভরে ফুল কুড়াই। ফুলগুলো এমনভাবে কোঁচড়ে বেঁধে রাখি যেন কোন গুপ্তধন রেখেছি। রঙিন লতা, রঙিন পাতা, বর্ণিল ফুল দুলছে ভোরের বাতাসে। এই এক অপার্থিব সৌন্দর্য। ঝিরিঝিরি দক্ষিণা বাতাসে মন মাতানো মহুয়ার মিষ্টি সুবাস এসে নাকে লাগে। খানিক হেঁটে আমরা পৌঁছে যাই মহুয়ার কাছে। মুহুয়ার উঁচু ডালে পাখিদের সমবেত নৃত্য, মিষ্টি স্বর, তমাল কান পেতে শুনছে, দেখছে। দূর কোথাও হতে কোকিলের ডাক আসছে তেড়েফুড়ে। পাখির গান, ফুলের ঘ্রাণ আমাদের মনে আনন্দের হিল্লোল তোলে। আমরা তখন সুখী মানুষ, সুখের সাগরে দু’জন বুঁদ হয়ে থাকি। এক অদ্ভুত ভালোলাগা আমাদের ঝাপ্টে ধরে। যে ভালোলাগায় ভাষা নেই, ভালোবাসা আছে। নৈ:শব্দের ভেতর অপার প্রেমে শব্দহীন আমরা একটি বট গাছের হাঁ মুখে চুপ করে বসে থাকি। আমাদের নি:শ্বাসে ভাসছিলো মহুয়ার ঘ্রাণ, আর অন্য কোথাও লেখা হয়েছিল তখন আমাদের আয়ু। কোলাহল ক্রমশ বাড়ছে। আমাদের পাশ ঘেঁষে শুকনো মুখে রহিম চাচা তাঁর রিকশা নিয়ে যাত্রীর খোঁজে ছুটছেন সামনে। ঠিক এই সময় গাড়ির তীব্র ব্রেক কষায় আমার ঘুম ভেঙে যায়, সঙ্গে স্বপ্নও।
ভি. আই. পি মুভমেন্ট শেষ হয়েছে? নগরকর্তা পৌঁছেছেন গন্তব্যে? ঘুম ভেঙেই চালকের কাছে জানতে চাই। চালকের চোখ ছলছল, মুখে বিষন্নতার ছায়া।
আর বইলেন না আপা, কী যে কষ্টে বাস করি এই দেশে, আমি জানি আর মাবুদ জানেন। উবার চালাই যা পাই তার চল্লিশ শতাংশ দিয়ে দিতে হয় কোম্পানিকে। এরপর গাড়ির মালিককে ভাড়া দিয়ে যা থাকে তা দিয়ে বউ, বাচ্চা নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাই। জ্যাম তো আছেই, তার উপর ভি. আই.পি মুভমেন্টে পড়লে দিন শেষ। ক্যান যে তারা হেলিকপ্টার কিনে না, বুঝি না। তারা হেলিকপ্টারে আসা যাওয়া করলে তাদের অধিনস্ত এই আমরা কিছুটা স্বস্তি তো পেতাম। আপনি তো আজ শুধু জ্যামে বসে ছিলেন আপা, নগরকর্তার ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর এই শহরের মানুষের ভাগ্য নির্ভর করে। নগরকর্তা চাইলে আমরা খাই, না চাইলে অনাহারে থাকি। তার ইচ্ছায় হাসি, তার ইচ্ছায় কাঁদি।
শহর ছেড়ে গ্রামে কেন যাচ্ছেন না? শহরের মতো গ্রামে গিয়ে রোজকার করেন না কেন?
আপা গো চাইলেও তো এই শহর থেকে পালিয়ে যেতে পারি না। নিজের গ্রামে একটা মুদি দোকান দিয়েছিলাম, প্রথম দিকে ভালোই চলছে, পরের দিকে আর বেচা বিক্রি নাই। সংসার চলছে না। গ্রামে আর টিকতে পারলাম না। অগত্যা পেটের দায়ে এই শহরে ছুটে আসি। এই শহরের সঙ্গে ভারসাম্য করতে না পেরে বহুবার ভেবেছি চলে যাব, কিন্তু যাওয়ার কোন জায়গা নেই। বুকের ভেতর পাথর চেপে বেঁচে আছি। টানাহেঁচড়ার সংসারে বউ-বাচ্চার কষ্ট যেন মনের ভেতর ভূমিকম্পের মতো বয়ে যায়।
আচমকা আমার খুকখুক কাশিতে চালকের একনাগাড়ে বলা কথা থামে। মাস্ক দিয়ে নাকমুখ যতই ঢেকে রাখি ঘর থেকে বের হলেই আমার হাঁচি, কাশি শুরু হয়, নাক বন্ধ হয়ে আসে, স্বর পালটে যায়। যদিও এখন করোনা কালীন ভয়াবহ আতঙ্ক নেই, তবুও ঘর হতে বের হলেই ধুলাবালির কবলে পড়ে আমার শারীরিক এমন অসুস্থতার জন্য সবার সামনে অস্বস্তি বোধ করি। ঘরে ফিরে গরম পানি খেলে কিংবা গার্গল করলে পরে স্বস্তি ফিরে পাই। চালকের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া লাগে, কিন্তু কী বলে তাকে স্বান্তনা দেব, ভেবে পাই না। কংক্রিটের এই শহরে মাটিই নাই, স্বপ্নের চারা গজাবে কোথা হতে? এই শহরের মানুষের ইচ্ছেগুলো, স্বপ্নগুলো মাটির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে একসময় মরে যায়। হাজারো শব্দ মনে লুকিয়ে রেখে নি:শব্দ আমি আকাশের দিকে চেয়ে থাকি।
আকাশের শরীরে খন্ড খন্ড সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে, ভেসে ভেসে ওরা কোথায় যাচ্ছে, কে জানে। প্রতীক্ষার প্রহর সবসময় হিসেবের বাইরেই থেকে যায়। ঠিক কতদিন তমালের সঙ্গে দেখা নেই, হিসেব মেলাতে পারি না। কোথা হতে আজ এই জ্যামে তমালের স্বর ভেসে এলো, তমাল এলো আমার স্বপ্নে? জানি না। বিজয় সরণি ছেড়ে কিছুদূর এসে পুনরায় ট্রাফিক সিগনালের সামনে থেমে থাকা গাড়ির ভেতর খাঁচায় বন্দী পাখির মতো ডানা ঝাপ্টাতে থাকি। ‘জীবনে যখন যা আসবে তাকে স্থিরচিত্তে গ্রহণ করবে’ তমাল প্রায়শই আমাকে এই কথাটি বলতো। ওর কথাটি স্মরণে এসে মনের অস্থিরতা দূর করে পেছনের দিকে হেলান দিয়ে আরাম করে বসি। স্বপ্নে তো শুধু তমালের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু বাস্তবে ও আমাকে নিয়ে গেছে আমার মায়ের হাতে বোনা শীতল পাটির মতো শৈশবের কাছে। মানুষ যতই স্বপ্ন ভালোবেসে বাস্তবতা এড়িয়ে চলতে চায়, কিন্তু জীবনের বড়বেলায় বেশীরভাগ মানুষ শৈশবের বাস্তবতাকেই ভালোবাসে। প্রায় সব মানুষের কাছে শৈশব এক আরাধ্য বিষয়। সম্ভব হলে টাইম মেশিনে চড়ে আমি এখনই শৈশবে ফিরে যেতাম। এজন্যই মনে হয় প্রবাদ আছে, যায় দিন ভালো।
অসহ্য বাস্তবতা ভুলে কল্পনায় ডুবে আমার শৈশবে বিচরণ করতে করতে বুক ভরে শ্বাস টেনে নিই। আমাদের বাড়ির উত্তর দিক হতে শীতের সকালে কুয়াশা ভেজা সুপারি বাগান থেকে একটা বন্য গন্ধ এসে জড়িয়ে ধরে, যে গন্ধটি আজকাল বাড়ি গিয়ে আর পাই না। বারান্দায় এ মাথা হতে ও মাথা টেনে দেয়া রশিতে ভাইবোনের জামা-কাপড় স্পষ্ট যেন দুলছে চোখের সামনে। ভাইবোন আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পৃথিবীর নানান প্রান্তে, ওদের গায়ের ঘ্রানটাও পাচ্ছি। ছোট্ট একটা ঘরে আমরা সব ভাইবোন গায়ে গা ঘেঁষে থাকতাম, ঘুমাতাম, একসঙ্গে খেলতাম, ঝগড়া-মারামারিও করতাম। আজ সবাই দূরে, বহুদূরে, আজ আমাদের দেখাও হয় না। একসঙ্গে মার্বেল খেলি না, হাতে-পায়ে আমাদের কাদা লেগে থাকে না। চোখের সামনে যেন পষ্ট দেখতে পাই মা সারাদিনের ক্লান্তি শেষে হারিকেনের টিমটিমে আলোয় বসে চিঠি লিখছেন বাবাকে। এত সময় ধরে মা কী লিখছেন বাবাকে? মশারির ভেতর হতে চেয়ে চেয়ে তা অবাক বিস্ময়ে ভাবতাম। কখনো মায়ের মুখখানা একটু ভার, কখনো বা আহ্লাদী, আমি মুগ্ধ হয়ে মাকে দেখতাম। মা বেঁচে নেই আজ, স্মৃতিতে ভেসে উঠা তাঁর জীবন্ত মুখখানি আমার কষ্ট ভুলিয়ে দেয় কিছুটা। শীতল পাটির মতো সুখময় শৈশব সেই কবে হারিয়ে গেছে, বেঁচে থাকার মানে এখন সম্পূর্ণ অন্যরকম। তমাল স্বপ্নে এসে আমাকে বাস্তবতা থেকে কিছু সময়ের জন্য শৈশবের স্মৃতির কাছে টেনে নিয়ে যায়, আমি সেখানে অবগাহন করি আনন্দে।
দুপুরের গনগনে সূর্য ততক্ষণে বিকেলের বারান্দায় হেলে পড়েছে, সঙ্গে মনের বারান্দায় আমার শৈশবের উত্তাপও কমে এসেছে। বুঝতে পারি, মহাকালের শরীরে বৃত্ত হতে পুনরায় বিন্দুর দিকে হাঁটছি, একদিন নেই হয়ে যাব প্রাকৃতিক নিয়মে। স্বভাবগত ধীরলয়ে স্বপ্নের ব্যালকনিতে এসে তমাল আজ আমাকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ করে এসেছে শৈশবের উঠোন হতে। শৈশবের আদরমাখা স্পর্শে বারবার আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।
আপা, দুই মিনিটের পথ যদি হেঁটে যেতেন। বইমেলার গেইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারতাম না, অনেক ভীড়।
চালকের কথায় ঘোরের রাজ্য হতে বের হয়ে তাঁর পাওনা মিটিয়ে সামনে হাঁটা ধরি। বইমেলার গেইটে পৌঁছাতেই দেখি, কাজল দেয়া মায়া মায়া চোখের লাল ফ্রক পরা একটা মেয়ে ফুলের তোড়া সামনে ধরে জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর গোলাপি মুখের মোলায়েম রেখায় রঙধনুর সাত রঙ খেলছে। ‘ফুল নেন আফা, ফুল নেন আফা, একদাম আশি টাকা তোড়া’ বলে মেয়েটির মুখে হৈ হৈ রব নেই অন্য ফুল বিক্রেতাদের মতো। আমি ওকে নাম জিজ্ঞেস করতেই পাশের জন চেঁচিয়ে উত্তর দিলো, ‘হে কথা বলবার ফারে না, বাবার লগে আইচে। ‘ পুতুলের মতো মেয়েটি কথা বলতে পারে না জেনে বুকের ভেতরটা ধক করে উঠে। ওর শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি, চোখের মণিতে খেলছে একঝাঁক শুভ্র পায়রা। ওর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে মাথা এগিয়ে দিই, ও নিজ হাতে আমার মাথায় ফুলের তোড়া পরিয়ে দেয়। পাওনা বুঝে পেয়ে মেয়েটি মাছের পোনার মতো মানুষের ঝাঁকের ভেতর আমার দৃষ্টির বাইরে চলে যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে বসন্ত আর ভালোবাসার রঙ নিয়ে রঙিন সব আয়োজন দেখতে দেখতে কীভাবে যে মানুষের স্রোতে ভেসে ভেসে বইমেলায় ঢুকে পড়েছি, মনে নেই। জনসমুদ্রে তখনো কোথা হতে যে কোথা যাচ্ছি, তাও জানি না। উদ্দেশ্যহীন হাঁটছি আর মানুষের উঁচু উঁচু মাথা ডিঙিয়ে হণ্যে হয়ে ওই ফুল বিক্রেতা এঞ্জেল মেয়েটিকে খুঁজছি।
আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। অন্যদিনের চেয়ে বইমেলায় আজ মানুষের অতিরিক্ত ভীড় দেখে প্রথমে হাসফাস লাগলেও স্টলে এসে ভালো লাগছে এই ভেবে যে, আজ হয়ত কিছু বই বিক্রি হবে। পরিচিতজন ছাড়া তেমন কাউকে বই কিনতে দেখি নি, তবে শুনেছি আমার অনুপস্থিতিতে কয়েকটা বই বিক্রি হয়েছে। তাঁরা কে, জানি না। মনে মনে তাঁদের প্রতি অন্তর্ময় শুভেচ্ছা জানাই। আজ নিশ্চয়ই কোন পাঠক পাবো, এই ভাবনায় বিভোর হয়ে ঠান্ডা পানির বোতলে চুমুক দিই। মানুষের ঢলে স্টলের ভেতর নিজের নি:শ্বাসকেই যেন উত্তপ্ত রাইস কুকারের বাষ্পের মতো মনে হয়। পরিচিত কয়েকজন প্রতিষ্ঠিত প্রবাসী লেখকের বই স্টলে কিনতে গিয়ে খুঁজে না পেলেও ব্যাক্তিগত উপস্থিতির কারণে স্টলে আমার বইটি সামনের সারিতে জায়গা পায়। অচেনা কেউ এসে যখন আমার বইটি হাতে নেয়, পৃষ্ঠা উল্টে দেখে, আনন্দে তখন আমার প্রাণ ভোমরা নেচে উঠে। বইটা উল্টেপাল্টে দেখে যখন তাঁরা আবার জায়গামতো রেখে দেয় তখন মনটা বেদনায় নিমজ্জিত হয়। দিনের আলো নিভু নিভু, বিকেল বেলাটা এভাবে কেটে যায়। না, কোন পাঠকের সঙ্গে আজ আমার সাক্ষাৎ ঘটে নি। মনের গোপন আনন্দ মনেই ফুল হয়ে ফুটেছে, অত:পর নিভৃতে ঝরেছে। পাঠকের মমতা বঞ্চিত পড়ে থাকা নিজের বইয়ের হাহাকার দেখতে ভালো লাগছিল না আর।
নেতানো মনে স্টলের বাইরে এসে দাঁড়াই খোলা আকাশের নিচে। যথা নিয়মে মানুষের উপচে পড়া ঢল দেখছি। কেউ গরমে আইসক্রিম খাচ্ছে, কেউবা চটপটি, ফুসকা, বেলপুরি। কারো হাতে ধোঁয়া উড়া কফি। ডান দিকের লেকের পাশে এলাহি কান্ড। কেউ ভালোবেসে প্রিয়জনের মাথায় তাজা ফুলের তোড়া পরিয়ে দিচ্ছেন, কেউবা নানান এঙ্গেল হতে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তুলছেন প্রিয় মানুষের ছবি। একই রঙের ড্রেস পরা বন্ধুরা দলবেঁধে হাঁটছে, গল্প করছে। প্রায় সকলের হাতে গরম চিকেন পেটিস, শর্মা, ঝালমুড়ি, আরো কত কী। অনেক বছর পর দেশে এসে অনেক খাবারের নামও ঠিকমতো জানি না। চতুর্দিকে ক্যামেরা তাক করা, ইন্টারভিউ দিচ্ছেন, কথা বলছেন লেখকরা। বন্ধুটি কেন বান্ধুবীর ড্রেসের সঙ্গে মিলিয়ে একই রঙের ড্রেস পরে নি এই নিয়ে তুমুল কথা কাটাকাটি কানে ভেসে আসতেই পাশ ফিরে দেখি দু’জনের মুখ গোমড়া। এর উল্টোটাও দেখেছি, দুই বন্ধুর কথোপকথন এতটাই রোমান্টিক আর গাঢ যে বাধ্য হয়ে জায়গা বদলেছি। একটু দূরে তাকিয়ে দেখি, স্টলের সামনে জটলা বেঁধে বই হাতে কেউ কেউ ছবি তুলছে, ছবি তোলা শেষে বইটি পুনরায় জায়গামতো রেখে হাঁটা ধরছে। এসব দেখে বড্ড হোঁচট খাই। অচেনা এক অন্ধকার জমে চোখের পাতায়। আবেগ – উচ্ছ্বাসহীন আমি উদ্দেশ্যহীন হাঁটতে হাঁটতে নিজের স্টল ছেড়ে বহুদূর চলে আসি। বুকের ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।
সময় তার নির্দিষ্ট গতিপথে সামনে চলতে থাকে। মেলা ভাঙার আগ মুহূর্তে মানুষের উত্তাল স্রোত ক্রমশ কমে এলে বাতাসের একটা ঠান্ডা স্পর্শ লাগে শরীরে, ভালো লাগে। এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে কয়েক হাত দূরে ঝিঙেফুল স্টলের সামনে চোখ আটকে যায় একটি স্বর্গীয় দৃশ্যে। দেখি, কথা বলতে না পারা বিকেলের সেই ফুল বিক্রেতা মেয়েটির হাত ভর্তি বই, বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া ওর বৃদ্ধ বাবা লাঠিতে ভর করে পকেট থেকে টাকা বের করে বইয়ের দাম পরিশোধ করছেন। আমি স্টাচুর মতো দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বাবা-মেয়ের নৈঃশব্দের অপূর্ব সেই দৃশ্য হৃদয়াঙ্গম করলাম। আমার প্রিয় বর্ণমালারা তখন ঝরনার মতো শোঁ শোঁ শব্দে আমার কানের পর্দায় ঝংকার তোলে। সেই সুর মাধুর্য আমাকে মোহিত করে তোলে। পাখির মধুর সংগীতের মতো একটা অপূর্ব মিষ্টি ছন্ধোবদ্ধ ধ্বনি শুনতে পাই হৃদয়ের গহীনে। একান্তে কান পেতে শুনি, বাতাসে প্রবাহিত হচ্ছে এক মন্দ্রিত কন্ঠস্বর। আমি চমকে উঠি, এমন মধুর স্বরে কে কথা বলে? হঠাৎ একটা রাতচরা পাখি একনাগাড়ে বিচিত্র সুর তুলে ডানা ঝাপটিয়ে আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। পাখিটির দিকে তাকিয়ে মনে হলো ও আমার দিকে ঘাঢ ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নিলো।
সারাবাংলা/এসবিডিই