জলে ধোয়া জবান — প্রেমপিয়াসীর ধারাভাষ্য
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:০৯
বছর ঘুরে আবার এসেছে ফেব্রুয়ারি মাস। প্রাণের মাস, গানের মাস, একই সাথে শোকের মাস, অশ্রুর মাস। ফেব্রুয়ারি মানেই বাঙালি প্রাণে সাজ সাজ রব। লেখকরা ব্যস্ত থাকেন প্রচ্ছদ, বাঁধাই নিরীক্ষা করতে, প্রেসে থাকে নাই নাই ঠাই অবস্থা আর পাঠকরা পছন্দের লেখকের বইটি তুলে নেয়ার অপেক্ষায়।
আফসানা কিশোয়ার (লোচন) নামটি অনলাইনে খুব কম লোকের কাছেই অজানা। প্রতিবাদী, প্রতিরোধী, নারীবাদী, প্রথাবিরোধী এই বিশেষণগুলোর সাথে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিশেষণ ‘কবি আফসানা’। এই এতো ছোট বয়সে তার চৌদ্দতম কবিতার বই ‘জলে ধোয়া জবান’ এসেছে এবাবের বইমেলায়। আমার অবিশ্বাস্য মনে হয়। একটু ব্যক্তিগত কাসুন্দি। বন্ধুরা অনেকেই বলে, আমি অনেক ডিসিপ্লিনড, পরিশ্রমী, কারণ তারা লোচনকে দেখেনি, জানে না। বাচ্চার যত্ন, সংসার, অফিস, মেহমানদারি, পরিবার, বন্ধুদের সমস্যা (প্রায় প্রতিদিন) সামলে সে প্রতিদিন লেখে, প্রতিদিনই লেখে। নিয়ম করে লেখে। অল্প আঘাতেই কাতর, ভেঙে পড়া আমি উদ্দীপ্ত হই লোচনকে দেখে। সমস্ত ঘটন অঘটনের মাঝে সে অবিচল, শান্ত আর সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারায় দক্ষ। বইয়ের ‘মুখবন্ধ’ পড়লেই কবির অকপটতা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ থাকবে না।
কবিকে নিয়ে অনেক হলো এবার তার কিছু কবিতা। প্রথমেই সেই অনুকাব্যটি উল্লেখ করছি যেটি থেকে চৌদ্দতম কাব্য গ্রন্থের নামকরণটি এসেছে,
‘জলে ধোয়া জবান আমার
বুকে মউতের লোবান গন্ধ
দুইন্যাজোড়া এত মানুষ
আমার ক্যান তোমারেই চাই
আমি কি সখী প্রেমে অন্ধ?’
টুপটুপ করে ঝরে পড়া ঝোলা গুড়ের মতো মিষ্টি কাব্য।
পড়ছিলাম, ‘ইনসমনিয়ার গোলযোগ’, কবিতার শেষাংশটা লিখছি আপনাদের জন্য
ঝাঁ ক্লান্ত শরীরে যখন বিছানায়
তখন ডেকে উঠলো চোখ,
মাথার ভেতর ইনসমনিয়ার গোলযোগ;
হাহাকারে বলে-তার সঙ্গে কথা হোক
তার সংগে কথা হোক। বছরে একবারও
দেখা না হওয়ার বিপরীতে রাখব না ‘অনুযোগ’।
‘বোধের অবিভক্ত আয়না’ পড়ি খানিকটা?
“ভেঙে কি সব বলা যায়?
কত কথা, তবু মনে হয় বাকি রয়ে গেলো অনেকটাই-
আমি এমন বলতেই তুমি বললে ‘আকাশ দেখো’;
দেখলাম।
-আকাশ দেখা মানে যেন নিজের নিয়মে ‘স্বাধীনতা’
চোখ দিয়ে ছুঁয়ে গেলাম।”
নিজেকেই যেন ফিরে পাই এসব কবিতার মাঝে। মনে হয়, যা ভাবি তাতো লিখতে পারি না। এতো অকপটে লেখে কি করে এই মেয়েটা!
এবার একটু রূঢ় বাস্তবে ফিরি ‘অপেক্ষা করি সাতজনম ধরে’ কবিতার মাধ্যমে-
‘আমাকে ওরা ডেকেছে হাইপেশিয়ার মৃত্যু নিশ্চিত করার কালে,
আমাকে ওরা আড়ালে নিয়েছে টেনে ডাইনি হত্যার ধারাবাহিক মঞ্চের দেয়ালে
কি করলে নারী পতিত হয়, নষ্ট হয় সে বয়ান ওরা আমাকে বলেছে সুরার সুরে, বীজমন্ত্রের জপে,
নারী জন্মের সার্থকতা শুধু পুরুষ নামক প্রাণীর সেবায়
ওরা আমাকে খুব করে বুঝিয়েছে সভ্যতার ক্ষমতা হস্তান্তরের নিভৃত ডেরায়।’
এবারে আরো একটি অনুকাব্য,
‘তুমি আর আমি
এই দুই শব্দের বিচ্ছেদে
লেখা আছে দুনিয়ার যত
হৃদয় ভাঙার কাহিনি’
শাশ্বত এই সত্যটি মাত্র চার লাইনে লেখা।
ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের দুইশো প্লাস কবিতা নিয়ে এই বইটি পাওয়া যাবে ‘বাংলানামা’র ২১৮ নং স্টলে । মূল্য মাত্র দুইশো পঞ্চাশ টাকা। মনোরম এই প্রচ্ছদটি এঁকেছেন আবু হাসান।
আশা করি বইটি আপনারা নিজেরা কিনবেন, প্রিয়জনকে উপহার দেবেন।
‘লোচন’ আমার কোন লেভেলের বন্ধু সেই লেভেল আমি নিজে জানি না। শুধু এটুকু জানি, ও দু’হাত বাড়িয়ে না দিলে সুস্থ থাকতাম না। কথা হলেই বলে, ‘জীবনে প্রেম জরুরি’। আজ জিজ্ঞেস করছি, ‘মানুষ পাওয়া যায় কিন্তু প্রেম পাওয়া যায়? মানুষ মেলে কিন্তু প্রেম?’
সারাবাংলা/এএসজি