Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কারাগারে খুন: সন্দেহের তীর ‘যুবলীগ নেতার’ বলয়ের দিকে


৩১ মে ২০১৯ ২০:৩৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম কারাগারে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরীর মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড’ বলে তার পরিবারসহ বিভিন্ন মহল থেকে যে বক্তব্য আসছে, তা তদন্তের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সেক্ষেত্রে নগর যুবলীগের আলোচিত এক নেতার বলয়ের ভেতরকার গ্রুপ-উপগ্রুপের দ্বন্দ্বকে মাথায় রেখেই তদন্ত এগিয়ে নিতে চায় ডিবি।

অমিত মুহুরীর বাবা অরুণ মুহুরীর দাবি দুই বছর আগে তার নেশাগ্রস্ত ছেলেকে ‘ভালো করার জন্য’ যুবলীগের ওই নেতার গ্রুপের সিদ্ধান্তেই পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এরইমধ্যে অন্তত তিনটি মামলায় অমিতের জামিন হয়েছে। আরও দু’টি মামলায় জামিন পেয়ে মাসখানেকের মধ্যে অমিতের মুক্ত হওয়ার কথা ছিল। গ্রুপের ভেতরকার একটি অংশ কিংবা গ্রুপের বিরোধী প্রভাবশালী কেউ অমিতের মুক্ত হয়ে যুবলীগ নেতার সঙ্গে সক্রিয় হওয়া নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন। এ কারণেই বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে তাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি অরুণ মুহুরীর।

বিজ্ঞাপন

অরুণ মুহুরীর এই সন্দেহের কথা পৌঁছেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছেও।

জানতে চাইলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-উত্তর) মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা মাত্র তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছি। আসামিকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো এবং রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেছি। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তথ্য পাওয়া যাবে। তবে আপাতত আমরা হত্যাকাণ্ড নিয়ে যেসব বক্তব্য আসছে, সবগুলোকেই মাথায় রাখছি।’

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক আজিজ আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অমিত মুহুরীকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে কি-না, সেটি আমরা নিবিড়ভাবে তদন্ত করে দেখব। পরিকল্পিত হত্যার বিষয়ে যেসব বক্তব্য আমরা পাচ্ছি সেগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। এর বাইরে আরও তথ্য পাওয়া গেছে সেগুলোও তদন্তের আওতায় আসবে।’

বিজ্ঞাপন

গত বুধবার (২৯ মে) রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অমিতকে গুরুতর জখম অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাত ১টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন দায়িত্বরত চিকিৎসক। অমিত মুহুরী নিহতের ঘটনায় বৃহস্পতিবার (৩০মে) সকালে নগরীর কোতোয়ালী থানায় মামলা দায়ের করেছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নাশির আহমেদ। মামলায় অমিত যে কক্ষে আহত হয়েছেন অর্থাৎ ৩২ নম্বর সেলের ৬ নম্বর কক্ষের আরেক কয়েদি রিপন নাথকে (২৭) আসামি করা হয়েছে।

মামলায় কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে রিপনের সঙ্গে কথা কাটাকাটি ও মারামারির জেরে অমিতকে মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে খুন করা হয়েছে। তবে পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা কারাগারে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছেন ঘুমন্ত অবস্থায় অমিতকে মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরীর নন্দনকাননে বন্ধুকে নৃশংসভাবে খুনের পর ড্রামে ভরে এসিড দিয়ে লাশ গলিয়ে দিঘীতে ফেলার মামলায় ২০১৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর ‘ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী’ অমিত মুহুরীকে (৩২) গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। অমিত যুবলীগের কেন্দ্রীয় উপ-অর্থ বিষয়ক সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের বলয়ে সক্রিয় ছিল। চট্টগ্রাম নগরীতে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রক বাবর, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে।

কারাগারে অমিত মুহুরী খুনের পর চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আলোচনায় আসছে ‘বাবর গ্রুপের’ কর্মকাণ্ডের কথা।

অমিত

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা সারাবাংলাকে জানান, অমিত চরমভাবে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পুলিশের ওপর হামলা, অস্ত্রের মহড়া, সর্বশেষ বন্ধুকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় অমিতকে নিয়ে সমালোচনায় পড়েছিলেন বাবর। কারাগারে দেখা করতে গেলে অমিত তাদের জানিয়েছিল বাবরের ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা জাফর তাকে ধরিয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে অমিতের মধ্যে প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাবও তারা লক্ষ করেছিলেন।

অমিতের বাবা অরুণ মুহুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল এটা সত্যি। আমার ছেলেকে ভালো করার জন্যই বাবর সাহেবের লোকজন ধরিয়ে দিয়েছিলেন, এটা আমি লোকমুখে শুনেছি। কিন্তু অমিত কারাগারে যাওয়ার পর বাবর সাহেব কিংবা তার লোকজন তাকে একবারও কারাগারে দেখতে যায়নি। জেলে দিয়েছে ভালো কথা, তাকে সংশোধনেরও তো সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল। অথচ তারা তাকে এভয়েড করছিল।’

‘আমি যখন অমিতের সঙ্গে শেষবার দেখা করতে যাই, তখন সে বলেছিল- বাবা, আমাকে মারার জন্য কোটি টাকা বাজেট হয়েছে, আমাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাও। আমি জামিন করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। তিনটি মামলায় জামিন হয়েছিল। আর দুইটি মামলায় জামিন পেলে মাসখানেকের মধ্যে বেরিয়ে যেত। তার আগেই তাকে খুন করা হয়েছে।’ বলেন অরুণ মুহুরী

অমিতকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে বাবরের ঘনিষ্ঠ যুবলীগ নেতা গাজী জাফর উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এগুলো মুখরোচক কথা। অমিতের যখন সক্রিয় হয়, তখন আমি দেশে ছিলাম না। দেশে ফেরার পর তার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ হত, কিন্তু সেটা চা খাওয়া বা আড্ডা দেওয়া পর্যন্ত। আমি সোশ্যাল ক্রাইম কখনো অ্যালাউ করি না। কিন্তু আমি তাকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি- এই বক্তব্যের কোনো সত্যতা নেই।’

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য হেলাল আকবর চৌধুরীর বাবরের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

কারা হত্যা করাতে পারে, এ বিষয়েও কিছু সন্দেহের কথা জানিয়েছেন অরুণ মুহুরী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘অমিত যদি বের হত, আবারও নিশ্চয় বাবর সাহেবের সঙ্গে সক্রিয় হত। বাবরের হাত চাঙ্গা হোক অমিতের মাধ্যমে, এটা হয়ত তাদের গ্রুপেরই কেউ চায়নি। কারণ, বাবরের গ্রুপের মধ্যেই অমিতের বিরোধী কেউ কেউ ছিল বলে আমি শুনেছি। আবার বাবরের বিরোধী কেউও অমিতকে খুন করাতে পারে। কারণ বাবরের গ্রুপ শক্তিশালী থাকুক, এটাও তো তার বিরোধীরা নিশ্চয় চায় না।’

‘রিপন নাথ (আসামি) তো কোনো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী নয়। তাকে কেন অমিতের সেলে নেওয়া হল, কারাগারের ভেতরে ইট কীভাবে পাওয়া গেল, এসব বিষয় তদন্ত করলে সবকিছু পরিস্কার হবে। আমার ধারণা, এই হত্যা পরিকল্পনার পেছনে কারাগারের কর্মকর্তারাও আছেন’ বলেন অরুণ মুহুরী।

তিনি আরও জানান, বৃহস্পতিবার (৩০ মে) নগরীর কোতোয়ালী থানায় কারা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে পুলিশ তাকে মামলা না নিয়ে ফিরিয়ে দেয়। একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দুটি মামলা করা যায় না বলে তাকে পুলিশ জানিয়েছে।

জানতে চাইলে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনি (অরুণ মুহুরী) জেল সুপার ও জেলারের বিরুদ্ধে মামলা করতে এসেছিলেন। আমি তাকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে বলেছি। একটি ঘটনায় দুইবার মামলা তো নেওয়া যায় না।’

অরুণ মুহুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছেলে মরেছে আমার, মামলা করব আমি। অথচ জেল কর্তৃপক্ষ শুধু একজনকে আসামি করে মামলা করল। আমার অভিযোগ তো জেল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেও আছে। নিশ্চয় কারাগারের কর্মকর্তারা জড়িত, না হলে ওসি মামলা নিলেন না কেন?’

যুবলীগ নেতা গাজী জাফর উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছেলে মরল আমার, হারাইলাম আমি, বদনামও যদি আমার হয়, তাহলে আর কি করতে পারি? আমিও চাই সঠিক তদন্ত হোক। তাহলে এসব অনর্থক বিরক্তিকর কথাবার্তা আর শুনতে হবে না।’

সারাবাংলা/আরডি/একে

আরও পড়ুন

কারাগারে হত্যাকাণ্ড : আসামিকে পাঁচদিনের রিমান্ডে চেয়েছে ডিবি
অমিত খুন: কারা কর্তৃপক্ষ বলছে মারামারি, প্রশাসনের ভিন্ন বক্তব্য
চট্টগ্রামের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী কারাগারে খুন

 

অমিত খুন কারাগারে খুন চট্টগ্রাম জেলখানা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর