শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’: ফিরে দেখা
১৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৬:৫১
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। তার লেখনী সমাজের নানাবিধ প্রেক্ষাপট, মানুষের আবেগ-অনুভূতি এবং চরিত্রগুলির গভীর মানবিক দিককে প্রকাশ করে। তার রচিত উপন্যাস ‘দেবদাস’ কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের একটি অমর সৃষ্টি নয়, বরং এটি এই উপমহাদেশের সাহিত্যেও একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই প্রবন্ধে আমি দেবদাস উপন্যাসটির সাহিত্যিক গুরুত্ব, চরিত্র এবং এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী উপন্যাস ‘দেবদাস’ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। ১৯১৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হওয়া এই উপন্যাসটি প্রেম, বেদনা, আত্মত্যাগ ও সমাজের কঠোরতাকে কেন্দ্রে রেখে রচিত। এটি কেবল প্রেমের গল্প নয়; বরং মানবমনের গভীর অন্তর্দ্বন্দ্ব, সামাজিক অনুশাসনের প্রতি বিদ্রুপ এবং ভালোবাসার অন্তর্নিহিত শক্তি ও দুর্বলতার এক অপূর্ব চিত্রায়ণ।
‘দেবদাস’ উপন্যাসের মূল কাহিনী এক তরুণ দেবদাস এবং তার শৈশবের সঙ্গী পার্বতীর (পারো) প্রেমকাহিনীকে কেন্দ্র করে। দেবদাস ও পারো ছোটবেলায় একসঙ্গে বেড়ে উঠলেও তাদের পারিবারিক পরিবেশ এবং সমাজের শ্রেণীভেদের কারণে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায় না। পারোর অন্যত্র বিয়ে হয়, এবং দেবদাস ক্রমে মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষে, অসুস্থ ও ভগ্ন হৃদয়ে, দেবদাস পারোর বাড়ির কাছে এসে মৃত্যুবরণ করে।
এই উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলোর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেবদাস চরিত্রটি একজন আবেগপ্রবণ যুবকের প্রতীক, যিনি নিজের দুর্বলতার কারণে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। তার প্রেম, যন্ত্রণা এবং আত্মধ্বংস মানব জীবনের জটিলতাকে তুলে ধরে। অন্যদিকে পার্বতী প্রেমে যেমন অটল, তেমনি নিজের জীবনের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা। পারো চরিত্র নারীর আত্মসম্মান, সাহস এবং ত্যাগের প্রতীক। একইসাথে এই উপন্যাসে চন্দ্রমুখী চরিত্রটিও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। চন্দ্রমুখী এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসার মানুষ। যে স্বার্থহীন ভাবে দেবদাসকে ভালোবাসে। তার চরিত্র মানবতার মূর্ত প্রতীক এবং দেবদাসের প্রতি তার ভালোবাসা নিঃস্বার্থতার এক অনন্য উদাহরণ।
উপন্যাসের প্রধান বিষয়গুলির একটি হলো সমাজের শ্রেণিবিভেদ এবং এর কঠোর নিয়ম। দেবদাস ও পার্বতীর প্রেম কেবল তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতির কারণে ব্যর্থ হয়নি; তৎকালীন সমাজের কঠোর অনুশাসন ও পারিবারিক অহংকার এই সম্পর্ককে ধ্বংস করেছে। এটি শরৎচন্দ্রের সমাজবিরোধী মনোভাব এবং তৎকালীন সামাজিক কাঠামোর প্রতি তীক্ষ্ণ সমালোচনা প্রকাশ করে।
একইসাথে দেবদাসের জীবনের করুণ পরিণতি আত্মধ্বংসের এক চরম উদাহরণ। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ ও জীবনের প্রতি হতাশা তাকে মদ্যপানে আসক্ত করে এবং অবশেষে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এটি মানুষের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা এবং আবেগের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতার ফলাফল। দেবদাসের মৃত্যু শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত ব্যর্থতার প্রতীক নয়; বরং এটি সমাজের অমানবিক নিয়ম এবং সম্পর্কের জটিলতার প্রতি একটি প্রতিবাদ।
সবমিলিয়ে বলা যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ প্রেম, বেদনা এবং আত্মত্যাগের এক অনন্য উপাখ্যান। এটি কেবলমাত্র এক প্রেমের কাহিনী নয়, বরং সমাজের কঠোর নিয়ম এবং শ্রেণীভেদের প্রতি একটি তীব্র প্রতিবাদ। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত সরল এবং প্রাঞ্জল ভাষায় উপন্যাসটি লিখেছেন, যা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে।
‘দেবদাস’-এর বিশেষত্ব তার চরিত্রগুলির মানবীয় দুর্বলতা এবং আবেগের গভীরতায় নিহিত। উপন্যাসটি ভারতীয় সমাজের তৎকালীন পটভূমির একটি প্রতিফলন। এটি শ্রেণীভেদ, পারিবারিক মানসিকতা এবং সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে একটি নীরব প্রতিবাদ। পার্বতী এবং দেবদাসের ভালোবাসা সমাজের বাঁধার কাছে পরাজিত হয়। সমাজের এই নিষ্ঠুর দিকটি শরৎচন্দ্র অত্যন্ত নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন।
এই উপন্যাসের এর ভাষা অত্যন্ত সরল, অথচ গভীরভাবে আবেগঘন। শরৎচন্দ্রের লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং অনুভূতিকে অত্যন্ত জীবন্ত ও স্বাভাবিকভাবে তুলে ধরা। উপন্যাসটির প্রতিটি চরিত্র, ঘটনা এবং সংলাপ পাঠকের হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে।
‘দেবদাস’ উপন্যাসটি কেবলমাত্র সাহিত্যিক মহলে নয়, চলচ্চিত্র জগতেও বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। এটি বিভিন্ন ভাষায় বহুবার চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। প্রতিটি প্রজন্মেই ‘দেবদাস’ নতুনভাবে পাঠকদের এবং দর্শকদের হৃদয় ছুঁয়েছে। এর জনপ্রিয়তার মূল কারণ উপন্যাসটির চিরন্তন আবেগময়তা এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীর বিশ্লেষণ।
পরিশেষে বলা যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ একটি কালজয়ী সাহিত্যকর্ম, যা সমাজ, প্রেম এবং মানবীয় আবেগের গভীরতাকে তুলে ধরে। দেবদাসের করুণ পরিণতি পাঠককে কেবলমাত্র বেদনার্ত করে না, বরং সমাজের কঠোর বাস্তবতার প্রতি নতুন করে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এই উপন্যাসটি কেবলমাত্র একটি প্রেমের গল্প নয়, এটি বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য রত্ন। ১৬ জানুয়ারি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রায়ন দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: কলামিস্ট ও লেখক
সারাবাংলা/এএসজি