Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পৃথিবীর সেরা দৃশ্য

ধ্রুব এষ
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৫৬

আন্ধা ফকির একটা গান গায়।
ইয়াহিয়া খান
বড় বেঈমান
বাঙালিরে মেরে মেরে
করিল শ্মশান…।

আমাদের শহরের আন্ধা ফকির। জন্ম থেকে আমরা তাকে দেখছি। আমরা যারা যুদ্ধের কিছু আগে জন্মেছি। আমাদের এর তার বাপ জ্যাঠা চাচা মামা ভাই, শহরের অনেকেই যুদ্ধ করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি হটাতে। ছোটচাচা সেই যোদ্ধাদের একজন। পিপুলের ছোটচাচা, তল্লাটের সব ছেলেপুলেই তাকে ছোটচাচা ডাকে। আমরা তার কাছে যুদ্ধের অনেক কথা শুনি। আন্ধা ফকিরের কথাও শুনি। আন্ধা ফকির জন্ম থেকেই অন্ধ। যুদ্ধের সময় চর ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের।

বিজ্ঞাপন

‘চড়! চড় কী? ও ছোটচাচা?’

‘চড় না রে কমান্ডার, চর। যুদ্ধের সময় সে শহরে ছিল তো, গোপনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি, রাজাকার-আলবদর বাহিনির খবরাখবর দিত মুক্তিযোদ্ধাদের।’

‘অ। অ-অ-অ-অ-অ!’

‘এই তো বুঝেছিস। ভেরি গুড, বিস্কুট। এখন যা।’

আমাদের মতো ছেলেপুলেদের ছোটচাচা ডাকেন কমান্ডার। আমরা জানি ছোটচাচা মুক্তিবাহিনির কমান্ডার ছিলেন।

‘ও ছোটচাচা?’

‘বল কমান্ডার।’

‘তুমি যুদ্ধে গেলে কিভাবে বল।’

‘বঙ্গবন্ধু ডাক দিলেন।’

একথাটা আমরা ছেলেপুলেরা অনেকবার ছোটচাচার মুখে শুনেছি। বঙ্গবন্ধু ডাক দিয়েছিলেন, তাঁর ডাকে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিসেনারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছোটচাচা তাঁকে দেখেছেন। লিডার বলেন, বঙ্গবন্ধু বলেন।

আমরা ইশকুলে পড়ি এবং লিখি ‘ছয় দফা’ এক্সারসাইজ খাতায়। খাতার মলাটে ছবি আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। আর লেখা আছে ‘ছয় দফা’। আমাদের বইতেও ছবি আছে, লেখা আছে। আমরা জানি বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা।

বই খাতা ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ছবি আমরা দেখি বাংলা পত্রিকা, ইংরেজি পত্রিকায়। ভাষণ শুনলাম একদিন রেডিওতে। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর একদিন শুনলাম জনসভা করতে বঙ্গবন্ধু আসবেন আমাদের শহরে। কবে আসবেন? বৃহস্পতিবারে। ডাকবাংলোয় উঠবেন। ভাষণ দেবেন। ছোটচাচা বললেন বৃহস্পতিবারে ডাকবাংলোয় নিয়ে যাবেন ছেলেপুলেদের। রাতে আমাদের ঘুম আর ধরে না। সবচেয়ে খুশি দেখলাম আন্ধা ফকিরকে। সেও দেখতে যাবে বঙ্গবন্ধুকে। গান গায় আর একথা বলে।

বিজ্ঞাপন

‘…মায়ের সামনে বধ করে
অবোধ শিশুর প্রাণ
এই দেশেতে নাই বেশি আর
হিন্দু মুসলমান
ইয়াহিয়া খান বড় বেঈমান
বাঙালিরে মেরে মেরে
করিল শ্মশান,
রুখিয়া দাঁড়াইলেন বাংলা
মায়ের এক সন্তান
আমরার নেতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান…

জয় বাংলা! জয় বঙ্গবন্ধু। তিনি আমরার শহরে আসতিছেন, তারে দেখব না?’

কিন্তু সে অন্ধ, কী করে দেখবে? ছোটচাচা অবশ্য তাকে বলেছেন, ‘অবশ্যই।’ ছেলেপুলে কিছু বোঝেনি। অবশ্যই মানে কী, ছোটচাচা কি একথা বলছেন যে আন্ধা ফকির অবশ্যই দেখতে পাবে বঙ্গবন্ধুকে! কী করে? কিন্তু ছোটচাচার কথা আবার অবিশ্বাস করতে পারে না ছেলেপুলেরা।

বুধবার থেকে আমাদের শহরের রাস্তাঘাটে দুনিয়ার মানুষ দেখা যেতে থাকল। দূর দূর গ্রামগঞ্জের মানুষ। বঙ্গবন্ধুকে দেখতে তারা এসেছে শহরে। ছেলেপুলেদের কেউ কেউ যারা টু কি থ্রি-তে পড়ে তারা জনসমুদ্র কথাটা শুনেছে। পরদিন দুপুরে তারা দেখল এবং বুঝল জনসমুদ্র বলে কাহাকে! একসঙ্গে এত মানুষ তারা আর কখনো দেখেনি। যুদ্ধের সময় যারা শরণার্থী শিবিরে ছিল তারাও দেখেনি। দুনিয়ার মানুষ সমবেত হয়েছে ডাকবাংলোর লনে এবং সরকারি হাই ইশকুলের মাঠে। সব মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখবে এবং তার ভাষণ শুনবে। বঙ্গবন্ধু এলেন দুপুর বারটায়। হেলিকপ্টারে। উল্লসিত স্লোগানে মুখর হলো চরাচর।

জাতির পিতা শেখ মুজিব!
লও লও লও সালাম!!
জয় বাংলা!
জয় বঙ্গবন্ধু!!

ডাকবাংলোর সামনে বানানো মঞ্চে ভাষণ দিতে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। এই উঁচু একজন মানুষ! এই ভাষণ দিতে শুরু করবেন হয়ত, ছেলেপুলের দিকে তাকালেন, এক পলক কী দেখলেন, ডাক দিলেন, ‘এই মধু! মধু!’

ছেলেপুলের মধ্যে মধু কেউ নাই। তারা বসে আছে মঞ্চের সামনেই। ছোটচাচা বসিয়ে দিয়েছেন। ছেলেপুলেদের মুরুব্বি হিসেবে বহাল করে গেছেন আন্ধা ফকিরকে, ‘এরা তোমার জিম্মাদারিতে থাকল।’

আশ্চর্য হয়ে ছেলেপুলে দেখল বঙ্গবন্ধুর ডাকে আর কেউ না, উঠে দাঁড়াল তাদের মুরুব্বি। আন্ধা ফকির! বঙ্গবন্ধু কি তাকে ডেকেছেন? সে মধু? চুপ হয়ে গেছে এত এত মানুষ। আন্ধা ফকির হাঁকল, ‘বঙ্গবন্ধু! বঙ্গবন্ধু!’

বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এদিকে আয়। এই তোরা, মধুকে নিয়ে আয়।’

ছোটচাচার বন্ধু শিবলি চাচা এবং ইতু তিতুর ভাই বিমানেশ মাস্টার বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন আন্ধা ফকিরকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কী রে মধু?’

মধু, আন্ধা ফকির কী যে বলল, আমরা এত কাছে থেকেও শুনলাম না, এত নিচুগলায় বলল। তবে বঙ্গবন্ধু তার কথা বুঝলেন! বুকে টেনে নিলেন আন্ধা ফকিরকে।

মানুষজন চুপ এখনো। মনে হচ্ছে আরো চুপ হয়ে গেছে। চুপ হয়ে গেছে পাখিরা, গাছরা, চুপ হয়ে গেছে আমাদের শহর। চুপ। নিশ্চুপ। চুপ এতজন একসঙ্গে অবশ্যই পৃথিবীর সেরা দৃশ্যটা দেখছে। মানুষজন, পাখি, গাছ, আমাদের শহর। আন্ধা ফকিরের গানটা দেখা যাচ্ছে বুঝি।

…রুখিয়া দাঁড়াইলেন বাংলা
মায়ের এক সন্তান
আমরার নেতা বঙ্গবন্ধু
শেখ মুজিবুর রহমান।

সারাবাংলা/এসবিডিই

গল্প ধ্রুব এষ পৃথিবীর সেরা দৃশ্য সাহিত্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর