সম্প্রীতির ঈদোৎসব
১০ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:৫৩
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘ও মন, রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ গানটি ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের সর্বত্র বেজে ওঠে। শুরু হয় ঈদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস। ঈদুল ফিতর মুসলমান সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলেও যুগ যুগ ধরে জাতি, ধর্ম, বর্ণ সকলে মিলে এই উৎসবে শামিল হন। এখানে থাকে না কোন ধনী, গরিব, উঁচু, নিচুর ব্যবধান। ঈদ বাংলাদেশে সম্প্রীতির এক সার্বজনীন মিলন উৎসবে পরিনত হয়েছে।
ঈদের মহান শিক্ষা হলো, মনের সব কালিমা ও পাপের গ্লানি দূর করে লোভ লালসা মুক্ত হওয়া। হিংসা, বিদ্বেষ, বিভেদ, কূপমন্ডুকতা, সাম্প্রদায়িকতা সহ অশুভ ও সুন্দরকে নির্বাসন দিয়ে উন্নত-সুন্দর ও সৃজনশীলতার চর্চায় শুদ্ধতম জীবন গড়া। এটা শুধু মুসলিম ধর্মের কথা নয়, প্রতিটি ধর্মেরই সার কথা।
ঈদের অন্যতম ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব হলো, সকল মতভেদ ভুলে মুসলিম সমাজের সকল স্তরের মানুষ একত্রে ঈদের জামাতে শামিল হয়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়। ঈদের দিন সাধ্য মত সবাই নতুন পোষাক পরে পুরনো জরাজীর্ণকে বিদায় দিয়ে নতুন উদ্যমে আনন্দে মেতে উঠে। একে অপরের বাড়িকে দাওয়াত খায়, গড়ে উঠে ভ্রাতৃত্বের সামাজিক বন্ধন।
রমজান, ফিতরা ও ঈদ একই সূত্রে গাঁথা। ঈদের নামাজ আদায় করার আগেই ফিতরা দেওযার রেওয়াজ আছে। ফিতরার উদ্দেশ্য হলো, দারিদ্র্যের কারণে যাতে কেউ আনন্দ থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটার নিশ্চয়তা বিধান করা। ফিতরা অসহায় গরিব-দুঃখী মানুষের ন্যায্য পাওনা। ফিতরার মধ্যেই আছে গরিব মানুষের ঈদের আনন্দোৎসব।
বাঙালির ঈদ উৎসবের ক্রমবিকাশ নিয়ে গবেষক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভব ঘটে, তাদের হাতেই ধর্ম -সামাজিক আনন্দ উৎসব হিসেবে সাংস্কৃতিক ভাবে ঈদ উৎসবের সূচনা ঘটে। চল্লিশের দশকের পর ধীরে ধীরে ধর্ম -সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে বিশাল আবর্তনে রূপান্তরিত হচ্ছে। তবে বাংলার আধুনিক ঈদ উৎসবের ‘সেকাল’ সত্তর-আশি বছর এখন পর্যন্ত অতিক্রম করেনি। রাজধানী শহর ঢাকার (১৬০৮) প্রতিষ্ঠার পর এখানে মোগল শাসক, ঢাকার নবাব, অভিজাত ধনিক-বণিক সম্প্রদায় এবং আদি ঢাকাবাসীর বর্ণাঢ্য ঈদ উৎসব উদযাপনের পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেসময় ঈদের উৎসব অবস্থা মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে সেকালের ঈদ উৎসব তেমন একটা ছিলনা বললেই চলে। কারণ কৃষি নির্ভর গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র, তাদের হাতে ঈদ উৎসব পালনের মতো নগদ অর্থ ছিলনা। আধুনিক অর্থে সামাজিক চেতনা ও কমিউনিটির বোধেরও তখন জন্ম হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও সৃষ্টি হয়নি। ১৯৩৭-৪০-এ বাংলায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সময়কাল থেকে ধীরে ধীরে ঈদ উৎসব বিস্তার লাভ করে। আর ১৯৭১-সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর নগর উন্নয়ন, মধ্যবিত্তের বিপুল বিস্তার এবং নগদ অর্থবিত্তের সমাগমে ঈদ উৎসব এক বর্ণাঢ্য ও জাতীয় উৎসবে পরিনত হয়েছে।
ঈদ উপলক্ষে মেলার প্রচলন গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের আগে শুধুমাত্র শহরাঞ্চলেই ছিল। ঢাকার ধানমন্ডি, চকবাজার, কমলাপুর ও রমনায় ঈদ মেলার সুচনা ঘটে। পরবর্তীতে খুব দ্রুতই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্জলে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুতই তা ঈদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিনত হয়। মেলায় শিশু কিশোরদের খেলনা, হরেক রকমের মিঠামন্ডা ও নানা প্রকারের খাবার পাওয়া যায়। এসব মেলায় জাতি, ধর্মের কোনও ভেদাভেদ নেই।
একবিংশ শতাব্দী হলো প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগ। ঈদের আনন্দেও এসেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। বর্তমান সময়ে প্রভাবশালী যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক জুড়ে থাকে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়। আগেরকার দিনের ঈদ শুভেচ্ছা কার্ড হারিয়ে গেছে। স্থান করে নিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির মেসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ এসএমএস,, ভয়েজ এসএমএস কিংবা ফোনে কলে ‘ঈদ মোবারক’ ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়। মোবাইল ফোনে মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যাটিংয়েই চলছে এখনকার সময়ের তারুণ্যের ঈদ উৎসব।
যেকোনও দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামোতে উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে বড়দিনকে কেন্দ্র করে যেমন কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও ঈদকে ঘিরে সবকিছুই কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠে। ঈদ মৌসুমে বিদেশে কর্মরত লক্ষ লক্ষ মানুষ রেমিট্যান্স পাঠানোর কারণে অর্থনীতির সূচক বেড়ে যায়।
ঈদকে ঘিরে বাংলাদেশে তৈরি হয় বিশাল কর্মযজ্ঞ। যার কারণে সামগ্রিক অর্থনৈতিক চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এটি মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসব হলেও প্রতিটি সম্প্রদায়ের মানুষই এই উৎসবে শামিল হয়। প্রত্যেকের মধ্যেই নতুন পোষাক কেনার ধুম পড়ে যায়। বর্তমান সরকারের সময়ে দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে ঈদের কেনাকাটা প্রতিবছর বেড়েই চলেছে। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা প্রিয়জনদের কাছে প্রচুর পরিমান টাকা পাঠানোর কারণে রেমিটেন্সেরর প্রবাহ বৃদ্ধি পায়, সামগ্রিক গ্রামীন অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়ে উঠে।
রমজানে ইফতার পার্টির রমরমা আয়োজন চলে। রোজা মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন পালন করলেও ইফতারে কোনও ভেদাভেদ নেই, সকল ধর্মের মানুষ শরিক হন। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক পার্টি, এমনকি বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনদের নিয়ে ইফতার পার্টি আয়োজন করে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইফতার রাজনীতি শুরু হয়। ইফতার পার্টিকে কেন্দ্র করে পুরো রমজান মাসেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল থাকে। রমজান ও ঈদকে সামনে রেখে রেমিট্যান্সের বড় অংশই বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা এই সময়ে বোনাস পান, সেটিও বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল সংখ্যক গ্রামবাসী নাড়ীর টানে গ্রামে ছুটে যান, তাদের আগমনে গ্রামের হাটবাজার মুখরিত হয়ে উঠে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন রক্ত সঞ্চারিত হয়ে উঠে। মানুষের জীবন যাত্রার মান যতই উন্নত হচ্ছে ততই উৎসব কেন্দ্রিক অর্থনীতির আকার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। প্রত্যেকে যার যার ধর্ম পালন করবে, কেউ বাধা দিতে পারবে না।’বঙ্গবন্ধু কখনও ধর্ম দিয়ে মানুষকে বিভক্ত করেন নি, তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখছেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’আজ সারা দেশে সে কথারই প্রতিফলন দেখতে পাই। ঈদ কিংবা পুজা, বড়দিন কিংবা বৌদ্ধ পুর্নিমা প্রতিটি সময় স্ব-স্ব ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় আচার পালন করে আর উৎসবে শামিল হয় প্রতিটি ধর্মেই মানুষ। উৎসবে থাকে না কোন ধর্মীয় ভেদাভেদ, পরিনত হয় সম্প্রীতির উৎসবে।
দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে ঈদের আনন্দে পৌঁছে যাক। ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিকে পরাজিত করে সম্প্রীতির বাংলাদেশ বিজয়ী হোক। সকলকে ঈদ মোবারক।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই