একজন কবি শামীম আজাদ এবং আমার অনুভূতি
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:২৬
কবি শামীম আজাদের সাথে ফোনে কথা হচ্ছিলো৷ না, এ শুধু কথোপকথন নয়, ছিল অনুভূতির আদান-প্রদান। ছিল এক অদ্ভুত প্রণোদনার মুহূর্ত! ভালোলাগা, ভালোবাসার আবেশে হচ্ছিলাম জর্জরিত। কবিতায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ
কবি শামীম আজাদকে বাংলা একাডেমি সাহিত্য ২০২৩, পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একটা কথা, এই আমরা যারা বাংলাদেশের মূল ভুখন্ডের মানে কর্ষণ ক্ষেত্রের বাইরে – জমির আলে পড়ে আছি কিন্তু সেখানের উৎপাদিত সাহিত্য সম্ভার বাংলায় দিয়ে চলেছি, দেশের বোদ্ধারা আমাদের একটি নাম দিয়েছেন; আমরা নাকি ‘প্রবাসী কবি’। বিদেশবিভুঁইয়ে বাংলা সাহিত্য চর্চা করে আসছেন যারা, যাদেরকে বাংলাদেশের মূলধারার সাহিত্যিক বলা হতো না: মনে করা হতো বাংলাদেশ থেকে বের হয়ে আসা এক বিচ্ছিন্ন সাহিত্যগোষ্ঠি, এমন বিরূপ মানসিকতায় চরম ধাক্কা খেলো ২০২৪ এ ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ‘লেখক’ শব্দের পাশে ‘প্রবাসী’ শব্দ জুড়ে দিয়ে বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকেরা যে ব্যারিকেড তৈরি করে রেখেছিলেন, তাও এক ফূৎকারে দূরীভূত হলো। তাঁর এই প্রাপ্তি এক পরম প্রাপ্তি; আমাদের সকলের প্রাপ্তি। অভিনন্দনে অভিসিক্ত হচ্ছেন কবি শামীম আজাদ। সেইসাথে পৃথিবীর সকল প্রান্তের বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্যিকেরা হলেন উচ্ছ্বসিত।
কবি শামীম আজাদের অর্ধ শতাব্দীর কবিতা যাত্রা। যে যাত্রার অধিকাংশ সময়টাই তিনি বিলেতবাসী। কিন্তু তাঁর অবস্থান নয় অবদানই হল আজ স্বীকৃত। ধন্যবাদ বাংলা একাডেমি। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে ও নানান প্রক্রিয়া ও প্রকারে তিনি প্রবাসে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান যতটা দৃঢ় করেছেন, ঠিক ততটাই তিনি বাংলা কবিতার রাজ্যে হয়েছেন একজন বিদগ্ধ কবি। বাংলা শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চায় বিলেতবাসী কবি শামীম আজাদের এই বর্ণাঢ্য জীবনের কাছে আমরা সকলেই বিশেষ করে প্রবাসী বাঙালিরা চিরঋণী এবং নমিত। দীর্ঘ সময় ধরে বিরামহীন সাহিত্য সাধনার মূল্যায়নের ফলস্বরূপ বাংলা একাডেমির এ সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমরাও যারা প্রবাসে লেখালেখির জগতে আছি তারাও হয়েছি প্রাণিত, পুরস্কৃত।
বিদেশবিভুঁইয়ে লেখকদের ‘প্রবাসী’ বলে বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতার বিরুদ্ধে সচেতন অনেকেই সোচ্চার ছিলেন, তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করে কিম্বা কণ্ঠ তোলে। সৃষ্টিশীল মননশীল কাজের জন্য কোনো ভৌগোলিক সীমারেখা নাই, এই প্রত্যয়ে প্রতিবাদটা বেশ সোচ্চার ছিল। এ প্রসঙ্গে কবি বলেন, ” রোজী, এই তোমার আমার মতো যারা বাংলা সাহিত্যের জন্য কাজ করছি, আমি মনে করি আমরা ডায়াসপারা কবি সাহিত্যিক বলেই বাংলা সাহিত্যে- বাংলাদেশের সাহিত্য ভান্ডারে সংযোগ করছি এক ভিন্ন দ্যোতনা, আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রসূত এক নতুন মাত্রিকতা। এসব হলো বাংলা সাহিত্যের জন্য অর্জন। তিনি আরো বলেন, “এই ‘প্রবাসী’ সৃষ্টিশীল মানুষগুলোর দ্বারাই তা হচ্ছে। সেইসাথে এরাই বহির্বিশ্বে শিল্পসাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চার সুযোগে বাংলা ভাষা, সাহিত্যকে তুলে ধরছে। তাহলে আমাদেরকে এভাবে আলাদা করে মূল্যায়ন করবে কেন?”
প্রথমে ‘ প্রবাসী লেখক’ বলে বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রদান শুরু করলে ‘প্রবাসী ‘ শব্দের বিরুদ্ধে বৃটেনে বাঙালি সমাজে তুমুল প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। যার ফলশ্রুতিতে ‘প্রবাসী’ শব্দ উঠিয়ে ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’ নামে পুরস্কার ঘোষণা করা হলো। কিন্তু সেই পুরস্কারটি শুধু প্রবাসী লেখকদের জন্য বরাদ্দ রাখাতে আবারও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷ অনেকে এমন পুরস্কারের বিরুদ্ধে জোরালো কলম চালাতে থাকেন। মঞ্চে বসেও অনাবাসী ব্যক্তিত্বরা প্রতিবাদ করতে থাকেন। অবশেষে ২০২৪ এ এসে এর সুরাহা হলো। এরজন্য পুরো কৃতিত্ব বাংলা একাডেমির মহা পরিচালক কবি নূরুল হুদার। তিনি এই বিতর্কিত সিস্টেমের অবলুপ্তি ঘোষণা করেন এবং আরো বলেন, বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টিশীল মননশীল কাজের জন্য স্বদেশ বিদেশ বলে আর কিছু থাকবে না। সেইসাথে প্রবাসী শব্দটাও উঠে গেলো। বলতে গেলে কবি নূরুল হুদা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন এবং সেইসাথে প্রবাসী কবি শামীম আজাদকে পুরস্কৃত করে যোগ্য সম্মান দিলেন। আমরা প্রবাসীরা কবি নুরুল হুদার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ এবং চিরনমিত হয়ে থাকবো। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ভাবে কবি নূরুল হুদার ‘যতদূর বাংলা ভাষা’ কবিতার কিছু অংশ উল্লেখ না করলেই নয়,
যতদূর বাংলা ভাষা
মুহম্মদ নূরুল হুদা
‘যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ।
দরিয়ানগরে জন্ম, পৃথিবীর সর্ব প্রান্ত আমার স্বদেশ।।
এ বাংলার হাটে মাঠে, ধানীরং কিষাণীর বাটে,
দিগন্তের মেঠোপথে, সাধু সন্ত অথবা বখাটে
নদী ও নারীর বাঁকে পাখপাখালির ঝাঁকে
হাজার বছর ধরে জীবনের আনন্দরা হাঁটে
শাম্পান ভাসায় তারা আঁশনাই দরিয়ার তরঙ্গে অশেষ
যতদূর বাংলা ভাষা, ততদূর এই বাংলাদেশ।’
“প্রাণকে নারী পূর্ণতা দেয়,এইজন্যেই
নারী মৃত্যুকেও মহীয়ান করতে পারে”, (বাঁশরি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কবিগুরুর এই চরণ দিয়ে দ্যার্থহীন কণ্ঠে বলতে পারি, নারী পারে। হ্যাঁ, নারী পারে। এই পারার জন্য নারীকে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ করতে হয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে, যেখানে নারীকে দেখা হয় অজ্ঞ হিসেবে। সাহিত্যের জগতেও নারী কবি পুরুষ কবি বলে বিভেদ করা হয়। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা এতটাই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে নারী তার যোগ্যতা দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে গিয়ে কখনো হয়েছে বিপ্লবী, কখনো হয়েছে কৌশলী। কিন্তু সব নারীর উদ্দেশ্যই হলো কিভাবে আত্মসম্মান নিয়ে শিরদাঁড়া করে চলবে। সেক্ষেত্রে কবি শামীম আজাদ ব্যতিক্রম ছিলেন না। তার সাহিত্যের জগতে দীর্ঘ যাত্রার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর। তারই প্রতিবাদ স্বরূপ কবি নিজে বলেন, ‘বিশ্বভাস্যে কবিরা(পুরুষ কবি) যদি হন পীর পয়গম্বর/ আমিও পিরানী তবে বহুদিন ধরে বিলাইতেছি কবিতার আতর।’ পুরুষের দাম্ভিকতার কাছে সব নারী কুপোকাৎ হওয়ার নয়। একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা এবং নিবেদিত প্রাণ থাকলে একদিন না একদিন সাফল্য আসবেই। এমনই কথা হচ্ছিলো কবির সঙ্গে। সাহিত্যের জগতে বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে তাকে অর্জন করতে হয়েছে আজকের এই সম্মান এবং বিরল স্বীকৃতি। এজন্য কবি শামীম আজাদ আমাদের কাছে নমস্য একজন।
কবি শামীম আজাদ বিলেতে বাংলা ভাষার প্রধান কবি হিসেবে আদৃত। তাছাড়া কবি, যুক্তরাজ্যের ও বাইরের স্বনামধন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মিউজিয়াম, আর্ট গ্যালারী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে আবাসিক কবি, লেখক, প্রশিক্ষক ও ট্রাষ্টি হিসাবে কাজ করেছেন। কবির কর্মযজ্ঞের উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে,
১৯৯৭ সালে আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী ‘দি নিউইয়র্ক’এর বিশেষ সংখ্যায় তাঁর কবিতার অনুবাদ ছাপানো হয়; ২০১১ সালে এডিনবরা ফ্রিঞ্জ ফেস্টিভ্যালে প্রথম বাংলাদেশী কবি হিসেবে পরিবেশন করেন কবিতা ও গল্প, সেইসাথে ইতিহাসে লিখিয়েছেন নাম; অলিম্পিক ২০১২ তে কালচারাল অলিম্পিয়াডে করেছেন স্টোরিটেলিং; ব্রিটিশ লাইব্রেরী ও হাফমুন থিয়েটার তাঁর কবিতা, সাক্ষাৎকার আর্কাইভ করেছে এবং ২০১৯ এ গ্রীস এথেন্সে ‘এ্যা পোয়েটস আগোরা’র একজন আবাসিক কবি হিসেবে ছিলেন। তাছাড়া, দেশের শিকড় সংলগ্ন হয়ে থাকতে ২০০৬ সালে ‘বিজয়ফুল’ কার্যক্রম নামে কবি যে সৃষ্টিশীল উদ্যোগ নিয়েছিলেন আজ তা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অমর করে রাখার জন্য হয়ে উঠেছে এক অনন্য যজ্ঞ।
সত্তর ও আশি দশকের পুরোটা সময় জুড়ে বাংলাদেশে সাপ্তাহিক ’বিচিত্রায়’ সাংবাদিকতা, ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা, রেডিও ও টেলিভিশনে উপস্হাপনা এবং সেই সঙ্গে কবি ও লেখক হিসেবে নিরন্তর সাহিত্য সাধনা করে কবি শামীম আজাদ এক কর্মমুখর ও বর্ণিল সময় কাটিয়ে যাচ্ছেন। অসংখ্য কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদ, শিশুগ্রন্থ লিখে বিলেত ও বাংলাদেশে সাহিত্যের জগতে তাঁর অবস্থান দৃঢ় করেছেন। ১৯৯০ সালে শিক্ষকতার জন্য তিনি বিলেতে যান। সেখান থেকেই তিনি বাংলাদেশে এবং বিলেতে অনবরত লিখে গেছেন। যার কারনে তিনি কখনোই পাঠক সংলগ্নতা হারাননি।
দীর্ঘকাল প্রবাসে থেকেও কবির দেশপ্রেমে ভাঁটা পড়েনি। বরঞ্চ দেশপ্রেমে আরো বেশি উজ্জীবিত হয়ে দেশজ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ইতিহাস এবং বাংলা সাহিত্য প্রবাসের মাটিতে বোপন করেছেন, বানিয়েছেন পশ্চিম ও প্রাচ্যের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। সেইসাথে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সম্মিলনে স্বকীয় ভুবন নির্মাণে তিনি সাক্ষর রেখেছেন। বিশেষ করে প্রবাসে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের, ঐতিহ্যের, ইতিহাসের প্রাণসঞ্চার করেছেন। তার স্বদেশ প্রেমের লালিত্য স্বপ্নের আবিস্কার হলো ‘বিজয় ফুল’। যা আমাদের একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক; সমগ্র বাঙালি সত্তা এবং অস্তিত্বের প্রতীক।
সাপ্তাহিক বিচিত্রার মাধ্যমে কবি শামীম আজাদ বাংলাদেশের দেশী বস্ত্র ও ফ্যাশন নিয়ে লিখে দেশে জার্নালিজমের পথিকৃৎ হিসেবে স্বীকৃত হন। তিন দশকের উপরে দেশের বাইরে বাস করলেও সমান ভাবে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় বিভিন্ন পত্রিকা, সাময়িকী ও সংকলনে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে তার বাংলা, ইংরাজী এবং বাংলা কবিতার অনুবাদ। তিনি এক বিরল দৃষ্টান্ত যিনি দেশে ও বিদেশে কবি হিসেবে একটি শক্ত অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। ইংরেজী ও বাংলা ভাষায় কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক, অনুবাদ, শিশুগ্রন্থ মিলে তাঁর বইয়ের সংখ্যা সাঁইত্রিশোর্ধ। কবি শামীম আজাদের উল্লখযোগ্য গ্রন্হ: হে যুবক তোমার ভবিষ্যত, মধ্যবিত্ত বদলে যাচ্ছে, দুই রমনীর মধ্য সময়, ওম, স্মৃতিকাব্য, বিলেতের স্ন্যাপশট, পকেট ভরা পাঁপড়ি, ১০০ প্রেম অপ্রেমের কবিতা, বুগ্লী দ্যা বার্গেন্ডী চিতা, এ্যা ভক্সাল কোরাস ও ব্রিটিশ বাংলাদেশী পোয়েট্রি।
কবি ও কবিতা অসীম, সাহসী এবং স্বাধীন। কবি শামীম আজাদের লেখনী শক্তি দেখে এমনটাই প্রতীয়মান হয়। নিরন্তর লিখে যাওয়া এই কবি তার দৃঢ়তার, সাহসিকতার পরিচয় কালের যাত্রায় রেখে যাচ্ছেন। তার লেখনীতে যেভাবে দেশমাতৃকার কথা এসেছে, ঠিক সেভাবে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, নদী, নৃতত্ত্ব, এসেছে কবির আত্মজীবনী। পরবাসে থেকে অবিরাম লেখায় বাংলাদেশকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। সেই বাংলাদেশ আজ কবি শামীম আজাদকে চিহ্নিত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়েছে। তারজন্য আমরা গর্বিত। তাই প্রার্থনা করি কবি শামীম আজাদ সাহিত্যের পথচলায় দীর্ঘজীবী হোন।
সারাবাংলা/এসবিডিই