Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছাত্রলীগের ‘যন্তরমন্তর ঘর’ ঢাবি হল গেস্টরুম, চলছে নবীন নির্যাতন


২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ১২:৫৭

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা গেস্টরুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তবে নির্যাতনের শিকার হলেও থাকার জায়গা হারানোর ভয়ে এবং আরও নির্যাতিত হবার ভয়ে ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে নারাজ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে যারা কথা বলেছেন তারা জানাচ্ছেন, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন অধিকাংশ হলের এই গেস্টরুমকে রীতিমতো ‘যন্তরমন্তর ঘরে’ পরিণত করেছে। হলে প্রচলিত ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে- ‘গেস্টরুম করানো’। এখানে যা কিছু ঘটার এই গেস্টরুমেই ঘটে।

ছাত্রলীগ অবশ্য সে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, ‘বর্তমানে কোনো গেস্টরুম করানো হয় না। আর হল কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা বিষয়টি অবগত নয়।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে গেস্টরুম করানোর বিষয়টি এখন সবারই জানা। কেউ কেউ গেস্টরুমকে ‘যন্তরমন্তর ঘর’ বলেও ডাকছে।

সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমায় রাজার গবেষক গবুচন্দ্র যে যন্তরমন্তর ঘরে মগজ ধোলাইয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন, তার সঙ্গেই তুলনা করা চলে এই ব্যবস্থাকে, বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী।

‘এর সাহায্যে, রাজভক্তি প্রকাশে নারাজ যে; তাকে করে তোলা একনিষ্ঠ রাজভক্ত, মোটে না শক্ত…’ হিরকরাজার দেশে থেকেই উদ্ধৃত করেন ওই শিক্ষার্থী।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডজন ডজন শিক্ষার্থী সারাবাংলার সাথে কথা বলেছেন। তাদেরও মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর গেস্টরুম ছাত্রলীগ যা করছে তার তুলনা এই মগজ ধোলাইয়ের সঙ্গেই চলে।

এই প্রক্রিয়ার প্রধান শিকার প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন জেলা, শহর, বন্দর, গ্রাম ও প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা শিক্ষার্থীরা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথমভাগেই এসে এই বড় ধাক্কার মুখে পড়ে খাবি খাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, এই কক্ষে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের নিয়ম কানুন শেখানোর নামে মূলত দলের কমান্ড মেনে চলার শিক্ষা দেওয়া হয়। সেই শেখানো নিয়মের বিন্দুমাত্র ব্যত্যয় ঘটলে গেস্টরুমে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়। এমন অভিযোগের কিছু প্রমাণ সারাবাংলা.নেট’র হাতেও রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুয়ায়ী প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ডিন অফিস থেকে একটি হল বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দ দেওয়া ওই নির্দিষ্ট হলে শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্বও প্রশাসনের।

কিন্তু পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে ছাত্রীদের পাঁচটি হল ও ছাত্রদের দু’ একটি হল ছাড়া সবগুলো হলেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের আশ্রয়ে হলে উঠছে।

এখানে ছাত্রলীগের হাতে তৈরি নিয়ম ও প্রক্রিয়াটিই চলে।

তারা নবীন শিক্ষার্থীদের হলের গণরুমে রাখেন। চারজন শিক্ষার্থীর জন্য তৈরি রুমে ২০-২৫ জন রেখে তাকে গণরুম তকমা দেওয়া হচ্ছে।

মূলত ছাত্রলীগের মিছিল মিটিংয়ে থাকবে, তাদের কথা মেনে চলবে এসবের শর্তেই নতুন শিক্ষার্থীরা এসব রুমে থাকার অধিকার পায়। তবে সে জন্য চাই মগজধোলাই, যাতে কখনোই অবাধ্য না হয়ে যায়। তারই অংশ হিসেবে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে ডেকে পাঠানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত ভাষায় ‘গেস্টরুম করানো’ হয়।

কেমন সেই গেস্টরুম করানোর ব্যবস্থা? জানা গেছে, নবীন শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে অন্তত তিনদিন (কোথাও পাঁচ থেকে ছয়দিন) ম্যানার শেখানোর জন্য হলের গেস্টরুমে নির্দিষ্ট সময়ে ডাকা হয়। এখানে নেতারা তাদের অন্তত দুই ঘন্টা বিভিন্ন ম্যানার শেখান।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এর মাধ্যমে ছাত্রলীগ নেতারা ‘সংগঠন ও নেতার প্রতি আনুগত্য শেখান।’

বিজ্ঞাপন

তবে কেবল শেখানোই নয়, নিয়মিত ফলোআপ করা হয়। কেউ কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটালে গেস্টরুমে আবার ডাক পড়ে। ভুলভ্রান্তির জন্য তাদের জবাবদিহী করতে হয়।

এ সময় আর স্রেফ শেখানো বা কড়া কথা নয়- চলে অকথ্য ভাষায় গালিগালি। কখনও লাঠি, হকস্টিক দিয়ে ভয়-ভীতি দেখানো। ক্ষেত্র বিশেষে জুতোপেটাও চলে। কিল-ঘুষি এগুলো অনেকটাই মামুলি, জানান ভুক্তভোগী একাধিক শিক্ষার্থী।

সেখানেই শেষ নয়। মাঝে মাঝে নেতারা শীতের রাতে নবীন শিক্ষার্থীদর রুমে তালা লাগিয়ে তাদের বাইরে থাকতে বাধ্য করেন। এসময় শিক্ষার্থীদের কিছুক্ষণ বাইরে ঘোরাঘুরি করতে পরামর্শ  দেওয়া হয়।

কখনো কখনো নির্যাতন ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাবির জসীম উদ্দীন হলে এক শিক্ষার্থীর অস্ত্রপোচারের জায়গা ও পেটে লাথি মারার মতো ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় হল প্রশাসন দুই শিক্ষার্থীকে হল থেকে আজীবন বহিষ্কার করে। (যদিও তারা এখনও হলে থাকছেন।) একই বছরের ২৩ মে দিবাগত রাতে একটি কর্মসূচিতে না যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের প্রথম বর্ষের ৩৫জন ছাত্রকে গেস্টরুমে মারধর করেন হল শাখা ছাত্রলীগ নেতারা। শীতের রাতে দাঁড়িয়ে গেস্টরুম করানোর ধকল সহ্য করতে না পেরে ২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র হাফিজ মোল্লা মারা যান। এই ঘটনা তখন ব্যাপক আলোড়িত হয়। কিন্তু তারপরেও থামেনি গেস্টরুম নির্যাতন। সর্বশেষ গত ১৯ জানুয়ারি একটি হলের গেস্টরুমে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রকে মারধরের প্রমাণ সারাবাংলার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

গেস্টরুম নির্যাতনের বিষয়ে প্রথম বর্ষের একজন ভুক্তভোগী ছাত্র বলেন, ‘সালাম না দিলে, বড় ভাইদের পাশে দ্রুত হেঁটে গেলে গেস্টরুমে ডাক পড়ে।’
‘গেস্টরুমে গেলে আমার হার্টবিট বেড়ে যায়। এটা নিয়ে আমি খুবই হতাশ,’ বলেন ওই শিক্ষার্থী।

ভুক্তভোগী আরেক ছাত্র বলেন, ‘আমি যে স্বপ্ন নিয়ে ঢাবিতে এসেছিলাম গেস্টরুমের এই বাজে অবস্থা দেখে নিরাশ হয়ে পড়েছি। এটাকে এক ধরনর দাসপ্রথার মতোই গণ্য করা যায়। নিজের বাক-স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই এখানে। ক্ষেত্রবিশেষে সিনিয়র ভাইকে ভুলে সালাম না দেয়ার কারনে থাপ্পড়-চড় খেতে হচ্ছে। এমনকি জুতা দিয়ে পেটাতেও ওরা দ্বিধাবোধ করে না। আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছি এসব দেখে।’

তবে যারা গেস্টরুম করানোর নামে এই নির্যাতন চালাচ্ছেন তারা এটাকে নির্যাতন মনে করেন না। এটাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচার উল্লেখ করে ছাত্রলীগের এক নেতা সারাবাংলাকে বলেন, গ্রাম থেকে অনেকে আসে। সিনিয়রদের সঙ্গে তারা কিভাবে ব্যবহার করবে জানে না। গেস্টরুমে এসব নিয়ম কানুন শেখানো হয়। তবে গেস্টরুম কালচারে কিছুটা সংস্কার আনা দরকার বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

অপেক্ষাকৃত সিনিয়রদের দিয়েই জুনিয়রদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন।

গেস্টরুম করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে এমন আরেক ছাত্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসল ঘটনা হলো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ভুল করলে বড় ভাইদের কাছে আমাদের জবাবদিহী করতে হয়। এজন্য তাদের কিছুটা চাপে রাখা হয়।’

গেস্টরুমে নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস সারাবাংলাকে বলেন, এখন গেস্টরুম করানো হয় না বললেই চলে।

কয়েকটি হলে সপ্তাহে ছয়দিন গেস্টরুম হয় অবহিত করলে তিনি বলেন, আমাদের জানা নেই, আমাদের দিক থেকে কোনও নির্দেশনাও নেই।
কেউ ব্যক্তিগতভাবে করলে তো তার দায় সংগঠন নেবে না, বলেন ঢাবি ছাত্রলীগের এই শীর্ষ নেতা।

হলে ছাত্রদের গেস্টরুম নির্যাতনের বিষয়ে হল প্রভোস্ট স্টান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. সাবিতা রিজওয়ানা রহমান সারাবাংলাকে বলেন, হলগুলোতে প্রত্যেক মাসে ছাত্রদের নিয়ে সভা হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। তবে এখন যেহেতু শুনলাম, এটা নিয়ে আমরা আলাপ করব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রব্বানী মন্তব্য করতে না চেয়ে সারাবাংলাকে বলেন, হলের বিষয়গুলো হল প্রভোস্টদের এখতিয়ার, তারাই এ বিষয়ে কথা বলবেন।

ছবি: ঢাবির একটি হল গেস্টরুমে জবাবদিহিতা চলছে নবীনদের… শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার স্বার্থে ছবিটি অস্পষ্ট করে দেওয়া হলো। 

সারাবাংলা/কেকে/এমএম

গেস্টরুম ছাত্র ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢা‌বি নির্যাতন শিক্ষার্থী হল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর