কুকুর হইতে সাবধান
১৮ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:২৫
রেগে যাওয়ার কথা। তিনি রাগলেন না। অনেক বড় মাপের মানুষ আবুল হোসেন। একে তো নামকরা কলেজের বিজ্ঞানের অধ্যাপক, তার উপর পত্রিকার মালিক সম্পাদক। তিনি শুধু ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসির রেখা তুলে খুব সহজে মুছে ফেললেন। শিহাব একপলক হাসিমের দিকে তাকায়। কোনো পরিবর্তন নেই সেই লোকের চেহারায়। সব কিছু ঠিক। একেবারে স্বাভাবিক। কোথাও কোনো ছন্দপতন হয়নি।
‘বাড়ি স্যার একেবারে চমৎকার…ফার্স্ট ক্লাস। এ শহরে এমন আর্কিটেকচার আর একটাও নাই। শুধু একটু সামান্য…।’
‘তুমি কি খুৎ ধরতে এসেছ?’
‘না স্যার, ওই যে পরিবেশ বলে একটি কথা; আশেপাশে তো সকলে চামড়া ব্যবসায়ী। গরু ছাগলের চামড়া পচা গন্ধে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে না যায় আবার। ভিখিরির উৎপাতও অনেক দেখছি।’
‘এর জন্য তো হাসিম উঁচু প্রাচীর দেয়া হয়েছে। তুমি তো সমস্যায় ফেলে দিলে।’
‘না না স্যার, তেমন সিরিয়াস কিছু নয়, এটা একটা কথার কথা। আপনি তো স্যার রামনগরের মান-সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
এবার শিহাবের মুখে সামান্য হাসি দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়। হাসিম পারে বটে! কত কথা বলে। সে কথায় লেগে থাকে কলেষ্টোরেল মুক্ত তেল। ফ্যাট প্রেটিন। একে বলে মোসাহেবের জাদুকরি ট্রিক্স। চাটুকারিতার ভেল্কি। যিনি ভেল্কি দেখান, ভেল্কিবাজ। শিহাবের মনে হয়, ব্যাটা মহা ধড়িবাজ। ডালে ডালে ঘোরে। পাতায় পাতায় মতলব। তাকে ধরা মুস্কিল।
তারা কয়েকজন আবুল হোসেনের নতুন বাড়ি উদ্বোধন আর মিলাদ অনুষ্ঠানে এসেছে। মিলাদ শেষ। অভ্যাগত অতিথির অনেকেই চলে গেছেন। এখন বিকেলের আকাশ ফ্যাকাশে গোধূলি। কিছুক্ষণ পর সন্ধে নেমে আসবে। এই ফাঁকে সকলে ঘুরে ঘুরে কক্ষগুলো দেখতে দেখতে নানান গল্পগুজবে ব্যস্ত হয়। প্রশস্তির নানা উক্তি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। গদগদ কথামালার মাঝখানে কোনো বেফাঁস উক্তি যেমন আকস্মিক থমকে দেয়, চতুর মানুষ খুব সহজে অর্থ ঘোরাতেও পারে। হাসিম এমন এক দক্ষ কারিগর। অনেকটা এরকম যে, এখানে প্রস্রাব করিবেন না, করিলে দশ টাকা জরিমানা। না-এর পাশে কমা উঠিয়ে সামনের ন-এ বসালে অন্য অর্থ। অবশ্য এরপরে আরও কথা আছে। সে কথা না হয় থাক।
প্রথম দিন পরিচয় হয়েছিল সেভাবে। লোকটি বসেছিল রুদ্ধদ্বার এক চেম্বারের সামনে। বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল। উপরে ফাইভ এমএম গ্লাস। তার নিচে কতগুলো নেমকার্ড। এককোণায় কোনো ছায়াছবির লিফলেট। টেবিলের বাঁ-পাশে টিএন্ডটির’র মোটা টেলিফোন গাইড। নীল রঙের কিতাব। অতি ব্যবহারে ঝলসে গেছে। গাইডের উপর এক সময়ের অফহোয়াইট টেলিফোন সেট। এটিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্ণ ধূসর। বরং ময়লাটে বললেই যুৎসই হয়। লোকটির ব্যাক-ব্রাশ করা চুল। কোনো সুগন্ধী হেয়ার ওয়েলে চপচপ করছে। সেই সুবাস ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশ। চকচক করছে কপালের উত্তর আর দক্ষিণ মেরু। টাক পড়তে শুরু করেছে। সে বেশ আয়েশে চেয়ারকে রকিং করে দুলতে-দুলতে ঝুলতে-ঝুলতে গোল্ডলীফের ধোঁয়া বাতাসে মেশায়। শিহাবকে দেখে থমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, –
‘কাকে চাইছেন?’
‘স্যারের সাথে একটু দেখা করব!’
‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?’
‘না, তেমন কিছু তো…তিনি খুঁজছিলেন নাকি! আমার নাম শিহাব আহমেদ।’
‘ও তাই বলুন ভাই। আমি হাসিম খান। অ্যাকাউন্টেন্ট। আপনার তো গত পরশু আসার কথা ছিল!’
‘ঢাকায় ছিলাম। বাসায় এসে শুনি, স্যার দেখা করতে বলেছেন।’
‘সে তো বটেই… যান ভেতরে যান, স্যার ফ্রি আছেন।’
ফ্রি মানে একা। একা কি দোকা। এক্কা দোক্কা ছক্কা পাঞ্জা। তিনি একা ছিলেন না। টুকটুকে লাল পাড় বাসন্তি রং শাড়ি পরিহিত আধবুড়ি এক মহিলা বসে ছিল। তার চোখে-মুখে কিশোরী কিশোরী ঢং। টেবিলে ছড়ানো এক ম্যাপ। মাথার উপর উজ্জ্বল হলদে অ্যন্টি-ইনসেক্ট বালব। টেবিল ল্যাম্পও জ্বলছে। সেই আলো মানচিত্রের উপর। তবে বাইরে এয়ারকুলারের যে ঝমঝম শব্দ সেটি ঘরের ভেতর অনেকখানি নেই। চাপা পড়ে গেছে। শিহাব ইতস্তত হয়ে যায়।
‘আ রে শিহাব তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। এসো বসো…কথা আছে।
‘জি!’
সেই সূচনা। তারপর কেটে গেল দু-আড়াই বছর। অভিযোগ আর তিক্ততা কাকে বলে কিংবা তার অভিধানিক বিশ্লেষণ কী, শিহাবের অনেক জানা হয়ে গেছে। সে একেবারে সাদামাটা মানুষ। কখনো তার নিজেকে মনে হয়, হ্যাবলা বা ভ্যাবলাকান্ত। হাত কচলাবার কিছু জানে না। মোসাহেবগিরি আরও দূরের কথা। তাই কোনোদিন কেউ কেউ অনেক কথা বলে ফেলে। সে-সবের সারাংশ বোকা মানুষ…মিসফিট বা বুরবাক। সে শুধু শোনে। কে কী বলল তাতে কোনো মাথাব্যথা নেই। খুব ভালো শ্রোতা।
‘আরে সাহেব, ওই জিনিস ছাড়া কিছু কী হয়? ডেল কার্ণেগী পড়েননি? এর জন্য ট্রেনিং নিতে হয়। অভ্যাস রপ্ত করা লাগে। ট্রেনিং মানে প্রশিক্ষণ। নেই তো কিছু নেই। সাহেবদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে দেখুন। তাদের দর্শন করে মুগ্ধ হোন। সবসময় হাসি মুখে থাকুন। মনোযোগ দিয়ে কথা শুনুন। স্যারেরা খুশি হয় ভেবেচিন্তে তেমন কথা বলুন। এটাই ট্রেনিং…তরতর করে উঠে যাবেন। উপরে…আরও উপরে।’
হাসিম শুধু কথাই বলে না। উঠে গেছে। উঠতে-উঠতে অ্যাকাউন্টেন্ট থেকে চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট। চিফ মানে সস্তা-চিফ প্রধান। আর কয়েক মাসে সস্তা থেকে শুধু প্রধান নয়, একেবারে জেনারেল ম্যানেজার। ব্যবস্থাপক। সকল বিষয়ের ব্যবস্থা তার হাতে। আবুল হোসেনের ছোট-বড় সকল সিদ্ধান্তে হাসিম খান। সাহেবের মোসাহেব তারপর ব্যবস্থাপক। পরামর্শদাতা কিংবা উপদেষ্টা বললেও কম বলা হয়।
শিহাব হ্যাবলাকান্ত। পিছিয়ে গেল। গুটিয়ে গেল। শম্বুক তরতর করে উঠতে পারে না। কিংবা সেই বানরের গল্প যে কিনা এক পিচ্ছিল বংশদণ্ডে উঠবার প্রাণান্ত চেষ্টা করে চলেছিল। এক ফুট ওঠে তো দুই ফুট নেমে যায়। আসলে সে কোনো চেষ্টাই করেনি। কেননা কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে দিনযাপনে অভ্যস্ত নয়। সে শুধু আশেপাশে দেখে আর তিক্ততায় তেতো হয়। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর ভাবে…ভাবে আর ভাবে। গাধার নাকে মূলো বাঁধা অসম্ভব ধৈর্যশীল এক বুরবাক। তবে শামুক বললেই বেশি ভালো শোনায়। যে সমালোচনার টোকা খেলে খোলসের ভেতর ঢুকে পড়ে। নিজের ভেতর কাঠের মতো শক্ত হয়ে যায়।
পেরিয়ে গেল আরও দেড় বছর। কিছু হলো না। যা হয়, শুধু অস্বস্তি আর তিক্ততা। সে অভিজ্ঞতা বাড়ে। মাসের পর মাস বকেয়া বেতনের ভার বৃদ্ধি পায়। কোনোদিন সে বিষয় নিয়ে হাসিমের সঙ্গে বাক্যালাপ হয়। ইনিয়ে বিনিয়ে প্রয়োজন তুলে ধরে। কোনো সমাধান হয় না। অবশেষে আবুল হোসেনের সঙ্গে দু-চারবার সাক্ষাৎ। সেখানেও নৈবচ। শোনে উপদেশ পরামর্শ। সবুরে মেওয়া ফলে। ধৈর্যের চেয়ে বড় সম্পদ নাই। উপদেশ না ধৈর্য, কোনটি যে সম্পদ শিহাব বুঝে উঠতে…খুঁজে পেতে পারে না। সে সম্পদের কী এমন মূল্য? কোনোদিন জেমস বন্ডের মতো বিস্ফোরিত হতে চায়, শালা নিকুচি করি তোর চাকরির। মামদোবাজরাই ভালো। নকশাল হবো। উপড়ে ফেলব রেললাইন। সমাজের গুষ্টি শত বার মেরে মেরে শান্ত করে মন। আজ নয়…আগামীকাল। না না কোনো একদিন ঠিক সে সবকিছু ছেড়ে দেবে। অথচ কিছু হয় না। শত শত প্রত্যাশায় ফিরে ফিরে আসে সেই দলা থুতুর কাছে, ভাবনায় কতবার ফেলে গেছে যেখানে। অগত্যা পুনরায় আর একবার সাক্ষাৎ। বেতনের টাকা বা মজুরি যাই হোক ভিক্ষের মতো চেয়ে বসা।
‘শোনো শিহাব, ব্যবসার সামান্য মন্দা যাচ্ছে। একটু ভালো অবস্থা হোক সব বকেয়া একসাথে পাবে। ঘর থেকে টাকা এনে দেয়া তো সম্ভব নয়। আর কে দেবে?’
‘আমি সে কথা বলছি না স্যার, ইনকাম তো হচ্ছে। বেশ কতগুলো বড় বিজ্ঞাপন রেগুলার ছাপা হলো। সে-সবের বিল থেকে দেবেন।’
‘কি যে বলো তুমি! কোথায় বিজ্ঞাপনের বিল? সে কয়েকটি টাকা তো নিউজপ্রিন্ট কিনতে আর প্রেসের বিল দিতে চলে যায়। বুঝলে এভাবে পত্রিকা চালানো যায় না। কমিটমেন্ট থাকতে হবে সকলের। ধৈর্য আর কমিটমেন্ট অনেক বড় জিনিস। এখানে সে জিনিস অনেকের নাই। ভাবছি পত্রিকার ব্যবসা তুলে দেব। কোনো লাভ হচ্ছে না। তুমি বলো, ডিএফপির কয়টা বিজ্ঞাপন পাই? দু-একটা ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপনে পত্রিকা চলে? আর আজকাল মানুষ পেপার-টেপার পড়ে না। টিভি খুললেই তো হাজার খবর। ভাবছি এ ব্যবসা ছেড়ে এনজিও করব। ফরেন এইডে দু-বেলার ডাল রুটি হয়ে যাবে। কি বলো তুমি?…কই হাসিম তোমার হিসাবপত্তর নিয়ে এসো, উইকলি রিভিউটা সারা যাক।’
‘আসছি স্যার।’
শিহাব উপসংহারের অস্ফুট ধ্বনি ফেলে উঠে দাঁড়ায় আর তখন হাসিম চেয়ার কাঁপিয়ে হুড়মুড় করে কক্ষের মাঝখানে। সে একপলক দেখেই বুঝে ফেলে, লোকটি আড়িপাতায় ওস্তাদ। চারকোণা চোয়ালে ইচড়েপাকা মুচকি হাসি ঝুলে আছে রহস্যময়। শিহাব বুকের আগুনে জ্বলে ওঠে অর্থহীন-শক্তিহীন। শত শত কল্পনা আর ভাবনায় সময়কে পিষে পিষে অন্যকোনো সন্ধের অপেক্ষা করে।
‘আচ্ছা শিহাব তুমি এখন এসো।…বুঝলে হতাশ হয়ো না। সবকিছু হবে। চেষ্টা চলছে। ও কে!’
‘ও কে স্যার। ও কে।’
শিহাব নিজের ডেস্কে ফিরে এসে একবার ভাবে, নিজের পাছায় সজোরে লাথি মারা যায় কি? খুব ইচ্ছে করে। অস্থির মন কোনোকিছু লেখার আর খেই খুঁজে পায় না। মাথায় ভাবনার দ্বন্দ্ব হতাশার স্ফূলিঙ্গ অসহনীয় হয়ে ওঠে। আসলে সে কোন্ মরীচিকার পেছনে ধাবমান? স্মৃতি হাতড়াবার মতো মাঝে মাঝে নিজের সমালোচনা করে। অকারণ। খেটে চলে অকারণ। এরচেয়ে কলেজে টলেজে চাকরি পেলে ক্লিন জীবন হতো। কিন্তু ডনেশনের লাখ টাকা পাবে কোথায়? সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। তারপর অন্ধকার ভ্যাপসা গন্ধের খুপড়ি ঘরে বসে একটু আলো একটু মুক্ত বাতাসের জন্য পাগল হয়ে ওঠে প্রায়। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব চেষ্টা করে খোঁজে। খুঁজতে থাকে। একসময় পুব দেয়ালের উপরে ঘুলঘুলি মতো এক জানালা, সেখানে দৃষ্টি দিয়ে লাইপোস্টের হলুদ আলো দেখে। বালবটির দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। অনেক পোকা চাঁদের আলো ভেবে সেটি ঘিরে দাপাদাপি করছে। সে তেমন এক পোকা। কোনো অলীক স্বপ্নকে ঘিরে সারারাত নাচবে। তারপর মরে পড়ে থাকবে নিচে। মানুষের পায়ের তলায়। এ লোভেই থেকে গেছে। অথচ এখানে প্রভুভক্ত কুকুর হয়ে কোনো হাড্ডিও জুটছে না। আবার কখনো…কি যে হতাশা আর আশার দোদুল্যমান টাগ অব ওয়ার! নিশ্চয়ই রিটার্ন আসবে। আসবে…আসবেই। এই করে কেটে গেল অনেকদিন! অসীম ধৈর্য তার। এর উপর ভরসা করে কেটে যাবে নাকি বাকি জীবন?
‘এখনো যে বেঁচে আছো, এই ঢের। হ্যাবলাকান্ত তুমি একটা পুরোট ঢেঁড়শ পাবে শেষে।’
অসম্ভব ক্ষোভ আর রাগে নিজের মাথা খেয়ে ফেলতে চায় সে আর একবার। আসলে সে কিছুই পারে না। একজন ভীতু নির্জীব আর হতাশ লোকের পক্ষে অন্য কোনোকিছু করা সম্ভব নয়। আর কিইবা হতে পারে সে!
লাল পন্টিয়াক। চমৎকার দুই দরজার ট্যাক্সি কার। বড় সাহেবের জন্যে এসেছে। ঢাকার এক পার্টির অনুদান বা উৎকোচ। অফিসের হ্রস্ব বারান্দার পশ্চিমে একপাশে ঝকঝকে লাল আলো তুলে জেগে আছে দুপুরের সূর্য। মুখর হয়েছে কৌতূহলী লোকজন আর কর্মচারীদের বাক্যধারা। কোন্ দেশের তৈরি? রক্ত লাল না কি ক্রিমশন রেড? না না কিছু চকোলেট আভা ঝরছে। কত দাম হতে পারে? ভেতরে এসি আছে? কয়জন বসতে পারে? একনাগাড়ে কত কিলোমিটার যায়? টপস্পিড কত? নানা আগ্রহ থেকে কেউ কেউ সে কারের স্পর্শ নিতে চায়। কিন্তু মানা, হাতের ছাপ বা দাগ খুব খারাপ জিনিস। শিহাব দূর থেকে দেখে আর ভাবে। কী ভাবে তার কোনো খেই নেই। নিজেকে শুধু প্রবোধ দেয়, সে সামান্য সম্পাদকীয় সহকারী; আজ তাকে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আর চৌর্যবৃত্তির বিষয়ে সম্পাদকীয় লিখতে হবে।
এক বিকেলে শোনা গেল, অফিসের কয়েকজন কর্মচারী সেই লাল রঙের কারে বসে রামসাগর বেড়াতে যাবে। মালিকের মন বেজায় খুশি। তিনি আসলে দেখাতে চান, পন্টিয়াকে বসে কত আরাম! যাদের নাম উক্ত হলো, খুশিতে গদগদ মশগুল। শিহাবের কথা কেউ বলে না। সে শুধু তাকিয়ে দেখে…আর দেখে যায়। তার কর্ণকুহরে দমকা বাতাস ঠেলে ঠেলে হেলেদুলে কিছু শব্দ বাংলা ফিল্মি গানের মতো তরঙ্গ তোলে। তার মনে হয় পোষা কুকুরের কিঁউ কিঁউ ধ্বনি। তারপর দিন গড়াতে গড়াতে কয়েকদিন পর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেল। শিহাব ভ্যাবলাকান্ত এসে দাঁড়ায় পন্টিয়াকের কাছে। আজ চুল দাড়ি কেটে ছেটে নিজেই নিজের উপর মোহাচ্ছন্ন। অনেকদিন কোনো জায়গা ঘুরে বেড়ানো হয়নি। এসব ভাবনার মাঝে কোত্থেকে এক কিন্তু এসে হাজির, যেভাবে প্রতিবার সব জায়গায় সবসময়। সেই ‘কিন্তু’ ল্যাজে-গোবরে প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়। পাকিয়ে পাকিয়ে জট। না পাঁচ জনের বেশি বসার জায়গা নেই। সবাই উঠে পড়ল ঝটপট লটঘট। পিছিয়ে পড়ে সে। পিওন রমজান পর্যন্ত উঠে আটজন হয়ে গেছে! শিহাব এতক্ষণ কী করছিল? অবশেষে হতবাক ক্যাবলাকান্ত ছোট এক শ্বাস ফেলে বলে বসে,-
‘আপনারা যান ভাই, এই তো সেদিন দেখে এলাম রামসাগর।’
‘ও আচ্ছা আচ্ছা। তা শুনলাম গ্রামীণ ব্যাংক না কি পানি সেচের ব্যবসা করছে? এখন শুকিয়ে খাল, পাড় ভেঙ্গে পড়েছে; জানেন নাকি?’
‘কই ন্ নাতো!’
শিহাব আসলে কিছুই জানে না। নিজের ভেতর ঘুমঘোরে যে থাকে, বাইরের খবর তার অজানা। যে দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে মেরে ফেলে তার ওজনও চেনা নয়। কত দিন নাকি বছর রামসাগরের পথে হাঁটেনি সে। পন্টিয়াক কিংবা তেমন কারে উঠে বসার আহ্লাদ কেন? কোন্ অধিকারে তারও কারণ খুঁজে পায় না।
গত শীত মওসুমে রেডক্রশ থেকে দুঃস্থদের কম্বল শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করা হলো। পত্রিকা অনেক কভারেজ করে। কর্তৃপক্ষ তাই খুশি হয়ে অফিসের সকলের জন্য একটি বান্ডেল দেয়। তখন কে কোনটি নেবে তা নিয়ে প্রায় কাড়াকাড়ি। ব্যবস্থাপকের ভাগে ট্রিপল ফাইভ। ভালো ম্যানেজার। শিহাবকে কে খোঁজে! সে গোবেচারা হায়বেচারা হয়ে গেল। কোনো কিছু আদায় করতে পারল না। সে হবে সাহসী…আদায় করে নেবে অধিকার-প্রাপ্য। আসলে একটি লুঙ্গি বা কম্বল তার প্রাপ্য কিনা কে ভাবছে? প্রশ্ন হলো গুরুত্বের। কেউ তাকে দাম দেয় না। সে শুধু শুধু সমাজ আর দেশের জন্য মাথা ঘামিয়ে নানান ভিউজ আর এডিটরিয়াল লেখে। ওসব লিখে কী হয়? ঘণ্টা হয়…ঘণ্টা বাজে ঢং ঢং ঢং। সেই ঘণ্টার দারুণ নিনাদ তার মাথায় বেজে ওঠে। ব্যক্তিগত হতাশা আর ক্ষোভে মাথাব্যথা বাড়ে। সেভাবে বিভোর সামনের দেয়ালে মেরে বসে অনর্থক এক লাথি।
মাস শেষ। বছর যায় যায়। শিহাবের কোন্ দিনে মাসের শুরু আর কত তারিখে শেষ, সে হিসাব নেই। সে শুধু হাজিরা খাতায়। জীবনও বেদুঈন লুটপাটের মতো অগোছালো ধ্বংসাবশেষ। বিধ্বস্ত সোমনাথ মন্দির। নিজের বুকে সেই বেদনা কখনো লু হাওয়া তোলে, তপ্ত বাতাস দাবদাহ, যা হোক সব নিজের কাছে; অন্যের নিয়ম-অনিয়ম খুঁজতে যায় না। অফিস পলিটিক্স বোঝে না। বুঝতে পারে না। সম্বলহীন কেরানির মতো ঘড়ি ধরে আসে-যায়, মাথা গুজে লেখে; কাজে আত্মভোলা। কি গ্রীষ্ম কি শীত নিয়মের কোনো ব্যত্যয় নেই। নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে চায় না।
বেলা তিনটায় দ্বিতীয় শিফট। সন্ধে থেকে শীত বাড়ে। চারপাশে নেমে আসে গভীর কুয়াশা কিংবা পৌষের মেঘ। মাঝে মাঝে থেকে থেকে দমকা বেগে ধেয়ে আসে মেঘলা বাতাস। কনকনে ঠান্ডায় অন্ধকার রাত জমে যায়। শীতকে তার খুব ভয়। একটি গরম কাপড় দশ বছর ধরে অতি ব্যবহারে ঝাঁজরা। হিম বাতাস ঠেকাতে পারে না। মাসের শেষে তাই খুব দ্রুত সাইকেলে প্যাডেল মেরে তিন কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে অফিসে আসে। এসে কিছুক্ষণ হাঁপায়। আজকে কিছু টাকা পাওয়া গেলে নিক্সন মার্কেট থেকে ভারী কোনো এক গরম কাপড় কিনে নেয়ার সাধ জাগে, কিন্ত সে আর হয় না। নিরর্থক স্বপ্নের রেশ ফেলে ফিরে চলে যায়। নতুন আশায় আবার উজ্জীবিত হতে থাকে। তখন টাকা চলে যায় যেভাবে যায় চুপিসারে হাতে হাতে। হাত বদল হয়। শিহাব কিছু টের পায় না। টাকা চকচকে করে দেয় তাদের চেহারা। সে বকেয়া মজুরির আর একটি দিন গোনে। গুনে গুনে তার বকেয়ার অংক বাড়ে শুধু।
একদিন রাস্তায় ধরে বসে স্কুলের সহপাঠি বন্ধু। তখন অবাক করা হিমেল দুপুর। গাছে গাছে ফুলে ফুলে বসন্তের আহ্বানগীতি। উজ্জ্বল আকাশের নিচে বুকের ভেতর অদ্ভুত নষ্টালজিয়া ঢেউ খেলে যায়। কত দিন পর! অনেক দিন…অনেক স্মৃতি। কথাও অনেক। তবু তেমন আবেগ নেই। বয়স হয়ে যাচ্ছে। সব বয়সে সবকিছু মানায় না। সে আর নষ্টালজিক হতে চায় না। হোঁচট খেয়ে যায় প্রশ্ন শুনে, –
‘বলিস কি তুই ওখানে? কী করছিস আজকাল?’
‘এই সব ইত্যাদি ধরনের…।’
‘লেখালেখি? না..না এ কেমন কথা! তুই কি সমাজ উন্নয়নের ঠিকাদার? কেমন স্বাস্থ্য হয়েছে তোর! চোখ-মুখ বসে গেছে। বুকের চুল পর্যন্ত পেকে গেছে রে!’
‘আ রে এটা সাহ্নিক, তুই তো আমার চেয়ে দু বছরের বড়।’
‘মাথায় না হয় কলপ দিতে পারবি, বয়স কমে যাবে। কিন্তু…।’
‘বাদ দে।’
‘বাদ দে আবার কি! তুই তো একদম প্রভুভক্ত কুকুর দেখছি। কিছু এধার-ওধার কামাই করতে পারছিস্?’
‘কি যে বলিস!’
‘হাসিম শালা তো, বাড়ি তুলে ফেলল। শুনছি কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার খুলবে।’
‘হতে পারে।’
‘যা শ্ শালা, বুরবাক কাঁহিকা!’
ঘরে ফেরার পথে বিষকাটা দংশন। লেখালেখির ইত্যাদি সুখকর ভাবনা আর বুকে ঢেউ তোলেনি। কত ব্যক্তি কত বাহবা দিয়েছে। সম্পাদকীয় তো নয়, একেবারে বুলেট; কলজেয় আঘাত করে। সে কত গভীর মনোনিবেশ করে তথ্য আর তত্ত্ব ঘেটে ঘেটে কথার পর কথা সাজায়। একসময় বিভোর থেকেছে। ওই পর্যন্তই। আজকাল ওসবে কোনো কাজ হয় না। সমাজ এখন টাকাওয়ালার। তারা যেমন চাইবে সবকিছু তেমন চলবে। টাকা যাদের হাতে নিয়ম তারা তৈরি করে। সুতরাং জ্ঞানগর্ভ বড় বড় তত্ত্বকথার ফুলঝুরি উড়িয়ে কোনো লাভ আছে কি? এসব ভাবনায় কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন থেকে সে ফিরে যায়। কোনো পুঙ্গব বিভোল অহম আর মাথায় ঘোরে না। হওয়ার কথাও নয়। যুগের সঙ্গে তাল মেলানো বড় ব্যাপার। পদ্ধতিগত কৌশল। সমাজের বড় বড় লোকজনের সঙ্গে পরিচিত হও, প্রশাসন কর্তাদের সঙ্গে গদগদ সম্পর্ক তৈরি করো, নানান সভায় গিয়ে সকলের নজরে পড়ার আদিখ্যেতা চাই; একদিন সবকিছু না হলেও ট্রিকেল-ডাউন তলানি জুটে যেতে পারে। তোমার দ্বারা সে-সব হবে না। তুমি এক মাকাল ফল। দুপুরের দাবদাহ বুকে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে চেপে রাস্তায় হেঁটে চলে যাও। আবুল হোসেন আর হাসিমেরা এইসব কৌশল জানে। তারা নিজের ভেতরে না তাকিয়ে নিজের জন্য হাজার কৌশল রপ্ত করে…ঠিক ঠিক জায়গায় কাজে লাগায়। পোষা কুকুর হয়ে এগিয়ে চলে সামনে।
আজ আবার ওই সাক্ষাতের কথা মনে পড়ে যায়। সে আসলে কী করে চলেছে? সাধারণত এরকম খোঁচানোর ভাবনা মনে বেশিক্ষণ থাকে না। অথচ ঘটে যায়। মালিক-সম্পাদকের নতুন বাড়ি। নীল রঙের প্রাসাদ, গেটের কাছে; একেবারে বাঁ প্রান্তে সেও এসে দাঁড়িয়েছে। মাঝখানের লোক যারা সেখানেই আছে। আজ বাড়ির উদ্বোধন। মিলাদ মাহফিল। লাল রঙের ফিতে কেটে ম্যাডাম প্রথমে পা রাখবেন। শিহাব পায়ের স্যান্ডালজোড়া কোথায় রাখে? কোনোমতো নিরাপদ এক ঝোপের প্রান্তে লুকিয়ে ভেতরে যায়। এয়ার কন্ডিশনড বেডরুম। বড় পরিসরের গ্যারেজ। টাইলস দেয়া বাথরুম। কমোড আর প্যান। হট এন্ড কুল শাওয়ার। লেটেষ্ট ডিজাইন বাথটাব। মোজাইক উঠোন। এই না হলে জীবন আর প্রযুক্তিময় বেঁচে থাকা!
তার নিজের ঘরের আশপাশে মুরগি আর গরুর খামার। নিজের ঘর নয়। মাস শেষে ভাড়া গোনা লাগে। পৃথিবীর অনেক সক্ষম মানুষ পরকালের জন্য কবরের জায়গা কিনে রাখে। শিহাবের ঘুমানোর জায়গাটুকু নেই। সে এই দুনিয়ার কে? কোথায় তার ঈশ্বর? সে কোন্ অভিযোগ রেখে যাবে কার কাছে? সে কি জাগ্রত নাকি ঘুমের ঘোরে? না এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। কোনো কোনো মানুষ কোনো ক্ষোভের অধিকার রাখে না। সে এই ভেবে ক্লান্ত-শ্রান্ত ঘুমোতে যায় আর অলীক কোনো স্বপ্নের তেপান্তর মাঠে ছুটোছুটি করে। তারপর আবার দিন আবার রাত। রোজ সকালে ঘুম ভাঙে মুরগি আর কাকের চিৎকারে। দিন পেরোয় গোবরের গন্ধে। শ্রুতিতে বাজে বস্তির খিস্তি-খেউর। তারপর অন্ধকার রাত নামে গলির মাথায়। টি স্টলে সারাদিন বেজে চলা চটুল গানের আওয়াজ শান্ত হলে। একে বলে আরেক বেঁচে থাকা।
শিহাব ভাবছিল, এত প্রাচুর্যের মাঝে ড্রাম কাটা টবের সোঁদা মাটিতে বেড়ে ওঠা শিম লতা হাঁপিয়ে উঠছে না তো! তার মতো? সে না হয় ছেড়ে ছুঁড়ে দূর দিগন্তে চলে যেতে পারে। পারে কি? একটিই তো জীবন। আহা জীবন! ‘তুই আমাকে ফাগুনের উদাসী বাতাসের মতো কাঁদাস কেন! আমার চোখ ভরে আসে জলে।’ সত্যি তার চোখ আদ্র হতে চায়। নিজেকে দ্রুত সামলে নেয়ার কৌশল জানে বলে রক্ষা। গণ্ডারের চামড়ার মতো অনুভূতিহীন মন। সচকিত হয়ে নিজেকে শাসন করে। ‘ছি ছি কেউ দেখে ফেললে না তো! সে যে কি, যা তা এক মানুষ। না কি যাঁতা।’ নিজেকে টুকরো টুকরো করে এভাবে সে বাঁচে?
সবাই ঘুরে ঘুরে নতুন বাড়ির কক্ষ দেখছে। মালিক দেখাচ্ছেন। কোনোকিছু দেখানোর মধ্যে আভিজাত্য আছে। তাই অহংকার বাতাসে ভাসছে। সকলের মুখে মুখে ঈর্ষণীয় প্রশংসা । হাসিম আর একবার বলে বসে,-
‘স্যার সবকিছুই সুন্দর, ঠিকঠাক জায়গামতো। একটা অভাব শুধু স্যার…।’
‘আবার কী হলো তোমার?’
‘একটা এ্যালসেশিয়ান বা জার্মান হাউন্ড জাতের কুকুর দরকার স্যার। বাড়ির দরজার কাছে চেইন দিয়ে বাঁধা থাকবে। পাহারা দেবে। হে হে, বাইরের অহেতুক উৎপাত থাকবে না।’
‘ঠিক কথা হে! এতক্ষণে একটা কথা বলেছ। একটা জার্মান শেপার্ড দরজায় থাকবে…উফ্ এটা একটা স্টাটাস। তুমি এনামুলকে ফোন করে দাও, ঢাকা থেকে একটা বাচ্চা জোগাড় করবে।’
‘আজকেই ফোন করে দেব স্যার।’
আবুল হোসেন আরও কী বলতে মুখ খুলেছিলেন, থেমে গেলেন। লোহার গ্রিলের দরজা। ও প্রান্ত থেকে এগিয়ে এলো একটি হাত। আবদার কন্ঠষ্বর। পেতে ধরা হাত…হাত পেতে ধরা। তখন সকলের দৃষ্টি সেদিকে ঘুরে যায়। কেননা আকুতি ছিল অনেক তীব্র। শিহাবও চমকে ওঠে। সে তখন উর্দু এক প্রবচণ ভাবছিল, পহেলা কুত্তা যো কুত্তা পালে, দোসরা কুত্তা পর ঘরওয়ালে, তিসরা কুত্তা বহেনকা ঘর ভাই, চৌথা কুত্তা ঘরজামাই। তার নিজের কোনো ঘর নেই। সে দুই নম্বরের কুকুর…পর ঘরওয়ালে। সে ঘরের ভাড়া বাকি কয়েক মাস। বাড়ির মালিক সামনের মাসে ভাড়া না পেলে, সবকিছু রাস্তায় ফেলে দেবে শাসিয়েছে। তার দুচোখে দুশ্চিন্তা ফুটে ওঠে। বিহ্বল হয়ে পড়ে দৃষ্টি। সেভাবেই সে বাইরে তাকায়। দেখে প্রচণ্ড ঝুলে পড়া চামড়ায় আবৃত এক বৃদ্ধ, একটি হাত প্রসারিত করে গ্রিলের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। সে হাতের কব্জিতে একটি রাবারের বালা। কোটরগত হলুদ দু-চোখের দৃষ্টিতে আকুল মায়া। শিহাবের কেন জানি মনে হয়, সে ঈশ্বরকে দেখছে। বৃদ্ধ অসহায় মলিন চেহারা। শয়তানের কাছে হেরে যাওয়া অপার্থিব মুখ। এত কষ্ট নিয়ে এ ঈশ্বর বেঁচে আছে কীভাবে? শিহাব ভাবনা বিভোর। তখনো ঘোর ভাঙেনি। সে শিম লতার ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। ফ্যাকাশে সবুজ লতার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে ভাবে। এভাবে বেঁচে থাকা অনন্ত কষ্টের জীবন। তার বেঁচে থাকা। তখন হাসিম বলে চলে, –
‘এই জন্যই বলছিলাম স্যার। মানে বুঝলেন না, হে হে হে! অহেতুক উৎপাত ঝামেলা কিছু থাকবে না।’
‘তুমি ঠিক বলেছ হাসিম। জাতে উঠে গেল সবকিছু লাগে। আজকেই ঢাকা প্রতিনিধিকে রিকোয়ারমেন্ট পাঠিয়ে দাও। জার্মান শেপার্ড বা এ্যালসেসিয়ান জাতের হতে হবে কিন্তু।’
‘সে আর বলতে স্যার…অবশ্যই-অবশ্যই।’
শিহাব শূন্যস্থান পূরণের মতো বলতে চাইল, গেটে ‘কুকুর হইতে সাবধান’ এই বাক্যটি লিখে দেয়া দরকার। মোটা মোটা হরফে। উজ্জ্বল কালার কমিবনেশন। সে আর বলতে পারে না। ‘আচ্ছা ভিক্ষুক কি পড়তে জানে? হয়তো কেউ জানে, জেনেও জানে না, অথবা কোনোকিছু জানে না, জানার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে যে দশজন পড়তে জানে, তারা কি শুধুই পড়ে? পড়ে কিছু জানে? অথবা জেনেও জানার কিছু থাকে না।’ তার চোখের সামনে লুডুর ছকচিত্র ভেসে ওঠে। সেখানে মুখ ব্যাদান করা ভয়ংকর কতগুলো সাপ। তার পাশে পাশে উঠে যাবার সিঁড়ি। সকলেই সিঁড়ির কাছে আসতে পারে না। তারা ভাগ্যবান। দুর্ভাগারা সাপের মুখে পড়ে। সে সাপের মায়াজালে আটকে গেছে। তাই যতটুকু পারে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। সে এখানে থাকবে না। তার চারপাশে কতগুলো সাপ…কতগুলো লোভী কুকুর। এসব ভাবনার ঘোরে অকারণে তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। সন্ধের ঘোলাটে আলোছায়া কুহকী দৃশ্যের সূচনা করে। সে মায়াজাল দেখে। দেখতে থাকে আর চমকে চমকে উঠে। আশেপাশে কতগুলো চেহারা বদলে গেছে। তাদের বাহারি মুখ কুকুরের মতো লম্বা আর ভয়ংকর। সেই কুৎসিত মুখের মাঝখানে একজোড়া অঙ্গারের কুতকুতে লোভী চোখ। নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে। তীব্র সম্মোহনী দৃষ্টি। বীভৎস আগ্রাসী।
শিহাব আকস্মিক এক চিৎকার দিয়ে ওঠে, কুকুর হইতে সাবধান।
সারাবাংলা/এসবিডিই