বাংলা নববর্ষের ভাবনা
১৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২০
এলো বাংলা নববর্ষ!
না, ভুল বললাম।
নববর্ষ তো একটাই, তার সাথে আবার বাংলা লাগাই কেন?
আর আছে, খ্রিষ্টীয় ‘নিউ ইয়ার’, জানুয়ারীর এক তারিখে, আবার ঠিক এক তারিখও না, ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টায় ঘন্টা ঢং ঢং বাজার সাথে সাথেই ‘নিউ ইয়ার’ শুরু, শ্যম্পেনের বন্যা বয়ে যেতে থাকল!
ইরানে অগ্নিউপাসকরা পালন করত ‘নওরোজ’ নতুন দিন।
এদিকে আবার চীনাদের নববর্ষ বেশ মজার! এক এক বছরের এক এক নাম। প্রতি বারো বছর পরপর একই নিয়মে চলে, মাসের তারিখ বদল হয় কেবল! চীনা নববর্ষ চান্দ্র হিসেবে গননা করা হয়, নতুন চাঁদ শুরু হয় ২১ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যে কোনো দিন। যেমন-
২০২৩ জানুয়ারী ২২: খরগোশবর্ষ
২০২৪ ফেব্রুয়ারি ১০: ড্রাগনবর্ষ
২০২৫ জানুয়ারী ২৯: সাপবর্ষ
২০২৬ ফেব্রুয়ারি ১৭: ঘোড়াবর্ষ
২০২৭ ফেব্রুয়ারি ৬: ছাগলবর্ষ
২০২৮ জানুয়ারী ২৬: বানরবর্ষ
২০২৯ ফেব্রুয়ারী ১৩: মোরগবর্ষ
২০৩০ ফেব্রুয়ারী ৩: কুকুরবর্ষ
২০৩১ জানুয়ারী ২৩: শুকরবর্ষ
২০৩২ ফেব্রুয়ারী ১১: ইঁদুরবর্ষ
২০৩৩ জানুয়ারী ৩১: ষাঁড়বর্ষ
২০৩৪ ফেব্রুয়ারী ১৯: বাঘবর্ষ
ইরানে অগ্নিউপাসকদের ‘নওরোজ’ বা নতুন দিন; সেই সংস্কৃতি, মুসলমানরা ইরান দখল করলে, মুসলমানরাও ওদের দেখে এই অনুষ্ঠান পালন করা আরম্ভ করে। এটা ক্রমে ক্রমে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে মধ্য এশিয়াতে চলে যায়, সমরখন্দ, বোখারা, ফরগানায় মহাসমারোহে পালিত হতো এই নওরোজ উৎসব।
মোগল রাজবংশ ভারতে আসন গাড়লে ভারতেও নওরোজ পালন আরম্ভ হয়। সেই ইরানী নওরোজ অনুষ্ঠানকে বদলে দেন বাদশাহ আকবর। বাংলাদেশের ফসলের সাথে মিলিয়ে বানিয়ে দিলেন ফসলী সন, বাংলা নববর্ষ।
এ সময় কৃষকরা তাদের প্রথম ফসল নিয়ে বাদশাহকে নজরানা দিতে আসত, যেহেতু বাদশাহের হিসেবের দিন, তাই আগে-পিছে ভারতীয় বেনিয়ারাও সালতামামী হিসাব নিকাশের একটা শেষ টানত। যারা সারাবছর বাকিতে কেনাবেচা করত, এই দিনে হিসাব মিলাতে আসত, বাকি টাকা পরিশোধ করত, পাওনা আদায় করার চেষ্টা করত যতোটা সম্ভব। আর এভাবেই বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল, ‘হালখাতা’। যারা হিসাব মিলাতে আসত, বাকি-বকেয়ার হিসাব মিলাতে আসত, তাদের মিষ্টিমুখ করাতেন বেনিয়ারা, ‘খদ্দের লক্ষ্মী’! ‘দেবতার সেবা’ তো করতেই হবে।
মুসলমান ব্যবসায়ীরা তো কট্টর মুসলমান, তাই হিন্দুয়ানী প্রথা তারা মানবেন কেন? তাই মুসলমানদের জীবনে কোন বাকি-বকেয়া নেই, খদ্দেরও নেই।
কেবল আজ নগদ, আজ নগদ।
তাই ওরা কেন হিন্দু আচার পালন করবেন? কেনই বা দুই-পাঁচ হাজার টাকা খরচ করবেন?
মুসলমানদের আনন্দ কোথায়?
কোন আনন্দ অনুষ্ঠান আছে কি মুসলমানদের? কোন উপলক্ষে আনন্দ করা যায়?
মুসলমানদের ঈদ তিনটা ঈদ। রোজারিদ (রোজার ঈদ, ঈদণ্ডউল ফিতর), গোস্তেরিদ (ক্বোরবানীর ঈদ, ঈদউল আজহা) আর রুটিরিদ ((রুটির ঈদ, ঈদই মিলাদুন নবী)।
মুসলমানদের ঈদে একসাথে নামাজ পড়া ছাড়া আর কি হয় বছরের এই দুই দিন? কিচ্ছু না।
আগেরকালে, আমরা যখন ছোট ছিলাম নামাজের পর অভিভাবকদের, অভিভাবকদের বন্ধুদেরও লাইন বেঁধে সালাম করতাম আমরা পায়ে হাত দিয়ে!
আজকাল সালাম করা? তা-ও আবার পায়ে হাত দিয়ে? মাথা খারাপ!
সে সময়ে অভিভাবকদের দাওয়াত করা হতো সাড়ম্বরে, আর ছেলেছোকড়ারা! ওরা তো এমনিতেই আসবে খেতে, বলা লাগবে কেন? ওরা কি আলাদা কেউ? পাড়ার সব ছেলেমেয়েরাই তো আমাদের ছেলেমেয়ে! ধুমসে খাওয়া হতো প্রতিযোগিতা করে, কে কতোগুলো আমৃতি খেতে পারে। বাজি? অভিভাবকদেরও তাল দিতেন। খুব মজা হতো।
আজ সকালে এ বাড়ি, দুপুরে ও বাড়ি। বিকালের নাস্তা আর এক বাড়ি, রাতে আর এক জনের বাড়ি। নিজের বাড়িতে খাওয়া তো ভুলেই যেত ছেলেমেয়েরা। কেউ কেউ বলত- না, আজ রাতে মায়ের সাথে খাবো। অন্যরা বলত- ধুর, নিজের বাড়িতে কেন খাবো? পরবের সময় নিজের বাড়িতে খাওয়া কি পোষায়? কথায় আছে না, ঘর কা মুরগী ডাল বরাবর!
চললো সপ্তাহখানেক ধরে। এই উপলক্ষে খুব হইহই হতো, সবাই মিলে মজা হতো!
আজকাল আমরা প্রবল রকমের স্বার্থপর হয়ে গিয়েছি। দাওয়াত করে খাওয়ায়ই না কেউ কাউকে। ভাই-বোনকে না, মেয়ে-জামাইকে না, বিয়াই-বেয়াইনকেও না, আত্মীয়-স্বজন না, বন্ধু-বান্ধবও না। দাওয়াত খাওয়ানোর রেওয়াজ আজকাল নেই! স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছে।
আগে মিলাদ হতো, পাড়ায় পাড়ায় পাশের বাড়ির ছেলে পাসের আনন্দে, ছেলে-মেয়ে-নাতি-নাতিনের বিয়ের আনন্দে, মেয়ের বাচ্চা হুওয়ার আনন্দে, বাবা-মার মৃত্যুবার্ষিকীর দুঃখে মিলাদ হতো। এটা ঠিক ধর্মীয় আচার না, মিলাদের ছুতোয় কিছু মানুষ এক সাথে হয়ে গল্প-গুজব করত, পরস্পরের খোঁজ-খবর নিতো, সুবিধা-অসুবিধা শেয়ার করত, ছেলেমেয়ের খোঁজখবর হতো, হয়তো বিয়ের সম্বন্ধও হতো। কিন্তু হাজার বছরের এই ঐতিহ্য এখন বেদাত হয়ে গেছে। না হাদিসে নেই, কোরানে নেই, মিলাদ পড়া যাবে না!
বিশ্বের সব দেশে নববর্ষে আনন্দ করে মানুষজন। ইসলাম বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ১লা মহররম নববর্ষ, বছরের শুরু। মুসলমানরা নতুন বছর পালন করেন না। ১০ মহররম আশুরা পালন করেন। আশুরায় তাজিয়া মিছিল হয়, যেটা চরম বেদনার ঘটনা, আনন্দের না। আবার অনেকে বলেন, আশুরায় তাজিয়া মিছিল বিদাত! অথচ ঈদে-মিলাদুন-নবী উপলক্ষে বিশাল মিছিল বিদাত না!
আমরা সমস্ত জাতি এখন বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। আমাদের জীবনে আর কোন আনন্দের অনুষ্ঠান নেই! কেউ কারও খোঁজ নেই না। আমাদের রাষ্ট্রিয় অনুষ্ঠানগুলো কোনো না কোনো বিশেষ দলের অনুষ্ঠান হয়ে গিয়েছে, সকলের অনুষ্ঠান হয়নি। অনুষ্ঠান করতে হলে বিশেষ দলের নেতা-কর্মী হতে হবে, না হলে প্রবেশ নিষেধ!
পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে কিছু মানুষ যদি একটু নির্মল আনন্দ পায়, ক্ষতি কি! তাতেই না কি বিপদ! ঐ অনুষ্ঠানে না কি মূর্তিপূজা হয়! আজব ব্যাপার!! মঙ্গল শোভাযাত্রা কি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান!
ধরেন, ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী-ই এটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলে কি হতো? এই শোভাযাত্রায় যে ছবি বা মূর্তি বা পুতুল ব্যবহার করা হয়, তা সকল সময়, সব বছরে সুনির্দিষ্ট (একইরকম) থাকত! তা কি থাকে? না তো! এইসব চিত্র বা পুতুল বা মূর্তিগুলোকে কি ফুল-পাতা দিয়ে অর্ঘ অর্পণ/ পূজা করে কেউ, কেউ কি মাথা নত করে/ সিজদা করে সম্মান দেখায়? না তো! পৌত্তলিকদের কোন দেবতা বা পুতুল বা মূর্তির চেহারা বা চিহ্নের সাথে এই শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা মূর্তি, পুতুল বা ছবির কোন মিল আছে? না তো! তখন কোন ঘন্টা বাজে? শাঁখ বাজে? উলু দেওয়া হয়? ধুপ-ধুনা জ্বালানো হয়? আগুন জ্বালানো হয়? না তো!
তা হলে এটা পৌত্তলিক কাজ হলো কি করে?
মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পৌত্তলিকদের ধর্মীয় আচারের সাথে মেলানোর চেষ্টা করা নিতান্তই ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মূর্খতা; নয় কি?
এই যে কিছু মানুষ নিজের স্বার্থে মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পৌত্তলিক আখ্যা দিচ্ছেন তারাই বলেন, মানুষ কি করবে আনন্দ করার জন্য? তাদের আনন্দ করার পথ বলে দিন। সারাদিন কি নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, জিকির করবে? রাতে তাজাজ্জুদ পড়বে? কিশোর-যুবকদের এই উচ্ছলতা বাঁধ দিয়ে রাখলে এক সময় সেই স্রোত সেই বাঁধ ভেঙে চারদিক প্লাবিত করে ভেঙ্গে-চুরে তছনছ করে।
বর্ণিত আছে, কিশোরী আয়েশা (রা.)কে নিয়ে চাঁদের রাতে নবী করিম (সা.) নির্জন প্রান্তরে লোক চক্ষুর অগোচরে লুকোচুরি খেলেছেন। ইজমা-কিয়াস করে তো মাইক, ফোন, এসি, টিভি, মটর গাড়ি, প্লেন, ট্রেন, উড়োজাহাজ, হেলিকপ্টার জায়েজ করে নেওয়া হয়েছে। ইজমা-কিয়াসের আসর বসিয়ে আপনারা চিন্তা করে বের করুন, কোন কোন আচারঅনুষ্ঠান কিশোর-কিশোরীরা, যুবক-যুবতীরা করতে পারবে, কোনটা পারবে না।
হিন্দী সিনেমার দাপটে তো আজকাল আমাদের বেডরুমেও হিন্দী নাচ-গান ঢুকে গিয়েছে, আলেম-উলামারা সেই অনাচার বন্ধ করতে পারেনি। আজকাল বিয়ের অনুষ্ঠানসহ কতো হিন্দী অনাচার আমাদের যুবক-যুবতীরা পালন করে, সেটা নিয়েও আমদের সমাজপতিরা কিচ্ছু ট্যাঁফুঁ করেন না।
দেশের সুস্থ বিনোদন আজ পথভ্রষ্ট! নির্বাসনে! হায় আমাদের ঐতিহ্যের বাংলা নববর্ষ!
সারাবাংলা/এসবিডিই
ঈদুল ফিতর ২০২৪ বিশেষ সংখ্যা নিবন্ধ বাংলা নববর্ষের ভাবনা বৈশাখী আয়োজন ১৪৩১ সিদ্দিক মাহমুদুর রহমান