১৫ আগস্ট
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১১:৪৭
অনেক রাত অবধি আড্ডা দেওয়ায় পরেরদিন ঘুম ভাঙ্গলো অনেক বেলা করে। ঘুম ভাঙ্গলো না, ঘুম ভাঙ্গানো হলো। সালাম নামের এক বন্ধুর বিয়েতে গিয়েছিলাম দল বেঁধে, বজরা নৌকায় চড়ে। সারারাত হৈচৈ আনন্দ ফূর্তিতে জমকালো কেটেছে সময়। বন্ধু আজিজ বললো, ‘রাত করে বাড়ি ফেরার দরকার নেই। তুমি বরং আমার সঙ্গে থেকে যাও। কাল সকালে আমি তোমাকে বাড়ি পৌছে দেব।’
সময়টা বর্ষাকাল। চারদিকে বন্যার পানি। গ্রামাঞ্চলে চলাচলের বাহন একমাত্র নৌকা। বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছি একজনের সঙ্গে নৌকায়। রাতে একা আমার পক্ষে বাড়ি ফেরা অসম্ভব। তারচেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে থেকে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। আমি সেইভাবে নিশ্চিন্তে আড্ডায় মেতেছিলাম সারারাত।
সেই রাতজাগা ঘুম সকাল-সকাল ভেঙ্গে চুরচুর হয়ে গেল দরজায় সজোরে করাঘাতের শব্দে। দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন আজিজ ভাইয়ের ভাবী। তাকে ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত্র দেখাচ্ছিল। আজিজ ভাই তখনও ঘুমে। আমি দরজা খুললে ভাবী ছুটে গিয়ে ধাক্কিয়ে গুঁতিয়ে আজিজ ভাইকে একরকম টেনে তুলে বসালেন। আজিজ ভাইয়ের চোখ তখনও ঘুমে ঢুলু ঢুলু। ভাবী এবার আজিজ ভাইকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘আর ঘুমানোর কাম নাই। সর্বনাশ অয়া গেছে।’ তার আর্তচিৎকার করুণ ধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়লো ঘরময়। আমি আতঙ্কিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাবী, কি হয়েছে? এমন করছেন কেন?’
ভাবীর হাতে এক ব্যান্ডের একটি রেডিও। তিনি কথা না বাড়িয়ে রেডিও অন করে দিলেন। একটি ভরাট কন্ঠ একটু পর পর তোতা পাখির মতো একই কথা বলছে, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি, আমরা স্বৈরাচারি শেখ মজিব সরকারকে উৎখাত করেছি।’ এই ঘোষণার পরই কোরআন তেলোয়াত। তেলোয়াত শেষে আবার ঘোষণা।
ততোক্ষণে আমার শরীর হিম হয়ে এসেছে। আজিক ভাইকে ডাকার মতো মনের জোর আমি হারিয়ে ফেলেছি। এই ভয়াবহ খবর ঘুমন্ত আজিজ ভাইয়ের কানেও শেলের মতো বিঁঁেধছে। তড়াক করে লাফিয়ে জেগে উঠলেন আজিজ ভাই। আজিজ ভাই জেগে আবার ঘোষণাটা শোনেন, তারপরই ‘আল্লারে—’ বলে বুকফাটা আর্তনাদ করে আবার বিছানায় গড়িয়ে পড়েন, মনে হলো তার প্রাণবায়ু ঝপাত করে বেরিয়ে মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
আজিজ ভাই আমার দু’বছরের বড়। আমি তাকে ‘আজিজ ভাই’ বলে সম্বধোন করি। সিরাজগঞ্জ কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে গ্রাজুয়েশন করেছেন। এখনও ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি। ততোদিনে মূল ছাত্রলীগ দুই টুকরো হয়ে গছে। এক অংশের নাম জাসদ ছাত্রলীগ, অপর অংশের নাম মুজিববাদী ছাত্রলীগ। আজিজ ভাই মুজিববাদী ছাত্রলীগের ইউনিয়ন শাখার সভাপতি।
আমি স্কুল জীবন থেকে ছাত্র রাজনীতি করলেও সদ্য স্বাধীন দেশে নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তে ছাত্রলীগের মতো শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন ভেঙ্গে দুই টুকরো হয়ে যেতে পারে যা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। পারিনি বলে রাজনীতি এখন আমার কাছে বিষাক্ত মরণ ভাইরাস। ষড়যন্ত্রের খেলা। কে কাকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবে শুধু সেই প্রতিযোগিতা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যাদের দেশবাসী শিরোস্ত্রাণ হিসেবে চার খলিফা নামে বঙ্গবন্ধুর অকুতভয় সৈনিক বলে আখ্যা দিয়েছিল স্বাধীনতার পর তারা পরস্পর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। তাতে ছাত্রলীগ দু’টুকরো হলো। সেই সঙ্গে সর্বনাশের ভীত তৈরি হলো সদ্য স্বাধীন দেশে।
দুই টুকরোর একভাগের নাম মুজিববাদী ছাত্রলীগ, সেখানে ভিড়লো নূরে আলম সিদ্দিকী এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন। আরেক ভাগের নাম জাসদ ছাত্রলীগ, সেখানে খুঁটি গাড়লো আ স ম আব্দুর রব এবং শাজাহান সিরাজ। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ সদস্য জাসদ ছাত্রলীগের ছায়াতলে এসে ভিড়লো। তাদের চটকধারি শ্লোগানের জোয়ারে পঙ্গপালের মতো তরুণরা এসে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ঝান্ডা উচিঁয়ে ধরলো হেইও বলে।
১৯৭২ সালে দুই ছাত্রলীগ একই তারিখ ২১, ২২ এবং ২৩ জুলাই কেন্দ্রীয় সম্মেলন আহ্বান করে। দুই ভাগই তাদের পোষ্টারে বড় বড় হরফে পোষ্টারে লিখেছে প্রধান অতিথি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান। বিদ্রোহী ছাত্রলীগ বেছে নিয়েছে পল্টন ময়দান আর মজিববাদী ছাত্রলীগ বেছে নিয়েছে রের্সকোর্স ময়দান।
সবারই কৌতূহল বঙ্গবন্ধু কোন পক্ষে যাবে। কোন মঞ্চে গিয়ে উঠবেন তিনি। সাধারণের ধারণা বঙ্গবন্ধু কোন পক্ষেই যাবেন না। সম্মেলনের একদিন আগে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে তাদের কর্মসূচি এবং অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করে আসেন। জাসদ নেতাদের দাবি বঙ্গবন্ধু নাকি পল্টনের সম্মেলনে যাবেন বলে তাদের কথা দিয়েছিলেন কিন্তু শেখ মনির পরামর্শে তিনি মত পরিবর্তন করেন।
সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে এসে উপস্থিত হলেন। ছাত্রলীগের মেধাবী ডেডিকেটেড এবং মুক্তিযোদ্ধা অংশ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েÑ‘লড়াই লড়াই লড়াই চাইÑলড়াই করে বাচতে চাই, এ লড়াই বাঁচার লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে’Ñএই শ্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুললো। আর তাতে দেশ ক্রমশ অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। রাজনৈতিক খুনোখুনি বেড়ে গেল। সুযোগ বুঝে দুই ছাত্রলীগই হাতে অস্ত্র তুলে নিলো। রাহাজানি বেড়ে গেল। যে দল যেমন সুযোগ পাচ্ছে সেই মতো সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। দুদিন আগে যারা এক রুটি ভাগ করে খেয়েছে, এক বিছানায় ঘুমিয়েছে। তারাই রাজনৈতিক বিভাজনে এখন পরস্পরের শত্রু। সুযোগ পেলে পরস্পরের লাশ ফেলে দিচ্ছে। তাতে একটু হাত কাঁপছে না।
এই রাজনৈতিক অস্থিরতা আমি মেনে নিতে পারিনি। রাজনীতি নিয়ে কখনও কখনও আজিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার বচসা হয়। আজও হচ্চিল বাজারে যেতে যেতে।
আজিজ ভাইয়ের সোজাসুজি বক্তব্য, ‘যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটাকে না গড়ে জাসদ ধ্বংসাত্মক রাজনীতি শুরু করেছে। এখনতো জ¦ালাও পোড়াও রাজনীতি করার সময় না।’
আমি তাকে ছাত্রলীগের জুলাই মাসের সম্মেলনের কথা মনে করিয়ে দেই। বলি, ‘আজিজ ভাই। গোড়ায় হাত দেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা। গুটিকয়েক ছাত্র নেতা তাঁর প্রয়োজন ছিল না। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলকে ডেকে ধমকে সাইজ করে দিতে পারতেন। কারণ গোটা দেশবাসী তাঁর সঙ্গে তখন। ছাত্রলীগ কোন ফ্যাক্টর ছিল না। সেটা না করে তিনি একপক্ষের নৌকায় গিয়ে উঠলেন। তাতে রেজাণ্ট কি হলো, দলের মেধাবী এবং প্রতিশ্রুতিশীল অংশ তাঁর বিরুদ্ধে চলে গেল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশটা গড়ার পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সৈনিকরা ত্াঁর মুখোমুখি অবস্থান নিলো। আর তাতে যা হবার তাই হলো। দেশে এখন চরম বিশৃংখলা। প্রতিদিনই পাটগুদামে আগুন জ¦লছে। প্রকাশ্যে মানুষ খুন হচ্ছে। দুর্নীতি স্বজন প্রীতিতে দেশ ছেঁয়ে গেছে। সর্বত্র নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেননি।’
‘তাই বলে তারা দেশ ধ্বংসের রাজনীতি করবে?’
‘আপনার সংগে আমি একমত। সবার উপর দেশ। আগে দেশ বাঁচাতে হবে। দেশ না বাঁচলে কিসের রাজনীতি?’
‘আমি যদি বলি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পথ তৈরি করেছে জাসদ। সেটা কি বেশি বলা হবে?’ আজিজ ভাই বললেন।
আমি বললাম, ‘যুক্তির খাতিরে আপনি তা বলতে পারেন। তবে বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন। কেউ কাউকে হত্যা করার পথ তৈরি করে দেয় না। যার পথ সে নিজেই তৈরি করে।’
‘তারমানে তুমি বলতে চাও বঙ্গবন্ধু নিজেই নিজের কবর রচনা করেছিলেন?’ আজিজ ভাইয়ের কন্ঠে উষ্মা ঝরে পড়ে।
আমি শান্ত কন্ঠে বললাম, ‘আমি তা বলতে চাচ্ছি না। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে। বঙ্গবন্ধুর পরীক্ষীত বন্ধু তাজউদ্দিন আহমেদ। তাকে তিনি মাইনাস করলেন। কাছে টানলেন কাকে, খন্ধকার মোশতাককে। ফলাফল কি হলো? ফলাফল হলো সেই খন্ধকার মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের প্রধান হোতা। এটাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?’
আজিজ ভাই কোন জবাব দিলেন না। এই ধরণের আলোচনা ভাল লাগছিল না। আজ ভয়ংকর একটি দিন। আজ বাঙালি জাতির স্বাধীকার আন্দোলনের নেতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানি পশুরা বছরের পর বছর শত ষড়যন্ত্র করেও যাকে হত্যা করতে পারেনি। সেই মহানায়ককে কয়েকজন বাঙালি আর্মী নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করেছে। আজ ইতিহাসের কলংকজনক দিন। বাঙালি তাঁর জাতির জনককে খুন করেছে। এই কলংক বাঙালি জাতির কপালে তিলকের মতো অস্কিত হয়ে গেছে, যে কলংক গোটা জাতিকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
বাজারে অনেকগুলো চায়ের দোকান। আমাদেরে আড্ডা বাদশার চায়ের স্টলে। নামেই বাদশা। আসলে সে একজন সাধারণ বাউল কিসিমের মানুষ। কিছুদিন আগেও বাজারে শুধুমাত্র বাদশা আর সুবল পালের চায়ের দোকান ছিল। হঠাৎ করেই সা সা করে চায়ের দোকান বেড়ে গেছে। তাতে মোটেও খদ্দেরের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে না। সারাক্ষণ চায়ের দোকানে গম গম করে মানুষ।
আজ বাজারের পরিবেশ থমথমে। লোকজন কম। মানুষজনের মনে চাপা ক্রন্দন। বাদশার স্টলে গুটি কয়েক খদ্দের। হাসিখুশি বাদশা সেও বিমর্ষ মুখে বসে আছে। বাদশাকে আমরা ভান্ডারি বলে ডাকি। মাথায় লম্বা চুল। দেশের যত পীর ফকির আছে, তাদের সব ওরশেই বাদশার পদধুলি পড়ে। বাদশা কাজ করতে করতে হঠাৎ নিজে নিজেই ভান্ডারি বলে চেঁচিয়ে ওঠে। সেই কারণে ভান্ডারি নামটা বাদশার কপালে স্থায়ী হয়ে গেছে। এখন ছোটবড় সবাই তাকে ভান্ডারি বলে ডাকে। আমিও স্টলেই ঢুকেই ভান্ডারি বলে ডাকতেই বাদশা শুধু মাথা ঝুঁকালো। অন্যদিনের মতো ভারী গলায় ভান্ডারি বলে চেঁচিয়ে উঠলো না।
আমি এবং আজিজ ভাই এককোণে গিয়ে মুখোমুখি বসলাম। ইশারায় বাদশাকে চায়ের কথা বলতেই বাদশা উঠে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘খবর কিছু হুনছেন?’
আমি জানতে চাইলাম, ‘বঙ্গবন্ধুর খবর?’
বাদশা নিঃশব্দে মাথা নাড়লো। তারপর নিজে নিজে বললো, ‘এইটা কোন কথা হইল?’ লম্বা করে শ^াস ফেলে চলে গেল বাদশা। বাদশার ছেলে হেলাল আমাদের দুকাপ চা দিয়ে গেল। আজিজ ভাই মাথা নামিয়ে বসে আছেন। চা খাচ্ছেন না। বাড়িতেও সে কিছু খায়নি। আমি অনেক জোরাজুরি করেছি। খাওয়াতে পারিনি।
পাশেই আরো একটি চায়ের স্টল আছে। আইয়ুব খানের চায়ের স্টল। সেখানে হৈচৈ হচ্ছে। ওই স্টলে হৈচৈ খুব সাধারণ ব্যাপার। স্টলের মালিক আইয়ুব খান নিজেই খিস্তি খেউড় করে পরিবেশ গরম করে রাখে। হ্যাংলা পাতলা আইয়ুব খান কথায় কথায় খিস্তি করা তার পুরনো স্বভাব। আইয়ুব খান তার আসল নাম নয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার ক্ষমতার শেষের দিকে বাংলাদেশের ঈশ্বরদীতে এসেছিল রাষ্ট্রীয় সফরে। দিনটি ছিল ১৪ আগস্ট, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। তখন একটা কথা চালু ছিল যে, ১৪ আগস্টে ট্রেনভ্রমণে টিকেট লাগে না। কিশোর আবুল অনেকের সঙ্গে ট্রেনে চেপে ঈশ^রদীতে গিয়েছিল আইয়ুব খানকে দেখতে। অতি ভীড়ের চাপে আবুল পড়ে গিয়েছিল চলন্ত ট্রেনের পাশে। তাতে ওর বাম হাতটা কাটা পড়ে। সেই থেকে ওর নাম আবুলের পরিবর্তে হয়ে যায় আইয়ুব খান।
শুরুতে আইয়ুবের দোকানেই চা খেতাম আমরা। কিন্তু সেখানে মুখ পাতলা লোকজন বেশি আড্ডা দেয় আর দোকানদার আইয়ুবের খিস্তি খেউড়তো আছেই। আমাকে আইয়ুব বেশি অপছন্দ করতো। ওর ধারণা এই এলাকায় আমার জন্য জাসদ সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক সে। আমাতে দেখলেই বলে, জাসদের দালালদের কোন কাজ নেই। তারা আওয়ামী লীগের বাল ধরে কামড়াামড়ি করে। একদিন আমি যেই বলেছি, কিরে আইয়ুব খান, ‘তোর নেতাতো সব রাজাকারকে মাফ করে দিল’ আর যায় কোথায়, অমনি সে বেশুমার গালাগালি শুরু করলো। ‘দেশের সব খানকির পোলা নিমকহারামরা কিছু হইলে বঙ্গবন্ধুর দোষ খুঁইজা বেড়ায়। আরে চোদনার পোলারা বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হইলে সব শালা সারাজীবন মাওড়াদের গোলামি করতিস। লোকটা জীবন-যৌবন জেলখানায় শেষ কইরা দিল, দেশের মানুষের জন্য জেল খাইটা কত কষ্ট কইরা দেশটা স্বাধীন করলো আর হুমুন্দির পুতরা সকাল বিকাল লোকটার খালি দোষ খোঁজে। আইজ কইতাছে বঙ্গবন্ধু রাজাকারদের মাফ কইরা দিছে। মাফ না করলে কইতো বঙ্গবন্ধু একটা জল্লাদ। পেটের দায়ে গরীব মানুষ রাজাকার হইছিল তাদের জেলে আটকায়া রাখছে। এখন মাফ করছে তাও তার বালের দোষ।’ আইয়ুব খানের কথায় নানা পদের খিস্তি থাকে-যেগুলো আসরে উথ্বাপন করা অসমীচিন। আইয়ুব খান একদিন সাফ বলে দিল, যারা জাসদের চামচাগিরি করে তারা যেন আমার দোকানে না আসে। আমরা সেই থেকে আইয়ুব খানের চার দোকান ছেড়ে বাদশার স্টলে এসে ঘাঁটি গাড়ি।
আইয়ুব খানের স্টলে জোরে হাউকাউ আর শোরগোল হচ্ছিল ভীষণ। বাদশার ছেলে হেলাল দেখে এসে জানালো, ‘একজন বলেছে শেখ মজিব মরছে ভাল হইছে। এই কথা শুইনা আইয়ুব খান তাকে চড় মারছে। সেও পাল্টা চড় মারছে। আর তাই নিয়া দুইজন কিলাকিলি শুরু করেছে।’
আজিজ ভাই এতোক্ষণ মাথা নামিয়ে বসে ছিলেন। তিনি হেলালকে বললেন, ‘তুই গিয়ে আইয়ুবকে আমার কথা বল। বলবি, আমি ডাকছি।’
হেলাল চলে গেল। একটু পর আইয়ুব খান বিমর্ষ মুখে আজিজ ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার দিকে একবারও তাকালো না। আজিজ ভাই বললেন, ‘শোন, সময় খারাপ। বঙ্গবন্ধুর হত্যা নিয়ে কারো সঙ্গে কিছু বলার দরকার নেই।’ আইয়ুব খান এবার নিজেকে সামাল দিতে পারলো না। কান্নার জন্য পরিবেশ লাগে। সেই পরিবেশ পেয়ে গেছে আইয়ুব খান। আজিজ ভাইকে জড়িয়ে ধরে হাও-মাও করে কাঁদতে শুরু করলো। ওর কান্না দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছিল। নিরক্ষর আইয়ুব রাজনীতির ‘র’ ভাল করে জানে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান। এমন অসংখ্য ভক্ত বঙ্গবন্ধুর। তারা সবাই গোপনে নিরবে চোখের জল ফেলছে। মুখে কিছু বলতে পারছে না। বঙ্গবন্ধু মৃত্যু আমিও মেনে নিতে পারিনি। কিন্তু আইয়ুবের মতো প্রাণখুলে কাঁদতে পারছি না। আজিজ ভাই ওকে নানান কথা বলে সান্ত¡না দিয়ে কান্না থামালেন।
তখন রাস্তার ওপাড়ে হাজী তোজাম্মেলের দোকানে হুড়োহুড়ি ভীড়। আজিজ ভাই আমাকে ইশারায় দৃশ্যটি দেখালেন। মোজাম্মেল হাজী খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করছে। এই দৃশ্য দেখে আজিজ ভাই উঠে চলে গেলেন। ‘কোথায় যাচ্ছেন?’ আমি সে কথার জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলাম না। কোনদিক না তকিয়ে আজিজ ভাই সোজা বাড়ির পথ ধরলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এই তোজাম্মেলকে চোখ বেঁধে নৌকায় তুলেছিল। মেরে ফেলবে। পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য এলাকায় তারা শান্তি কমিটি গঠন করেছিল। এই নিমকহারামদের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে গঞ্জে ঢুকে বাড়িঘর জ¦ালিয়ে দিয়েছে। যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে গেছে। তাদের সম্ভ্রম লুটেছে। অথচ কিছু মানুষ তাকে পরেজগার হাজী উল্লেখ করে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের পা ধরে প্রাণ ভিক্ষা চাইতে থাকে। পিতার বয়সী লোকজনের অনুরোধ ফেলতে পারে না তারা। হাজী তোজাম্মেলকে তারা মাফ করে দেয়। সেই নেকহারাম হাজী তোজাম্মেল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে খুশিতে মিষ্টি বিতরণ করছে। দৃশ্যটি আইয়ুবের নজর এড়ায় না। সে উপরে লাফিয়ে উঠে আকাশ কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘ওই শুয়ারের বাচ্চা রাজাকার, তোর মিষ্টি আমি তোর পোন্দের মধ্যে ঢুকাইয়া দিমু।’
আইয়ুব খান উপরে লাফিয়ে উঠে ধপাস করে নিচে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ছুটোছুটি করে ওর মাথায় পানি ঢালা হলো। জ্ঞান না ফেরায় পাঁজা কোলে করে বাজারে হবি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। হবি ডাক্তার পাস করা ডাক্তার না। কম্পাউন্ডার থেকে ডাক্তার হয়েছে। জ¦র জারির ওষুধ দেয়।
সে প্রেসার মেপে মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে বসে পড়ে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলেন, ‘ও এখনও বাঁইচা আছে কিভাবে?’
‘কেন?’ আমি প্রশ্ন করলাম।
বললেন, ‘প্রেসার উপরে ১৮০ নিচে ১২০। এই অবস্থায় কারও বাঁচার কথা না। আমি ভাইবা পাইতাছি না, ও এখনও বাঁইচা আছে কিভাবে? তোমরা শোন, এ রুগির ব্যাপারে আমার কিছু করার নাই। কিছু করার নাই মানেÑএই রুগির চিকিৎসা করার কোন ক্ষমতা আমার নাই। ওরে বাঁচাতে চাইলে তোমরা ওকে সদর হাসপাতালে নিয়া যাও।’
আইয়ুব খানকে সদরে নেওয়ার মতো কোন জান-বাহন পাওয়া গেল না। অগত্যা বাঁশের কাবারি বানিয়ে সেখানে আইয়ুব খানকে শুইয়ে দিয়ে কাধে করে তাকে সদরে নিয়ে যাওয়ার হলো। খবর পেয়ে আইয়ুব খানের দুই ভাই এসেছে। তারাই কাধে নিয়েছে বাঁশের কাবারি। আমরা পিছে পিছে হাঁটছি। যেতে যেতে একজন বললো, ‘থানার বাজারে একজন ভাল ডাক্তার আছে। আগে তার কাছে নিয়া যাই।’
বললাম, ‘তাই চলো।’
ডাক্তার সাহেবকে সহজেই পাওয়া গেল। মধ্যবয়স্ক ডাক্তার সাহেবের মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি। চেহারার মধ্যে মায়া মায়া ভাব। তিনি রোগির বৃত্তান্ত শুনে খুব আগ্রহ নিয়ে রোগিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন। হাতের নাড়ি টিপে তিনি থমকে গেলেন। হাত ছেড়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে বসে রইলেন। আমরা উন্মুখ হয়ে ডাক্তার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছি। ’কি হইলো ডাক্তার সাহেব, খাম মাইরা গেলেন ক্যা?’
ডাক্তার সাহেব হাম ছাড়লেন শব্দ করে। তারপর ভারী গলায় বললেন, ‘রোগি নাই। অনেক আগেই আসল ঠিকানায় পৌছে গেছে। আপনারাতো একজন মৃত মানুষের লাশ কাধে কইরা বইয়া আনছেন। এখন বাড়িত নিয়া দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেন।’
‘আমার ভাইয়ের কি অইছিল ডাক্তার সাহেব?’ আইয়ুবের ছোটভাই মজিদ কান্না গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘স্ট্রোক করছিল।’ ডাক্তার সাহেব বললেন।
‘একজন যে বললো বাতাস লাগা ব্যারাম হইছিল?’
ডাক্তার সাহেব এবার গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বাতাস লাগা ব্যারাম বইলা কিছু নাই। মাথায় রক্ত চইড়া তোমার ভাইয়ের বাতাস বাইর হয়া গেছে।’
আমরা নিঃশব্দে বুকে কান্না চেপে আইয়ুব খানকে আবার কাধে করে বাড়ির দিকে নিয়ে আসি। কত ভাবনা, কত কথা মাখায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ ১৫ আগস্ট। আজ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে খুন হয়েছেন। তাঁর মৃত্যু ইতিহাস হয়েছে। শোক সভা হয়। কাঙালি ভোজ হয়। বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসে আইয়ুব খানও শূূন্যে উড়াল দিয়েছে। ওর কি হবে? ওর কথা কি কেউ মনে রাখবে?
সারাবাংলা/এসবিডিই