Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের অস্তিত্ব

আবু আফজাল সালেহ
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:০৫

‘স্বাধীনতা তুমি/ রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।/ স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-/ স্বাধীনতা তুমি/ শহীদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা…স্বাধীনতা তুমি/…যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা (স্বাধীনতা তুমি, শামসুর রাহমান)।’ ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাংলা সাহিত্য নতুন বাঁক নেয়। কবিতাসাহিত্যে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়। মহান ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ আন্দোলন বা আগে পরের বিভিন্ন পরিক্রমার পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করেছি। এক্ষেত্রে বাংলাসাহিত্যের কবিতার ভূমিকা অনেক। বিশেষকরে সত্তর দশকের কবিতায় পাকিস্তান শাসন বিরোধী অবস্থান বেশি ফুটে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

কবি শামসুর রাহমান ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন- ‘নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়…আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গড়ে পলে পলে,/তাইতো ত্রিলোক আজ সুনন্দ জাহাজ হয়ে ভেড়ে/আমারই বন্দরে(বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা/সংক্ষেপিত)’ । ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘‘আসাদের শার্ট’’ কবিতাটি-‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো কিংবা সূর্যাস্তের/ জ্বলন্ত মেঘের মতো আসাদের শার্ট/ উড়ছে হাওয়ায় নীলিমায়/…আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/ সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক ;/ আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা’।

বিজ্ঞাপন

কবি নির্মলেন্দু গুণ খুব সুপটুভাবে কবিতায় সেই সময়কে ধরে রাখেন বাঙালিকে উজ্জীবনীরস সঞ্চার করে। সেদিনের সেই ঊনিশ মিনিটের অমর কাব্যধর্মী ভাষণের চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ আমাদের বলছেনÑ‘তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,/ হৃদয়ে লাগিল দোলা,/ জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।/ কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণ সূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনাল তাঁর অমর কবিতাখানি :/ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। শহীদ কাদরী ভিন্নধারার কবি। তিনিও কবিতা লিখলেন-উত্তপ্ত পরিস্থিতি নিয়ে, অন্যায় আর অবিচারের প্রতি তাঁর কবিতায় যোগ হলো দৃপ্ত উচ্চারণ। যেমন ধরি- ‘–‘মধ্য-দুপুরে, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে, একটা তন্ময় বালক/কাচ, লোহা, টুকরা ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ/ একফালি টিন/ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক জড়ো করলো এক নিপুণ/ ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো/ এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই/ প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অক্ষর/ ‘স্বা-ধী-ন-তা’ (নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, শহীদ কাদরীর কবিতা)।’’

কবি রফিক আজাদ। মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো বিকল্প নেই বলে উচ্চারণ করেছেন ‘‘একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ’’Ñ‘তোমার মুখে হাসি ফোটাতে দামি অলঙ্কারে সাজাতে/ ভীরু কাপুরুষ তোমার প্রেমিক এই আমাকে/ ধরতে হল শ হাতে মর্টার, মেশিনগান-/ শত্রুর বাংকারে, ছাউনিতে ছুড়তে হল গ্রেনেড/আমার লোভ আমাকে কাপুরুষ হতে দেয়নি’। সিকান্দার আবু জাফর এর অমর কবিতা-‘জনতার সংগ্রাম চলবেই/ আমাদের সংগ্রাম চলবেই/…প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত/ হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত/ অবিরাম যাত্রার চির সংঘর্ষে/ একদিন সে পাহাড় টলবেই/ চলবেই চলবেই/ জনতার সংগ্রাম চলবেই…(সংক্ষেপিত)’। পরে ক্ষোভের মাত্রা বেড়ে গেলো কবির। কবিতায় প্রকাশ করলেন শক্ত ভাষায়। উগরে দিলেন ক্ষোভ আর বঞ্চনা। আল্টিমেটাম দিলেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতায় উচ্চারণ করলেন এভাবে-‘তুমি আমার জলস্থলের/মাদুর থেকে নামো/তুমি বাংলা ছাড়ো।’

শক্তিমাণ সাহিত্যিক ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক-প্রবন্ধের পাশাপাশি রণাঙ্গণের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কবিতা রচনা করেছেন। ‘গেরিলা’ শিরোনামসহ সে সময়ের বেশ কিছু কবিতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান ও বিভিন্ন অনুষঙ্গ কবিতায় উচ্চারণ করেছেন। কবি রফিক আজাদের একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মসমর্পণ কবিতাটি ঠিক এমনÑ‘হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা কররাম/বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে/ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে/টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালি স্বপ্নকে’।

কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, রফিক আজাদ, নির্মলেন্দু গুণ,শহীদ কাদরী, মুহাম্মদ নূরুল হুদা, দাউদ হায়দার, আবুল হাসান, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, কামাল চৌধুরী, আবু হাসান শাহরিয়ার, হাসান হাফিজ, মাহবুব হাসান, নাসির আহমেদ, মাশুক চৌধুরী, ইকবাল আজিজ, জাহিদ হায়দার, সৈয়দ হায়দার, আবিদ আনোয়ার, মিনার মনসুর প্রমুখ কবির কবিতায় উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ। কোনো কোনো কবির মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতাও উঠে এসেছে। আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার রক্তজবার মতো উচ্চারণ করেছেন অনেক কবি তাদের কবিতায়। কিছু কবিতাংশ-

(১) ‘‘কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/আমি আর লিখবো না/বেদনার অঙ্কুরিত কষ্টের কবিতা/কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/ভজন গায়িকা সেই সন্ন্যাসিনী সবিতা মিস্ট্রেস/ব্যর্থ চল্লিশে বসে বলবেন, ‘পেয়েছি, পেয়েছি’।/কথা ছিলো একটি পতাকা পেলে/আমাদের সব দুঃখ জমা দেবো যৌথ-খামারে/সম্মিলিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদে সমান সুখের ভাগ/সকলেই নিয়ে যাবো নিজের সংসারে…’’-(একটি পতাকা পেলে, হেলাল হাফিজ)

(২) ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা,/তোমাকে পাওয়ার জন্যে/আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?/আর কতবার দেখতে হবে খা-বদাহন?/পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ঘোষণার ধ্বনিপ্রতিধ্বনি তুলে,/নতুন নিশান উডিয়ে,দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায়/তোমাকেই আসতে হবে, হে স্বাধীনতা।-(তোমাকে পাওয়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা, শামসুর রাহমান)

(৩) ‘প্রাচ্যের গানের মতো শোকাহত, ক¤িপত,চঞ্চল/বেগবতী তটিনীর মতো স্নিগ্ধ,মনোরম/আমাদের নারীদের কথা বলি,শোনো।/এ-সব রহস্যময়ী রমণীরা পুরুষের কণ্ঠস্বর শুনে/বৃক্ষের আড়ালে স’রে যায়-/…জনাব ফ্রয়েড,/এমন কি খোয়াবেও প্রেমিকারা আসে না সহজ পায়ে চপল চরণে।/জনাব ফ্রয়েড, মহিলারা/কামুকের, প্রেমিকের, শৃঙ্গারের সংজ্ঞা ভুলে গ্যাছে।/রকেটের প্রেমে পড়ে ঝরে গ্যাছে…’- (রিপোর্ট ১৯৭১,আসাদ চৌধুরী)

(৪) ‘…তাঁর চোখ বাঁধা হলো।/বুটের প্রথম লাথি রক্তাক্ত/করলো তার মুখ।/থ্যাতলানো ঠোঁটজোড়া লালা/রক্তে একাকার হলো,/জিভ নাড়তেই দুটো ভাঙা দাঁত/ঝরে পড়লো কংক্রিটে।/দ্বিতীয় লাথিতে ধনুকের/মতো বাঁকা হয়ে গেলো দেহ,/এবার সে চিৎকার করতে পারলো না/সে তার দেহের বস্ত্রহীনতার/কথা বলেছিলো/তার দুটো হাত-মুষ্টিবদ্ধ যে-হাত/মিছিলে পতাকার/মতো উড়েছে সক্রোধে,/যে-হাতে সে পোস্টার সেঁটেছে,/বিলিয়েছে লিফলেট,/লোহার হাতুড়ি দিয়ে সেই হাত/ভাঙা হলো।/সেই জীবন্ত হাত, জীবন্ত মানুষের হাত।/সে এখন মৃত।/তার শরীর ঘিরে/থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়ার মতো/ছড়িয়ে রয়েছে রক্ত,/তাজা লাল রক্ত’-(কনসেন্ট্রেশন ক্যা¤প, রুদ্র মুহান্মদ শহীদুল্লাহ)

(৫) ‘মেঘনা নদী দেব পাড়ি/কল-অলা এক নায়ে।/আবার আমি যাব আমার/পাড়াতলী গাঁয়ে।/শত যুগের ঘন আঁধার/গাঁয়ে আজো আছে।/সেই আঁধারে মানুষগুলো/লড়াই করে বাঁচে।/মনে আমার ঝলসে ওঠে/একাত্তরের কথা,/পাখির ডানায় লিখেছিলাম-/প্রিয় স্বাধীনতা’- (প্রিয় স্বাধীনতা, শামসুর রাহমান)

(৬) ‘খুব বেশি দূরে নয় সখীপুর/শহর ছাড়লে গ্রাম, তারপর গ্রাম, তারপর/পাহাড়ের জানু ছুঁয়ে লাঙলের মতো বাঁকা নদী/তারপর সবুজ যুদ্ধভূমি সখীপুর…/কি করে ভুলবো তাকে/যেখানেই যাই সখীপুর সঙ্গে সঙ্গে থাকে।’ মাহবুব সাদিকের ‘‘যুদ্ধভাসান’’ কবিতার মধ্যে রয়েছে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা। কবি যেখানেই যান সখিপুর তার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। হাটফেরা অছিরুদ্দিনের ছিন্নভিন্ন লাশ, গারো রমণীর ভালোবাসা, কিশোর মুক্তিযোদ্ধা কুদ্দুস কবির কাছে সখীপুরের সমর্থাক হয়ে দাঁড়ায়।

কবি হেলাল হাফিজ উদাত্ত আহ্বান করলেন তরুণদেরকে-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। কারণ আমাদের মতো কবিও জানতেন তরুণ সমাজকে ঘা মেরে জাগাতে হবে। স্বাধীনতার জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। তরুণরাই কিন্তু আমাদের বিজয় ছিনিয়ে এনেছেন- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়(সংক্ষেপিত)’। হাসান হাফিজুর রহমানের স্মৃতি, তোমার আপন পতাকা, এখন সকল শব্দই, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, আহমদ রফিকের এ দেশ আমার স্বর্গ, আবু হেনা মোস্তফা কামালের ছবি, ফজল শাহবুদ্দিনের এপ্রিলের একটি দিন ১৯৭১, বাংলাদেশ একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাকে, শহীদ কাদরীর নিষিদ্ধ জার্নাল থেকে, ব্ল্যাকআউটের পূর্ণিমায় বেলাল চৌধুরীর স্বদেশভূমি, মর্মে মর্মে স্বাধীনতা ইত্যাদি কবিতাসাহিত্যে স্বাধীনতা আর অনিয়মের কথা, বাঙালির ব্যথা-বেদনার কথা উচ্চারণ করেছেন কবিরা। আরও অনেক কবি লিখেছেন হাজারো কবিতা। একানে চম্বুক অংশ তুলে ধরতে পেরেছি মাত্র। কবিরা স্বাধীনতার ব্যাপারে সবসময় আন্তরিক ছিলেন। স্বাধীনতা ও পাকি শাসনের বিরুদ্ধে তাদের উচ্চারণ ছিল রক্তজবার মতো। মুক্তিযুদ্ধ, কবি ও কবিতা-পরস্পরে ঋণী।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আবু আফজাল সালেহ পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে আমাদের স্বাধীনতা- আমাদের অস্তিত্ব প্রবন্ধ সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর