অস্তিত্ব
১৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৫
এগারোজন মানুষ আগুনের নীরবতায় এক অপরকে সহ্য করছে।
তিনজন নারী বাকি আটজন পুরুষ। আটজন পুরুষের মধ্যে পাঁচজন সৈন্য। দুজন বেসামরিক নাগরিক। পাঁচজন সৈন্যর একজন ক্যাপ্টেন দীদার। সুন্দর গোলগাল মুখ। নাকের নিচে হালকা কালো গোফ। ছিমছাপ পেটানো শরীর। হাতে একটা ছোট্ট কিন্তু সুদৃশ্য লাঠি। মাঝে মাঝে হাতের লাঠিটি নাড়ানোয় নি:শব্দ ক্ষমতার একটা দাপট প্রকাশ পাচ্ছে। চারজন সৈন্যর দুই জন রুমের ভেতরে রাইফেল তাক করে দাঁড়িয়ে। অন্যদুজন রুমের বাইরে অপেক্ষা করছে। বলাই যায়, তারাও প্রস্তত যে কেনো এ্যাকশনের জন্য।
বেসামরিক নারী পুরুষের কেউ কথা বলছে না। বলছে না মানে বলতে পারছে না। প্রত্যেকের জীহ্বা আড়ষ্ঠ। বিশেষ করে বাড়ির কাজের লোক খাদেম লুঙ্গি ভিজিয়ে দিয়েছে। প্রবাসের টাটকা গন্ধ সারাটা রুমে স্যাঁতসেঁতে শ্বেত আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছে। বাড়ির কর্তা খবিরউদ্দিন বসে আছেন স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের পাশে, সোফায়। দুজনেই কাঁপছেন। বারে বারে জীহ্বা দিয়ে ঠোট চেটে ভেজানোর চেষ্টা করছেন আনোয়ারা বেগম। আনোয়ারার পাশে বসেছে কায়েস। নবম শ্রেণীর ছাত্র। নাকের নিচে গোফের রেখা হালকাভাবে দেখা দিয়েছে। কায়েস বারে বারে মেজর দীদারের দিকে তাকায়, ঠিক দীদারের দিকে নয়, দীদারের হাতের লাঠিটার দিকে। লাঠিটা সুন্দর.. চকচকে।
আর মাত্র পাঁচ মিনিট- মেজর দীদারের ভরাট গলা। দরজায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরিয়ে বেশ আয়েশ করে টানতে টানতে রুমের মধ্যে একটা চক্কর দিয়ে দাঁড়ায় লায়লা আর নায়লার সামনে। মুখের ধোয়া উগড়ে দেয় দুই বোনের মুখের উপর। সিগারেটের ধোয়া একদম সহ্য করতে পারে না নায়লা। খুক খুক কাশতে থাকে। কাশতে কাশতে চোখে পানি আসে ওর। ওড়না দিয়ে মোছে চোখ। মৃদু হেসে মেজর দীদার একটু সরে দাঁড়ায় দরজার দিকে, চোখ রাখে খবিরউদ্দিনের উপর, তুমি বলছো তোমার ছেলে বাহার কোথায় জানো না?
ঘাড় নাড়েন খবিরউদ্দিন, অফিসার সত্যি বলছি আপনাকে। আমি সরকারের একজন কর্মকর্তা। পড়াই কলেজে। আপনিও সরকারের লোক-
তুমি কেমন বাপ? কথা থামিয়ে কর্কশ গলায় বলে দীদার-নিজের ছেলের খবর রাখো না? ছেলে জন্ম দেয়া যেমন ফরজ তেমন তাদের খবর রাখাও ফরজ। কিন্তু আমি জানি তুমি সত্যি বলছো না।
ভেঙ্গে পড়ে খবিরউদ্দিন, আপনাকে সত্যি বলছি।
আবার মিথ্যা কথা? পলকে ঘুরে এসে খবিরউদ্দিনের গালে প্রচ- শক্তিতে চর মারে দীদার। মনে হলো পুরো কক্ষটার ভেতরে একটা বজ্রপাত হলো। আনোয়ারা বেগম দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন খবিরউদ্দিনকে। কায়েস উঠে বাবার কাছে আসতে চাইলে দীদারের ইঙ্গিতে একজন সৈন্য ওর চুল ধরে আগের জায়গায় বসিয়ে দেয়। নায়লা আর লায়লা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। দীদার দুজনের সামনে একেবারে বুকের উপর দাঁড়ায় প্রায়, ওরা দুহাতে মুখ ঢেকে সোফায় বসে। মেজর দীদারের মুখে জান্তব হাসি। সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে। টানতে টানতে রুমের মধ্যে হাঁটছে। হাঁটায় বুটের ধাতব শব্দে পুরোটা কক্ষ কেঁপে উঠছে। প্রচুর ধোয়া ছাড়ে মুখ থেকে। মনে হচ্ছে এটা তার একটা খেলা। ধোয়া ছাড়তে ছাড়তে আবার দাঁড়ায় খবিরউদ্দিনের সামনে, সাচ বাতাও- কোথায় তোমার ছেলে?
মেজরের দিকে খবিরউদ্দিন একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে রাখেন। ভয়ে বিবর্ন তিনি। তির তির ঠোঁট কাঁপছে। কয়েক মাস ধরে এদের অত্যাচার শুনে আসছেন, পথে পথে লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। আজ সেই আতঙ্ক তার ঘরে? তার মুখের উপর?
বুঝতে পারছি, তুমি সত্যি বলবে না। কিন্তু আমরা জানি তোমার ছেলে বাহার ভারতে ট্রেনিং নিয়েছে। এখন যুদ্ধ করছে কুমিল্লায়। গত মাসের আঠাশ তারিখে বাসায় এসেছিল ভিখেরি সেজে। মি খবিরউদ্দিন, কি আমি ঠিক বলেছি না মিথ্যা বলেছি?
খবিরউদ্দিন, আনোয়ারা বেগম, লায়লা, নায়লা, কায়েশ- বুঝে গেছে বাড়িটার উপর নজর ছিল ওদের আগে থেকেই। কিন্তু এখন কি করবে? খবিরউদ্দিন অনেক দিন পর ছেলেকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। কলিংবেল টিপলে দরজা খুলে দিলে সামনে দাঁড়ানো দাড়ি গোফে ঠাসা মুখ দেখে বাহারকে চিনতে পারেননি। পড়নে ময়লা জামা। ছেঁড়া প্যান্ট। কাধে ততধিক ছেঁড়া ব্যাগ। ব্যাগের ভিতরে ছিল স্টেনগান। খবিরউদ্দিন দরজা বন্ধ করতে গেলে বাহার হাসে, বাবা আমি।
হাসি দেখে এবং কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারে, সামনে দাঁড়ানো ভিক্ষুক নয়, বাহার। বাহারউদ্দিন ধানমন্ডি ছাত্রলীগের সভাপতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যামিস্ট্রির শেষ বর্ষের ছাত্র। গত দুটি বছর ক্লাস করার চেয়ে মিছিল আর মিটিং নিয়ে ব্যস্ত ছিল। এসব নিয়ে বাসায় প্রায় প্রতিদিন ঝগড়া হতো। কিন্তু বাসার সবাই বাহারকে সাপোর্ট করতো। তিনিও করেন, এ সময়ে সাপোর্ট না করে থাকতে পারে কোনো বাঙালি? কিন্তু তিনি শিক্ষক মানুষ। সারা জীবন ছাত্র পড়িয়ে চলেছেন। খবিরউদ্দিন চান, আগে লেখাপড়া পরে আন্দোলন, পিকেটিং, হরতাল, শ্লোগান, মিছিল। কিন্তু বাহারের বেলায় ঘটনা ঘটেছে উল্টো। আগে মিছিল মিটিং শ্লোগান, পরে লেখাপড়া। মিছিল মিটিং শ্লোগানের ফলাফলে নেমে এলো কেয়ামত, পাকিস্তানী জান্তার অপারেশন সার্চলাইট।
জান্তার অপারেশন সার্চলাইটের মাত্র মাস খানেকের মাথায় বাহার হাওয়া। বুঝতে পেরেছেন খবিরউদ্দিন, ছেলে যুদ্ধে গেছে। একদিকে গর্ব বিপরীত পিঠে ভয়, ভয় আর ভয়। বাড়িটা ধানমন্ডির তিন নম্বর রোডে। পীলখানার নাকের ডগায়। তিনতলা বাড়ি করেছেন। রিটায়ার্ড করেছেন বছর তিনের আগে। রিটায়ার্ডের টাকায় বাড়িটা কেনোভাবে করতে পেরেছেন। বাহার পাশ করে চাকরিতে ঢুকলে আর চিন্তা নেই। ভাবনা মেয়ে দুটিকে নিয়ে। বড় মেয়ে লায়লা বিএ পড়ছে। আর কয়েক মাস পর ফাইনাল পরীক্ষা। বিয়ের প্রস্তাব আসছে। আনোয়ারা বেগমের একটাই কথা, মেয়ের বি এ পরীক্ষার আগে বিয়ে নিয়ে কোনো কথা নয়।
খবিরউদ্দিনও প্রস্তাবটাকে যথার্থ মনে করে চুপ করে আছেন। বন্ধু, একই কলেজের ইংরেজির শিক্ষক শফিউর রহমান তার ছেলের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন। ছেলেটা সিএসপি অফিসার। সবই ঠিক আছে তবে ছেলেটা একটু খাটো। মানে লায়লার প্রায় সমান। কিন্তু দেখতে সুন্দর। আনোয়ারা বেগমের এখানেই একটু আপত্তি।
মেয়ের চেয়ে জামাই ছোটো হলে কেমন লাগবে দেখতে?
আরে ছোটো না, সমান সমান- বোঝানোর চেষ্টা করেন খবিরউদ্দিন।
ছেলের চেয়ে মেয়ে একটু খাটো হয়, কিন্তু এখানে একেবারে উল্টো-দুজনকে এক সঙ্গে দেখতে ভালো লাগবে না।
আচ্ছা, সে পরে হবে। আগে তো লায়লা বি এ পরীক্ষা দিক- আপতত লায়লার বিয়ের ব্যপারটাকে চাপা দিয়ে রাখলেও এখন আর কিছুই চাপা দিয়ে রাখতে পারছেন না। চারদিকে দগদগে আগুন জ্বলছে। খবিরউদ্দিন সহজ সরল মানুষ। তিনি ছেলের সঙ্গে অনেক দিন তর্ক করেছেন, তোরা এমন করে জ্বালানো পোড়ানো শুরু করলি কেনো?
মানে? বাহার অবাক চোখে তাকায়।
এই যে মিছিল মিটিং করছিস, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কথা বলছিস, এটা কি ঠিক হচ্ছে?
তুমি আমাকে ঘর থেকে বের হতে দেবে না, আমার মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে আর আমি বসে থাকবো? বসে বসে মার খাবো?
বসে থাকবি কেনো? অন্যায় হলে নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করবি। কিন্তু এই রাষ্ট্রটার জন্যতো আমরা লড়াই করেছি। আমি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র ছিলাম, পাকিস্তানের জন্য আমি মিছিল করেছি না? কেবল আমি একা, আমার মতো অনেক বাঙালি মুসলমান দিন রাত মিছিল মিটিং করেছে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে-
তোমার কষ্ট বুঝি বাবা। কিন্তু নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কি আমরা পাইনি?
চশমার কাচ মুছতে মুছতে জবাব দেন খবিরউদ্দিন, হ্যাঁ। ওদের মানে পশ্চিম পাকিস্তানের উচিৎ শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা দেয়া।
কিন্তু সেটা ওরা কেনোদিনও দেবে না। আর যদি না দেয়, ভাঙন অনিবার্য।
আঁতকে ওঠেন কবিরউদ্দিন, বলিস কি তুই?
হাসে বাহার, বাঙালি এখন এর চেয়ে কম কোনো কিছুতে থামবে না বাবা। কিন্তু তার জন্য আমাদের প্রাণ বিসর্জনসহ অনেক ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এখানে প্রাণ বিসর্জন দেয়ার প্রসঙ্গ কেনো আসছে?
ওরা কি এমনি এমনি ছেড়ে দেবে মনে করছো? মোটেই না, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমান বোঝাই করে সৈন্য আর অস্ত্র আসছে কি শান্তির পতাকা ওড়াতে? মোটেই না- ওরা আমাদের ম্যাসাকার করবে।
্এইটা তোদের বাড়াবাড়ি বাহার। পাকিস্তান- পূর্ব আর পশ্চিম মিলে একটি রাষ্ট্র। আমরা একই দেশের নাগরিক, আমাদের ওরা মারবে কেনো?
মারবে এই কারণে আমরা যে স্বাধীনতা চাইছি।
ক্ষেপে ওঠেন খবিরউদ্দিন, কিসের স্বাধীনতা? শেখ মুজিব কি স্বাধীনতা চাইছেন?
তুমি ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় অধ্যাপক, সাহিত্য বোঝো কিন্তু পলিটি´স বোঝো না। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বোঝো?
বুঝবো না কেনো?
না, একদমই বোঝো না। তোমাকে একটি দফার সর্ম্পকে বলি, ছয় দফার একটা দফা হচ্ছে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আলাদা আলাদা কারেন্সি মানে টাকা থাকবে। অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রের মধ্যে দুই ধরনের টাকা। একটি রাষ্ট্রের দুই ধরনের টাকা থাকে, শুনেছো কোনো রাষ্ট্র ব্যবস্থায়?
খবিরউদ্দিন বিভ্রান্ত চোখে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে, কি বলছে বাহার? সত্যিইতো একটি রাষ্ট্রে দুই ধরনের টাকা থাকে কি করে? দুই ধরনের টাকা থাকা মানে-দুইটি রাষ্ট্র!
বিড়বিড় করেন খবিরউদ্দিন, কি ভয়ানক পরিস্থিতি!
বঙ্গবন্ধু বিপ্লবী নেতা নন, তিনি নিয়মতান্ত্রিক নেতা। ধীরে ধীরে পথ তৈরী করেছেন স্বাধীনতার। এখন চলছে অসহযোগ আন্দোলন। স্বাধীনতা অনিবার্য। তবে হ্যাঁ তার জন্য জীবন দিতে হতে পারে। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয়-স্বাধীনতা রক্ত চায়। রক্তপানের ভেতর দিয়ে স্বাধীনতা পূর্ণতা অর্জন করে।
আমি বিশ্বাস করি না পাকিস্তানের নেতারা এমন করতে পারে।
বাবা, তোমাকে একটা কথা বলি, পাকিস্তান মানে বিশ্বাসঘাতক।
চায়ের ট্রে হাতে ঢোকেন আনোয়ারা বেগম, তুই তোর বাবাকে বুঝিয়ে পারবি না। সে আছে তার কলতাকার মিছিল নিয়ে। নে, চা খা। বাইরে যাবি নাকি?
হ্যাঁ, আমার বন্ধুরা আসছে। ওরা দুপুরে খাবে। বিকেলে বটতলায় মিটিং। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হবে।
তোদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে, চিৎকার করতে গিয়ে গলাটা হঠাৎ ভেঙ্গে যায় খবিরউদ্দিনের। কিসের স্বাধীনতার পতাকা!
স্বাধীনতার পতাকা মানে স্বাধীনতার পতাকা- হাসতে হাসতে জবাব দেয় বাহার। কথার মাঝখানে ঢোকে লায়লা।
জানো বাবা, আজকে আমরা ট্রেনিং নেবো।
কিসের ট্রেনিং?
রাইফেল চালানোর।
কোথায় পাবি রাইফেল?
বাবা, তুমি চিন্তা করো না। বাহার চায়ে চুমুক দেয়, আজ পল্টন ময়দানের আমাদের মেয়েরা কাঠের ডামি রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নেবে।
মা যাই! লায়লা চোখে মুখে প্রচ- উচ্ছাস নিয়ে চলে যায়। খবিরউদ্দিনের সামনে ধূমায়িত চা। আনোয়ারা ঢোকেন রান্না ঘরে, রান্নার আয়োজনে। ছেলের মিছিলের বন্ধুরা আসবে। যা পরিশ্রম করে ওরা, ছেলেরা ভালো খাবারের আয়োজন করা দরকার। চা ঠা-া হয়ে গেছে। রুমে একা খবিরউদ্দিন। তিনি কোনো হিসাব মেলাতে পারেন না। দেখেতে পাচ্ছেন, আকাশ বাতাস মাঠ ঘাট পথ প্রান্তর পার হয়ে আসছে আগুন, আগুনের তীব্র দাহ। তিনি পুড়ে যাচ্ছেন। চিৎকার করে আগুন বন্ধ করতে বলছেন, কিন্তু কেউ শুনছে না। বরং আরও উৎসাহের সঙ্গে আগুনের লেলিহান শিখা তাকে গ্রাস করছে। তিনি টেবিলে রাখা জগ থেকে পর পর দু গ্লাস পানি পান করলেন। কিন্তু পানি তাকে আগুনের আঁচ থেকে রক্ষা করতে পারলো না, ঘরের ভেতরে পাকিস্তানী সৈন্য। যে পাকিস্তানের জন্য তিনি মিছিল করেছিলেন ত্রিশ বছর আগে কলকাতার রাস্তায়। সেই পাকিস্তানের সৈন্য তাকে থাপ্প্র মারছে, তারই ঘরের ড্রয়িংরুমে। তিনি কিছু করতে পারছেন না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছেন নগ্ন অপমান।
বাসায় বাহার মাত্র কয়েক ঘন্টা ছিল। সবাই ওকে জড়িয়ে ধরেছে কেঁদেছে। বাহার হাসতে হাসতে ফিসফিসিয়ে বলেছে, বাবা আমি বলেছিলাম না, স্বাধীনতা রক্ত চায়। এবার আমাদের রক্ত দেয়ার পালা। কেবল কি রক্ত? অনেক অপমান, অনেক যন্ত্রনাআমাদের সহ্য করতে হবে, তোমরা সাবধানে থেকো। আর একটা কথা, কাউকে বিশ্বাস করবে না এখন। সব জায়গায় ওদের এজেন্ট আছে-
দ্রুত কিছু খাবার দেয় আনোয়ারা বেগম, খেয়ে মা এবং বাবার পায়ে চুমু খেয়ে বোন দুটি আর ভাইকে আদর করে চলে যায়। খবর পেয়ে বাসায় চলে আসে জল্লাদ। জল্লাদের হাতে মার খেয়েও মনে মনে খুশি খবিরউদ্দিন, বাহারকে পায়নি ওরা।
শোনো, মেজর দীদারের গলা- আমি ইচ্ছে করলে এখনই তোমাদের মেরে ফেলতে পারি। কিন্তু মেরে ফেললে আমার আর ইসলামী পাকিস্তান বাহিনীর লড়াই কে দেখেবে? তাই তোমাদের বাঁিচয়ে রাখবো। আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে এসেছি, আমাদের বিবি রয়ে গেছে দেশে। কওমের মানুষ হিসেবে আমাদের চাহিদা পূরণ করা তোমাদের দায়িত্ব, শুধু দায়িত্ব নয় ফরজ। এখন বলো কোন কন্যা যাবে আমার সঙ্গে? যেনো রসালো কোনো কথা বলছে মেজর, মুখে মৃদু হাসি ধরে রেখে দীদার তাকায় খবিরউদ্দিনের দিকে, তুমি পিতা। জন্ম দিয়েছো, পালন করছো, তোমার কাছ থেকে নিমিমাম একটা অনুমতিতো নিতেই হয়। কি বলো তোমরা?
তাকায় মেজর ওর সঙ্গের সৈন্যদের দিকে। প্রত্যেকের চৌকো মুখে খাদকের হাসি বিস্তার করে।
দেখো আমরা কতো ভদ্র, তোমার মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছি তোমার অনুমতি নিয়ে। অথচ ভারতসহ তামাম দুনিয়ার সংবাদপত্র রেডিও আমাদের বদনাম করছে, আমরা নাকি ধর্ষণ করছি! ছি, ইসলামে ধর্ষণ হারাম। তাকায় কোনায় দাঁড়ানো সৈন্যর দিকে- আমি ঠিক বলেছি?
আলবদ স্যার- পাথর মুখো জবাব দেয় চটপট।
রাইট, তাকায় খবিরউদ্দিনের দিকে, কি হলো অধ্যাপক তুমিই সিদ্ধান্ত দাও। কাকে নেবো?
জীহ্বা দিয়ে একটা কুৎসিৎ শব্দ করে দীদার। তাকায় লায়লা আর নায়লার দিকে কদাকার কামনার কুৎকুতে চোখে। মনে হচ্ছে চোখ নয়, লাভার কুণ্ডলি।
লায়লা বুঝে ফেলে, কি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। শরীর হিম হয়ে আসে। ডান হাতে খামছে ধরে নায়লার হাত। খবিরউদ্দিন বোবা চোখে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টিতে প্রিয় পাকিস্তানের জন্য হাজার হাজার মানুষের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন, আকাশের দিকে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলছেন, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান…। সেই পাকিস্তানের সৈন্য তার ঘরে, তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত নামিয়ে আনছে।
হাতে সময় নেই, হুংকার দেয় দীদার। কাকে নেবো? শোনো অধ্যাপক, ইসলামী পাকিস্তানের সৈন্যরা কোনো বেইনসাফী কাজ করে না। তোমার কন্যাকে নিয়ে শাদী করবো। শাদী করার পর… চিন্তার কিছু নেই, আমাদের ক্যাম্পে নতুন শাড়ি চুড়ি গহনা সব আছে। আমাদের মাওলানা আছে- সেই শাদী পড়াবে, বলো, কাকে নেবো?
খবিরউদ্দিনের ড্রয়িংরুমে অনেক মানুষ কিন্তু নেমে এসেছে পাথরের নীরবতা। মনে হচ্ছে, কেউ মানুষ নয়, পাথর। কারো কোনো মানুষের অভিব্যক্তি নেই। শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ নেই। দূরে ঠা ঠা ঠা… রাইফেলের শব্দ ভেসে আসে। সঙ্গে সঙ্গে মেজর দীদারের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্য আসে। তাকায় নিজের সৈন্যদের দিকে- মুহুর্ত মাত্র দাঁড়ায়, নবম শ্রেণী পড়–য়া নায়লার সামনে, এ ঝটকায় হাত ধরে টেনে তোলে, এই লাড়কি, তুমি চলো আমার সাথ।
কি যে হয় লায়লার নিমিষে দাঁড়ায় দীদারের সামনে, ওকে নয়। আমাকে নিন। ও ছোট। সহ্য করতে পারবে না।
গোফের নীচে চকচকে ধারালো দাঁত বের হয় দীদারের, মনে হয় এই রকম এক নাটকীয় মুহুর্তের জন্য সে অপেক্ষা করছিল সে। নায়লার হাত ছেড়ে ধরে লায়লার হাত, বহুত খুব। চলো…।
লায়লাকে এক প্রকার উড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় ইসলামী পাকিস্তানের মেজর দীদার। পেছনে পেছনে যায় রুমের অন্যান্য সৈন্যরা উদ্যত সঙ্গীন হাতে। সিঁড়িতে শোনা যায় ভারী বুটের কর্কশ শব্দ। খবিরউদ্দিন, আনোয়ারা বেগম, কায়েস, নায়লাদের মনে হয়, এতোক্ষণ একটা নাটকের মহড়া দেখেছে। মহড়ার অংশ হিসেবে লায়লা কক্ষের বাইরে গেছে। এখনই ফিরে আসবে হাসতে হাসতে…। বলবে, নাটকে যা ঝক্কি…। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সবাই শুনলো নিচে একটা গাড়ির স্ট্রাটের শব্দ। জলপাই রঙ গাড়িটি সন্ধ্যার কিছু পরে খবিরউদ্দিনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। দূরে গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বুভুক্ষ কান্নায় ভেঙে পড়ে ত্রিশ বছর আগে কলকাতার রাস্তায় মিছিলের মানুষ খবিরউদ্দিন, আনোয়ারা বেগম, নায়লা আর কায়েস।
সেই কান্নার হাহাকার এখনও ছড়িয়ে আছে গোটা বাংলায়, সাড়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের অস্তিত্বে।
সারাবাংলা/এসবিডিই