Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুতোয় বোনা কাফন

মাহবুব আলী
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:১৫

সেই পারশ্য নীল স্ট্রাইপড্ সার্ট হাতে তুলে প্রথমে নাকে-মুখে স্পর্শ করে কোমলতা কিংবা ঘ্রাণ মেখে নেয় আবিদ আলি। কত পরিশ্রম আর আদর জড়িয়ে আছে সুতোর মায়াজালে! তারপর বুকের সঙ্গে লেপটে বুঝিবা সকল কষ্ট আর ধৈর্যের পরিসমাপ্তি অন্বেষণ। আহা কত দিন…কত মাস পর মেয়ে ফিরে এসেছে! সারারাত বাসযাত্রা। একান্ন সিটের মফিজ মার্কা বাস, পা ছড়িয়ে বসা যায় না, রাস্তায় জ্যাম, উঁচু-নিচু খাদের ঝাঁকুনি, সারারাত ঘুমোয়নি পরি; তারপরও সকল ক্লান্তি-অবসাদ এড়িয়ে ব্যাগ থেকে একে একে বের করে আনে কতকিছু। এর-ওর জন্য এটা-সেটা। এমন আনন্দের হয়তো প্রয়োজন আছে। তাই সকালও অনেক উজ্জ্বল হয়ে নিজেকে ছড়িয়ে রাখতে শুরু করে।
‘বাবা দেখো তো সার্টটা তোমার ঠিক হবে কি না?’
‘কেন এত খরচ করতে গেলি মা?’
‘আমি কি খালিহাতে আসতে পারি বাবা?’
কত মাস এই সন্বোধন সামনাসামনি শোনেনি আবেদ আলি! যতটুকু কথা সেও মোবাইলে। কেমন আছে, কী খেয়েছে আর বিবিধ সতর্কবার্তা পরামর্শ। সেই কুশল কথার কতুটুকু সত্য অথবা আড়াল কে জানে! তার মন আজকাল বড়ই সন্দেহ আর উদ্বেগ-আশঙ্কার গোলকধাঁধায় ঘোরে। একটু স্বস্তি আর মুক্ত বাতাসের জন্য কত না আকুল হয়! মনকে হাজারও প্রবোধ দেওয়ার পরও জেগে থাকে প্রায় সারারাত। একেকটি রাত আর দিন মৃত্যুর মতো ভারী স্থবির। নিশ্চুপ শোকগাথায় মলিন। বড় কষ্টে পেরিয়ে যায় সময়।
পুরোনো ঘরের উত্তর জানালায় কোনো পাল্লা নেই। ক-খানা মরচেধরা শিক শূন্য পাঁজরের মতো খাঁ-খাঁ করে। তারই ফাঁক গলিয়ে কখনো দূর আকাশে দেখা যায় সপ্তর্ষিমণ্ডল। একেবারে শেষ তারায় রেখা টেনে নিচে নেমে সাধ জাগে ধ্রুবতারা দেখে নেয়। অচেনা শহরের কোথায় আছে পরি? আবিদ আলি দেখতে পায় না। মেয়েকে কতদিন দেখে না। চোখের দৃষ্টি আলগোছে ঝাপসা হতে হতে বিবেকের দংশনে মরে যায়। সব তার দোষ। সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত আর কাজ করতে পারেনি। এইসব ভাবনা-দুর্ভাবনার মধ্যে কখন বিছানায় উঠে বসে মনে থাকে না। বোধহীন দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন তার চোখের পাতায় জেগে জেগে রাত ঘুমোয়।

বিজ্ঞাপন

আজকাল অনেককিছু মনে থাকে না। আবিদ আলি বুঝে নেয়, এও বয়সের কারুকাজ। মানুষের মন হাজারও স্মৃতিতে জেগে উঠলেও ধীরে ধীরে বর্তমানের অনেককিছু ভুলে যেতে থাকে, কিন্তু সেদিনের সন্ধেবেলা আর রাতের সকল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ভুলতে পারে না; ভুলে গেছে নিজের বাক্যবাণ। কী বলেছিল সে? কখন? সত্যিই কি বলেছিল? হায় খোদা কেন বলেছিল? নমিতা বলে, –
‘তুমি বাপ হয়ে এমন কথা বলতে পারলে? বলতে একটু লজ্জা করল না? বিবেকে বাধল না?’
‘আমি কিছু বলিনি। এমন কথা বলতে পারি না নমিতা। তুমি মিথ্যে অভিযোগ করছ।’
‘তুমি বলেছ…এখন মনে নেই, এখন অস্বীকার করলে কি হবে! তুমি বলেছ। মেয়েটা সেই দুঃখে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।’
‘আহা! কেন বললাম? কেন? আমার মা…মা গো! কেন চলে গেলি মা?’
আবিদ আলি সেই গল্প থেকে সরে আসতে নাকি অশ্রু লুকোতে টিউবওয়েলে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিতে থাকে। লেপটে থাকে তবু সমুদ্রের নোনা স্বাদ। নিজেকে অপমানের শেষপর্যায়ে নামিয়ে ফেলে। কেন বলেছিল? কী এমন ব্যস্ত ছিল যে সহজেই মেজাজ উঠে যায় নাকি কী বলে বা বলছে বোধ থাকে না? সে সত্যি সত্যি মনে করতে পারে না, কী কথায় মন খারাপ করেছিল পরি। আহা বড় মুখচাপা মেয়ে তার! কোনোদিন চোখের পানি ফেলেছে দেখেনি, সবসময় হাসিখুশি, সারাদিন নিশ্চুপ ঘরের এটা-ওটা কাজ করে, মাকে সহায়তা, এর-ওর বিবিধ আবদার বা কাজ, সেই মেয়ের বুকে নিশ্চয় কান্নার মহাসাগর; তাই সকলের অগোচরে চলে গিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

সেদিন সন্ধে থেকে রাত মন বড় ছটফট করে। আবিদ আলি ঘর আর বাহির করতে করতে একই জিজ্ঞাসা বারবার ছুড়ে দেয়। নমিতা রাতের ভাত ইনডাকশন উনুনে চড়িয়েছে। আবছায়া আলোর বাতাসে চাল সেদ্ধ হওয়ার বাষ্প ভেসে যায়। নিলু, বড়মেয়ে কথা বলে, –
‘বাবা এত অস্থির হয়ো না তো! পিকনিকের বাস ফেরত এলে তো আসবে। কেবল সাড়ে আটটা।’
‘সাড়ে আটটা অনেক রাত মা।’
‘তোর বাবা ক্রাইম পেট্রোল টাইপের ছবি দেখে দেখে মাথা পচিয়ে ফেলেছে। সবসময় টেনশনে থাকে।’
‘টেনশনের কী হলো? আজকাল মেয়েরা কাজ করছে না? শহরের রাস্তায় ঘোরাফিরা করে না? ভয় পাওয়ার কারণ আছে?’

আবিদ আলি সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছিল। তার কেন জানি সবসময় উদ্বেগ আর কুচিন্তা চেপে ধরে। স্বস্তিময় নিশ্বাস নিতে পারে না। রাতের ঘুমেও হাজারও টেনশন আর দুঃস্বপ্ন। কেন এমন হয়? সে ভয়ে ভয়ে খবরের কাগজ পড়া ছেড়ে দেয়। টেলিভিশনের খবর। সেখানেও বিবিধ কু-খবরগুলো স্ক্রোলিং করে আর কেন জানি দৃষ্টি সেখানেই আটকে থাকে। তার হার্টবিট বাড়ে। রাতে ঘুম হয় না। আজগুবি দুঃস্বপ্নে কখনো স্লিপ-অ্যাপেনিয়া ধরে। গণধর্ষণের শিকার যুবতীর লাশ উদ্ধার। তনুর ঘাতকদের বিচার কবে হবে? মুক্তিপণের দাবিতে শিশু অপহরণ। ভরাট নালায় হারিয়ে গেছে আট বছরের বালিকা। প্রকাশ্যে যুবক খুন: কেউ এগিয়ে যায়নি; মোবাইলে ভিডিও শুটিং-এ ব্যস্ত। abducted girl found brutally dead ইত্যাদি হাজারও খবরে মনে হয়, দেশ নয়, সারা পৃথিবী আজ নরকে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

তারপর সেই রাতে দেয়াল ঘড়িতে নয়-দশ পেরিয়ে এগারো-সাড়ে এগারো হলে সকলের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া জমে ওঠে। নিলু একটু আগে অন্যরকম স্বরে কথা বলছিল, সেও মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত ডায়াল শুরু করে দেয়। একবার-দুইবার কতবার কে জানে। সুজয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে। পরি কল রিসিভ করে না। কখনো শোনা যায়, ‘আপনি যে নম্বরে ডায়াল করেছেন, তা এই মুহূর্তে বন্ধ আছে’ অথবা ‘the number you are calling is switched off’| এর অনেকক্ষণ পর আচমকা ডায়াল টোন পাওয়া যায়, কিন্তু রিসিভ হয় না। সময় আরও চলে যায়। যোগাযোগ প্রচেষ্টা চলতে থাকে। একসময় যান্ত্রিক কণ্ঠে ‘আনরিচাবেল’ শব্দটি আতঙ্ক আর বিষাদ ছড়িয়ে দেয়। এমনই স্থবির সময়ে আকস্মিক মোবাইল বেজে ওঠে। নিলু খুব দ্রুত রিসিভ করে। উন্মুখ দুশ্চিন্তায় ছেলের পাশে দাঁড়ায় আবিদ আলি। নমিতা একপাশে কাজ ফেলে বসে পড়ে। সকল মনোযোগ মোবাইলে।
‘হ্যাঁ রে তুই কোথায়? পিকনিকের বাস ফেরেনি? রামসাগর থেকে আসতে এত দেরি কেন?’
‘আমি ঢাকা যাচ্ছি আপু।’
‘মানে?…ঢাকা কেন?’
‘আমি আর এক বান্ধবী গাজিপুর যাচ্ছি। চাকরি করব।’
‘তোর কি মাথা খারাপ! কে তোকে চাকরি দেবে? থাকবি কোথায়? আর বাসায় বলে যাবি না?’
‘হ্যাঁ, আমি বলি আর কেউ আসতে দেবে? আমি চাকরি করব।’
আবিদ আলি ধপ করে মেঝেয় বসে পড়ে। এ কি সর্বনেশে ঘটনা! পরি, তার আদরের মেয়ে, বাইরের দুনিয়ার তেমন কিছুই চেনে না, সে কিনা রাতের কোচে একাকী ঢাকায় যায়; তার শরীর ভারী লাগতে শুরু করে। কপালে জমে উঠে চিকন স্বেদবিন্দু। বুকের মধ্যে ধড়ফড়। নমিতা দ্রুত এগিয়ে এসে হাত টেনে ধরে।
‘নিলুর বাবা, তুমি এখানে বসো, খাটের উপর শোও! এক গ্লাস পানি এনে দিই?’
‘তুমি থামো তো মা। এখন এত নাটক করার সময় নাই। আমাকে শুনতে দাও।’
নিলু পুনরায় মোবাইলে কথা শুরু করে। এবার লাউডস্পিকার অন করে দিয়েছে। আবিদ আলি খাটের উপর বসে ভুলে যায় কী করবে অথবা কী করা উচিত। তার ভাসা ভাসা উদাস চোখ কোন অচেনায় হারিয়ে যায়। হাতে ধরে থাকা গ্লাসের জল থিরথির কাঁপতে থাকে।
‘পরি…বাবা তোর বিয়ের চেষ্টা করছে, আর তুই কিনা কাউকে না বলে…এটা কেমন কথা? হ্যাঁ রে তোর সাথে কেউ আছে?’
‘আমার বান্ধবী। তোমরা টেনশন করো না। আচ্ছা রাখি।’
‘দাঁড়া…দাঁড়া। কোন্ বান্ধবী? বাড়ি কোথায়? নাম কী? বান্ধবী না বন্ধু? পুরুষমানুষ?’
‘ফুলবাড়ির। নাম কী, দাঁড়া শুনে নিই।’
‘কেমন বন্ধু রে নাম জানিস না? সত্যি বলত কে আছে সাথে?’
‘আমি একা যাচ্ছি। বান্ধবীর সাথে ঢাকায় দেখা হবে।’
‘ঢাকার কোথায়? ঠিক করে সত্যি বল। মিথ্যা বলিস না। আমাদের টেনশন হচ্ছে।’
‘টেনশনের কী আছে? আমি শফিপুর যাচ্ছি। সেখানে গার্মেন্টস-টেক্সটাইল অনেক। একটাতে চাকরি হয়ে যাবে।’
‘তোর জন্য কেউ চাকরি নিয়ে বসে আছে? ওসব বাদ দে। ফেরত বাসে চলে আয়। সাবধানে আসবি।’
নিলু আরও কিছু বলত। তার চেহারায় ভেসে ওঠে অব্যক্ত ভাষা। রাতের বুকে দুশ্চিন্তার অচেনা কালোছায়া নেমে সময়কে স্থির করে দেয়। সে মোবাইল হাতে হতাশ গলায় বলে উঠে, –
‘মোবাইল কেটে দিয়েছে।’
‘আহ্ হা! মেয়েটা একটু বুঝল না! বড় কষ্ট নিয়ে চলে গেল নমিতা। আমার পরি…মা গো!’
‘এখন আফশোস করে কী হবে?’
নিলুর মন্তব্য বুকে শেল হানে। আবিদ আলি উঠে দাঁড়ায়। একমুহূর্তে মানুষটি শত বছর বয়সির মতো ন্যুব্জ হয়ে গেছে। প্রশস্ত কাঁধ ভেঙে পড়েছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, বুঝিবা কোনো জীর্ণ বৃক্ষ; এখনই ধপ করে পড়ে যাবে। নমিতা পেছনে অবলম্বন হয়ে থাকে। সে সহজে ভেঙে পড়ে না। তার চোখে-মুখেও বিষাদের অন্ধকার। কি থেকে কী হয়ে গেল অথবা হতে চলেছে সব বুঝি সময়কে আশঙ্কা-ভাবনায় শোকতুর করে দিতে থাকে।
‘মোবাইল কেটে দিল মা?’
‘কি জানি…নাকি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেল।’
‘কত দূর গেছে জিজ্ঞেস করত মা? না থাক আমি করছি।’
আবিদ আলি দ্রুত অস্থির টেবিলের ড্রয়ার টেনে নিজের মোবাইলে স্পিড ডায়াল করে। ডায়ালটোন বাজে। একেকটি সেকেন্ড কেয়ামতের মতো লুব্ধক প্রহর। রাত বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে বুকে চাপব্যথা শুরু হয়। শরীর কাঁপে। চোখের কোণায় নেমে আসে অবরুদ্ধ অন্ধকার। এখন কী করবে সে? মোবাইল আবার সুইচড্ অফ শোনাতে থাকে। কতবার কে জানে কেউ জানে না। ঘরের উজ্জ্বল আলো অতিশয় অসহ্য আর ভয়ংকর মনে হয়। সবাই নিশ্চুপ বসে থাকে। উনুনে ভাত পোড়া যায়।
আবিদ আলির রাতে ঘুম হয় না। প্রেশারের ট্যাবলেট নেয়। কখনো ঘুমের মধ্যে মাথার পেছনে ব্যথা তীব্র হতে থাকে। ডাক্তার সাবধান করে দিয়েছে। এই সতর্কবার্তাও কত সহজে উপেক্ষিত হয়ে যায়। নমিতারও হাইপ্রেশার। সে বসে থাকতে থাকতে বিছানায় ঢলে পড়ে। আবিদ আলি বাইরে গিয়ে খুব নিশ্চুপ কাঁদতে শুরু করে। এ ছাড়া আর কী পারে সে? চাকরি থেকে অবসরের পাঁচ-সাড়ে পাঁচ বছর পেরিয়ে যায়। জীবন আর আয়ু কখনো কখনো জানান দেয়, সময় শেষ; প্রস্তুত হও মানব। সে সবসময় প্রস্তুত। তারপরও হাজারও ব্যর্থতার আক্ষেপ বুকে জলঘোলা করে। কখনো সে-সব ছেলেমেয়ের হাসিমুখে এড়িয়ে যায়। তাদের আনন্দময় হোক। সবকিছু হাতের মুঠোয় আসুক। আজ বুঝি সব অহেতুক লাগে। তার ব্যর্থ জীবন।

অনেক চেষ্টায় নিলুর বিয়ে দিতে পেরেছে। মেধাবী মেয়ে, স্কুল-কলেজে কখনো প্রথম বই দ্বিতীয় হয়নি। নিজের চেষ্টায় চাকরি পেয়েছে। ছোট হলেও সরকারি কাজ। আবিদ আলির অহংকার। নিজের জোড়াতালি জীবনে এরচেয়ে বড় সুখ আর কী আছে! তার আনন্দ নয়, স্বস্তিও ছিল না। কোনো কোনো রাতের মধ্যপ্রহরে আজগুবি ভাবনায় জেগে বসে থাকে। গভীর ধ্যানে মনে মনে কত প্রার্থনা জপে। ভালো এক পরিবারে বিয়ে হয় যেন নিলুর। ছোট শিক্ষিত মুক্তমনা পরিবার। ভালো ঘর আসে না। ম্যাচমেকার প্রস্তাব আনে। ছবি দেখা আর গল্প শোনা হয়। একটি-দুটি দেখাদেখি পর্ব পর্যন্ত গড়ায়। তারপর আর এগোয় না। যৌতুকের বিশাল অঙ্ক অথবা সেই অজুহাত। নিলু কষ্ট পায়। তার চোখে-মুখে লেখা থাকে সূক্ষ্ম বিষাদ। ছোট থেকেই এসব শুনে শুনে বড় হওয়া। মেয়ে তো খাটো। নিলু লম্বা নয়। পাঁচফুট আধ-এক ইঞ্চি। সামান্য আর একটু উঁচু হলে কোনো সমস্যা হতো না। মেয়ে দেখতে সুন্দর। গায়ের রং ফরসা। সরকারি চাকরি করে। সবই ঠিক…একটি ‘কিন্তু’ এলোমেলো করে দেয় সব। মেয়ে তার বলে দিয়েছে। অমুক পেশার চাকরিজীবী ছেলে হতে হবে। নিজ শহরের মধ্যে হওয়া চাই। বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে চায় না। তেমন ঘর পাওয়া যে সময়সাপেক্ষ আর দুরূহ ব্যাপার। সেই তুলনায় ঘর আসে পরির। আইনুল হক, প্রফেশনাল ম্যাচমেকার। কখনো কখনো মন্তব্য দিয়ে বসে, –
‘ভাই আপনার ছোটমেয়ের ঘর আর বর পেতে অসুবিধা হবে না। যেমন শান্তশিষ্ট, গায়ের উজ্জ্বল রং আর লম্বা, পড়ালেখা একটু কম, তাতে কী, মেয়েদের ইন্টার-ডিগ্রি পর্যন্ত পড়ালেখা হলেই চলে। ওর বিয়ে দেবেন? ভালো ছেলে আছে।’
‘না ভাই আগে বড়টা।’
‘কেন ছোটটার দেয়া যাবে না? বড়টার তো ছেলে দেখা চলছে। তবে সত্যি কথা কী জানেন, মেয়ে আপনার শর্ট, তাই…।’
‘বাঙালি মেয়ে আর কত লম্বা হবে ভাই? আমার মেয়ের চেয়েও শর্ট কত মেয়ে সংসার করছে, সন্তানের মা হচ্ছে, আর আপনি এ কী বলেন? এ ছাড়া সরকারি চাকরি করে আর কী চাই?’
আবিদ আলির মন খারাপ হয়। নিলুর চেহারায় কখনো ভেসে ওঠা বিষাদ চমকে অস্বস্তিতে রাখে সারাদিন। সমাজে মানুষজন বডি শেমিং করতে ছাড়ে না। আড়ালে কত কথা বলে। নিজের হাজারও দোষত্রুটি এড়িয়ে অন্য কাউকে অকারণ টিজিং করা ব্যক্তির স্বভাব। আবিদ আলির দুশ্চিন্তা হয়। দিনে দিনে বয়স বাড়ে মেয়ের। বিয়ের জন্য টাকাকড়িও তেমন জোগাড় হলো না। তারপরও স্বপ্ন দেখে। মেয়ের বিয়ে হবে। তার নিজের সংসার। একদিন সত্যি সত্যি নিলুর বিয়ে হয়ে গেল। আবিদ আলি আনন্দ-অশ্রুতে একাকার। মেয়েকে নিজহাতে সঁপে দেয় অন্য পরিবারে। অপরিচিত ছেলের হাতে। অপরিচিত কেন, সেদিন থেকে সেও এক সন্তান। তার হাতে তুলে দিল কলিজার টুকরা। তারপর চোখ মোছে, মন কিছু মানে না; আপনমনে ঝরতে থাকে।

আজও রাত যখন কত মনে নেই, মনে রাখার প্রয়োজন পড়ে না, অশ্রুতে ভেসে যায় আবিদ আলি। ‘মা পরি…কেন চলে গেলি মা? আমার কথা একটুও ভাবলি না মা? আমাকে কে বিকেলে চা বানিয়ে দেবে? কে দুপুরের ভাত বেড়ে আদর করে ডাকবে, বাবা ভাত খাবে এসো।’ আবিদ আলির চোখ ভেসে যায়। রাতের তারাগুলো ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হতে থাকে। ভোর আসে। তার চোখে ভোর হয় না। সারাদিন মনের অলিন্দে যখন-তখন আক্ষেপ নিশ্চুপ উচ্চারণে ঢেউ তোলে। নমিতার বিষাদ অভিযোগ, –
‘নিলুর বাবা, তুমি এ কথা মেয়েকে বলতে পারলে!’
আবিদ আলির মনে নেই কী কথা বলেছিল। অবসর জীবনে শান্তি নেই। আয়-উপার্জন বন্ধ। সংসারে প্রয়োজনীয় এটা-ওটা কিনতে পারে না। দিশেহারা মনমেজাজ। বয়সের ভারে শরীর-মনে ভাঙচুর। স্মৃতির অলিগলি সবসময় গোলকধাঁধায় নামিয়ে রাখে। সেখানে আবছায়া-অন্ধকারে পথ হারানোর লুকোচুরি। আবিদ আলি জীবনপথের শেষে এসে আর কোনো নতুন দিশা খুঁজে পেতে পারে না। অকারণ শুধু জেগে ওঠে শৈশব আর কৈশোরের দিনকাল। কত উজ্জ্বল ছবি সে-সব, অথচ…। এতকিছু মনে আসে, কিন্তু কী বলেছিল, কেন বলেছিল কিছু মনে আসে না। নিশ্চয়ই খুব কঠিন কথা। আজকাল হাজারও সমস্যা আর চিন্তাভাবনার মধ্যে জীবনের ছোটখাটো চাওয়া-পাওয়া, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর প্রতারিত দিনগুলোর কথাও মনে আসে। কোথায় কোথায় ছোটবড় অপমান আর নতজানু সবকিছু মেনে নেওয়ার দৃশ্য ভেসে ওঠে। মন ভালো থাকে না। নমিতা এসবের মধ্যে কখনো খুব তাড়া দেয়। ‘পরির বিয়ের ব্যবস্থা আর কতদিনে হবে? ঘর কি পাওয়া যাচ্ছে না নাকি সবকিছু ফেলে হাল ছেড়ে বসে আছ? বেলা যে দিনে দিনে গড়িয়ে যায়।’ ম্যাচমেকার আসে। পাত্রের খবর আছে। আবিদ আলি শোনে। নিজেও কোনোদিন রাস্তায় বেরিয়ে আইনুল কিংবা নবিউলের কাছে যায়। গল্প-আলাপ করে। মনঃপূত হয় না। নবিউল বলে, –
‘ভাইজান আজকাল ছেলেরা চাকরিজীবী মেয়ে খোঁজে। আপনার মেয়ে তো কিছু করে না। গ্রামে দেবেন?’
‘সেই সকালে উঠে হাঁসমুরগির খোপরা খোলা। গোয়ালঘর পরিষ্কার করা। এখানে-ওখানে জ্বালানি টুকিয়ে রান্না। বোরখা-হিজাব আর কড়া শাসন…না ভাই। ছেলে স্কুল-কলেজে মাস্টারি করে এমন হলেও চলবে। ছোট ঝামেলাহীন মুক্তমনা পরিবার দেন। মেয়ে আমার লক্ষ্মী। শান্তশিষ্ট। বেঁচে থাকার জন্য হাইফাই চাহিদা নাই। একেবারে মায়ের মতো।’
‘সে ঠিক আছে ভাইজান। আজকাল ছেলের মধ্যে গোঁজামিল আছে। ড্রাগ মদ নেশা কত কি!’
‘সেই তো ভাই। এক মুরুব্বি বলেছিলেন, আপনি মেয়ের বাবা, আপনার চিন্তাভাবনা চোদ্দো আনা, ছেলে পক্ষের দুইআনা। সমাজে একবার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর যদি ঘর ভেঙে যায়, সেই মেয়ের আর বিয়ে হয় না, অনেক ঝামেলা-মুসিবত। পুরুষমানুষের সমস্যা নাই’
‘একজন পাত্র আছে। আপনি মেয়ে দেবেন?’
‘যেমন?’
‘পাত্রের সয়সম্পত্তি অনেক। সচ্ছল পরিবার। বাবা নাই। মা আর ছেলে। বিশাল পুকুর। ধানিজমি।’
‘ছেলের সমস্যা নেই তো?’
‘ভাইজান পাত্র বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। এমপিওভুক্ত। সপ্তম গ্রেড।’
আবিদ আলি নড়ে বসে। ফুটপাতের চা-স্টলে ভিড় কম। দুপুরের রোদে প্রচণ্ড তাপ। একটুও বাতাস নেই। দেবদারু গাছের পাতাগুলো বুঝি হেরে গিয়ে ঝিম মেরে আছে। তার মনে দখিনা বাতাস। খুব লোভ জাগে। সব সুযোগ কি জানি হাতছাড়া হয়ে যায়। সে নিচুগলায় কথা বলে, –
‘ছেলের বাড়ি কোথায়? বয়স? রক্তের গ্রুপ? সব ম্যাচ করবে তো? ছবি আর বায়োডাটা দেখান।’
‘সব ঠিক আছে ভাইজান। দেখেন…যদি পছন্দ হয়।’
নবিউল তার সাইকেলে ঝুলিয়ে রাখা ব্যাগ এনে খুলে বসে। একটি একটি করে কাগজপত্র দেখে নেয়। তারপর যেনবা আলিবাবার গোপন গুহার রত্নভান্ডার আবিষ্কার হয়েছে, এমনভাবে উৎফুল্ল বায়োডাটা আর ছবি এগিয়ে দেয়। আবিদ আলি সাগ্রহে হাতে টেনে দেখতে থাকে। পরির সঙ্গে মানাবে তো? বয়স আর চেহারাছবি? কথায় বলে ফেস ইজ দ্য ইনডেক্স অব মাইন্ড। চেহারা হলো মনের আয়না, যদিও দর্পনে সবকিছু প্রতিফলিত হয় না।
‘নবিউল ভাই, ছেলে তো মাশআল্লাহ, সবদিকে সুন্দর, কিন্তু ভাই, আমার মতো গরিব ঘরের মেয়ে নেবে?’
‘সেই চিন্তা আমার। আপনি রাজী থাকলে দেখাদেখির দিন করে ফেলি। তবে ভাই একখান কথা আছে।’
আবিদ আলি চমকে উঠে। নবিউল কাগজপত্র গোছাতে গোছাতে বাইরে তাকায়। একটি কুকুর কোত্থেকে এসে জোর হাপাতে শুরু করেছে। তার শরীরে কোনো লোম নেই। অদ্ভুত উদোম চোখে চারপাশ দেখে নেয়।
‘ভাইজান, ছেলের একবার বিয়ে হয়েছিল। আড়াই-তিন বছরের সংসার। বউটা বাঁজা। বাচ্চাকাচ্চা হয় না। গত বছর মাদ্রাজ যাওয়ার প্ল্যান করেও করোনার কারণে যেতে পারেনি। তারপর উভয় পরিবারের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শেষে ডিভোর্স হয়ে গেছে।’
‘ও!’
‘ভাইজান ভালো ছেলে। সৎ। অমায়িক ব্যবহার। জমি-বাড়িঘর-পুকুর সব তার নামে। সংসারে এক মা। বয়স্ক মানুষ। আমি ভিডিও করে আনছি। দাঁড়ান আপনাকে ছবি দেখাই। এটা খুব ভালো হবে ভাইজান। পুরুষ মানুষ একবার কেন, চারবার বিয়ে করতে পারে। আর দেখেন, ডিভোর্স হয়ে গেছে। কোনো ঝামেলা নাই। আপনার মেয়ে রানির হালে থাকবে।’
‘বিবাহিত পাত্র। ডিভোর্সড। বাড়িতে পরামর্শ করি। তারপর জানাই।’
‘এমন সুযোগ বারবার আসে না ভাইজান। আপনি বায়োডাটা ছবি নিয়ে যান। ভাবীর সাথে আলাপ করেন। ছেলে কিন্তু ফার্স্ট ক্লাস। কোনো দেনা-পাওনা নাই, বরং মেয়েকে সাজিয়ে নিয়ে যাবে।’
‘ভাই কথা বলি বাসায়। তারপর জানাব।’

আবিদ আলি জানে জীবন হলো সিরিজ অব কম্প্রোমাইসেস। মানুষ যা চায়, সবটুকু মেলে না; কিছু ছাড় দিতে হয়। একেই বলে নিয়তি। নিয়তির পরিহাস। মানুষের জীবন কত ছোট, আর এই ক্ষুদ্র সময়ের জন্য হাজারও আয়োজন; চাওয়া-পাওয়া আর হিসাবনিকাশ। কে জানে এও কোনো নিয়তির খেলা। কপালের লিখন। এমন দোলাচল ভাবনার মধ্যে অচেনা একটু স্বপ্নও উঁকি মারে। চাই কি পরি সুখে থাকবে। চোখের সামনে দেখতে পাবে। পুরো সংসারের কর্ত্রী। আবিদ আলি বায়োডাটা আর ছবি হাতে খুশি খুশি মনে ঘরে ফেরে। আবার পরক্ষণে রংধনুর সাতরং দিগন্তে মিশে যায়। নমিতা সব শুনে বলে, –
‘ডিভোর্সড পাত্র। আগের বউকে ছেড়ে দিল কেন? বাঁজা নাকি অন্যকোনো কারণ আছে? ছেলে ঠিক আছে তো? আচ্ছা কেন ডিভোর্স হলো? ওই মেয়ের সাথে কথা বলে দেখবে নাকি? সেই সুযোগ আছে?’
আবিদ আলি রোদে রোদে অনেকটা পথ হেঁটে এসেছে। শরীরে লেপটে আছে চিটচিটে ঘামের উত্তাপ। ক্লান্তি-ক্ষুধা আর চিন্তায় বড় অস্থির লাগে। ব্লাড সুগার লেভেল কি কমে গেল? তার অদ্ভুত অনুভূতি হয়। নমিতার কাটা কাটা জিজ্ঞাসায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। তারপর…হ্যাঁ তারপর, মনে পড়েছে, সেই কথা বলেছিল, একটু হয়তো উঁচুস্বরেই আর পরি তখন বাথরুম থেকে বের হয়ে চুলে তোয়ালে জড়িয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নমিতা দেখে-শুনে একেবারে চুপ। সময় কেমন জানি মৌন স্থবির আর বিব্রত হতবাক।
‘এত প্রশ্ন আর চাপ রাখলে তো কাজ হবে না নমিতা। আমি কি রাজার কোতোয়ালের মতো ঢেঁড়া পিটিয়ে বেড়াব? মেয়ের বিয়ে দিতে চাই নাকি স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করব? তোমরা আমার মাথা খারাপ করে দেবে দেখছি।’
‘তোমাদের কিছু করতে হবে না বাবা। বিয়ে না হলে চলে না? আমি তোমাদের কাছে থাকব।’

আবিদ আলির দৃষ্টি আবার ঝাপসা হয়ে ওঠে। সেদিন কেন নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি? অনেক অভিমানে শেষ মন্তব্য করেছিল পরি। আহা তার কলিজার টুকরা! ঘরের লক্ষ্মী। আত্মজা। এরপর সেই দিন সেই রাত। আবিদ আলির নরক যন্ত্রণার শুরু হয়। কোথায় ভেসে গেল মেয়ে তার? কেমন আছে? ভালো আছে তো? সেই রাতের কপিশ অন্ধকার বাড়ির সবটুকু আলো কেড়ে নেয়। তার মনের আলোকিত দখলগুলোও হারিয়ে গেল তামসিক আশঙ্কা-দুশ্চিন্তায়। সে ঘুমোতে পারে না। কতবার ভেবে নেয় একবার নিজে গিয়ে খুঁজে আনবে। কোথায় যাবে? কোন্ ঠিকানায়? পরদিন সকালে যখন মোবাইল আসে, নিলু কথা শেষে একেবারে হতাশ বলে বসে, –
‘পরির সাথে কেউ আছে বাবা। মনে হয় পুরুষ মানুষ।’
‘অ্যাঁ! কে সে? কোন্ যে ফাঁদে পড়ে গেল মেয়েটা!’
আবিদ আলি ঘর থেকে পাগলের মতো রাস্তায় বেরিয়ে যায়। সারাদিন কী যে হারিয়ে যাওয়া স্বস্তি আর আনন্দ কখন ব্যর্থ খুঁজে খুঁজে অস্থির ফিরে আসে জানা নেই। সকল বোধ-জ্ঞান খাঁ-খাঁ শূন্য। জীবনের সকল আনন্দ-হাসি খোয়া গেছে তার। দিনভর অভুক্ত শরীর আলগোছে এলিয়ে পড়ে। বিড়বিড় করে শুধু ডেকে যায় ‘পরি মা, পরি মা গো…আমাকে মাফ করে দে মা। মাফ করে দে।’

পরি ফিরে এসেছে। তার চেহারায় সত্যি কি আনন্দ? খুশির আড়ালে লুকোনো কান্নার কারুকাজ? কখনো রাজ্যের শত ক্লান্তি-অবসাদ ভেসে ওঠে। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে হেসে যায়। একে-ওকে এটা-সেটা এগিয়ে দেয়। আবিদ আলি নীল স্ট্রাইপ্ড সার্ট হাতে নিয়ে ঝাপসা ভেসে যায়। সেখানে জড়িয়ে থাকে অনুতাপ-ব্যর্থতা, বিবেকের দংশন, যেখানে স্নেহ-ভালবাসা আর আত্মার বন্ধন বুঝি কত ঠুনকো লাগে।

পরি চাকরি পেয়েছে। বিদেশি টেক্সটাইল। সকাল আটটা থেকে রাত আট কিংবা নয়-দশ পর্যন্ত কাজ। রাত আটটা থেকে ভোর পাঁচ কিংবা সকাল সাড়ে আট। দিন আর রাতের শিফ্ট। সাতদিন পর পর রোটেশন। বস্ত্রবালিকা শ্রমিক। দিনহাজিরা উপার্জন। সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আছে ওভারটাইম। বেতন মাত্র আট হাজার টাকা। ওভারটাইমের মজুরি প্রতিঘণ্টা চল্লিশ টাকা। এইসব বিবিধ তথ্য ইতিহাস জেনে মন কাঁদে আবিদ আলির। এজন্যেই কি মেয়েকে কলেজে বিএ পড়িয়েছিল? আরও কিছু জিজ্ঞাসা মাথায় শুঁয়োপোকার মতো যন্ত্রণা তোলে। সেই বান্ধবীর নাম-ঠিকানা কী? সেই রাতে জেগে ওঠা একটি সন্দেহ দানাবেধে খুব কাতর করে আজও। পরি আসলে কার কথায় নাকি নিজ জ্ঞানে এমনভাবে একাকী চলে গিয়েছিল? সে কি পুরুষমানুষ? কতদিনের পরিচয়? প্রতারক এই দিনকালে আস্থাভাজন মানুষ কোথায়? সে যে ভুল পথে পা বাড়িয়েছে। এইসব কথা বলতে আর প্রশ্নের উত্তর জেনে নিতে তীব্র তাগিদও ওঠে, কিন্তু কথা তুলতে ভয় হয়; পাছে অন্যকিছু ঘটে। অবশেষে সবকিছু নিয়তির হাতে ছেড়ে দিতে অথবা কী করবে বা করা উচিত কোনো খেই না পেয়ে নিশ্চুপ উদাস হয়ে থাকে। পরি এসেছে। তাকে আর যেতে দেবে না। এতগুলো মাস নরক যন্ত্রণায় কেটে গেছে। তাকে আর দূরে যেতে দিয়ে হারাতে চায় না। আইনুল কি নবিউল বা অন্য কারও সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে। এবার ভালো পরিবার দেখে আর দ্বিধা রাখবে না। অথচ সকল প্রত্যাশা কাচের মতো ভেঙে ভেঙে যায়। আবিদ আলির বুকের কষ্ট কেউ একবার ভেবে দেখে না।

তিনটি দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। পরি ব্যাগ গোছগাছ করে। আবিদ আলির সকল অনুরোধ কি নির্দেশ শোনে না কেউ। পরিকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও। এই একটি কথায় আরও ইঙ্গিত থাকে। ছেলেমেয়েকে চিরকাল বুকের কাছে আগলে রাখতে পারবে? সেই ক্ষমতা আছে? আবিদ আলির শক্তি বা ক্ষমতা নাই। উপার্জনহীন অবসর জীবনে সে-সব থাকে না। পরি চলে যাবে। সুযোগ বুঝে আবার আসবে।
সেই রাতে বাস কাউন্টারে এসে দাঁড়ায় আবিদ আলি। সুজয় এসেছে। ছেলে বিষাদ চোখে বারবার মুখের দিকে তাকায়। পরির চেহারায় শুধু কোনো ভাবান্তর নেই। সে অনড় নিষ্প্রভ দাঁড়িয়ে থাকে। এত অনুরোধ আর চোখের জল খুব সহজে এড়িয়ে যায়। নিলু বলে, –
‘বাবা ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দাও। তোমার কারণে আমরা ঠিকমতো এগোতে পারি না। সবখানে বাধা।’
আবিদ আলি কথা বলতে পারে না। কী বলবে? ছেলেমেয়ের প্রয়োজনীয় লজিস্টিক দিতে পারেনি। অভাব-অনটনের সংসারে যতটুকু ভালো থাকা সে শুধু অস্তিত্ব টিকে রাখার সংগ্রাম। একাকী যুদ্ধ। সে আর যুদ্ধ করতে পারে না। অক্ষম বৃদ্ধ মানুষ।

রাত সাড়ে নয়ে নাইটকোচ ছেড়ে যাবে। পরি এবার কোচে উঠবে। আবিদ আলি পেছনে নাকি সামনে, রাস্তায় আলো-অন্ধকারের মতো মানুষজন আর ভিড়; সেখানে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? সে খুব আলগোছে মেয়ের মাথায় হাত রাখে। একহাতে জড়িয়ে নেয়। আহা আর কবে দেখা হবে! কতদিন পর? আদৌ দেখা হবে কি না। হতভাগী মেয়ে। পরি বলে, –
‘বাবা টেনশন করো না। তোমার শরীর খারাপ। নিজের দিকে খেয়াল রেখো’
‘তুই কেন চলে যাচ্ছিস মা? আমার কলিজা…মা রে। আবার কবে আসবি? আর কি দেখা হবে?’
‘বাবা কেঁদো না তো। সামনে ছুটি পেলে চলে আসব। টেনশন করবে না।’
‘আমাকে মাফ করে দে মা। কেন আমি বললাম? কেন বললাম? আমার মা জননী…মা গো।’
আবিদ আলির বুকে হু-হু কান্না জল হয়ে গলে যেতে শুরু করে। পরি কাঁদে। বাবার বুকে মাথা রেখে চুপে চুপে অশ্রু ঝরায়। সুজয় দু-জনকে আগলে ধরে চোখ মোছে বারবার। আবিদ আলি উপায়হীন অসহায়ের মতো মেয়ের কপালে-মাথায় বারবার চুমু দেয়। তার চোখের জল গড়িয়ে কোথায় নেমে যায় কে জানে। সে আজ নীল রং সার্ট পরেছে। পরি দিনভর দাঁড়িয়ে থেকে উপার্জন করেছে তার মূল্য। সেই সার্টে লেপটে আছে কত কষ্ট-ভালবাসা-মায়া আর অদৃশ্য ইতিহাস। আবিদ আলির মনে সুখ নেই। সে বুঝি সুতোয় বোনা কোনো কাফন জড়িয়ে নিয়েছে।

এদিকে চারপাশের অন্ধকার আরও ঘনীভুত হতে থাকে।

সারাবাংলা/এসবিডিই

গল্প মাহবুব আলী সাহিত্য সুতোয় বোনা কাফন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর