ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ১ এপ্রিল বইমেলা বন্ধ করার সুপারিশ করে। একইসঙ্গে সরকার ঘোষিত ১৮ দফা বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়ার অনুরোধও জানিয়েছে কমিটি। তবে নির্দেশনা দেওয়ার প্রায় ৪ দিন পার হলেও সুপারিশের বাস্তবায়ন হয়নি।
এ ছাড়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ও তাদের অভিভাবকদের একত্রিত অবস্থায় দেখা গেছে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হওয়ার বিষয়টিও। শুধুমাত্র তাই না, পরীক্ষার হলেও মানা হয় নি স্বাস্থ্যবিধি। একই সঙ্গে শুক্রবার মধ্যদুপুরে বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ সমাবেশ ছিল স্বাস্থ্যবিধি ভঙ্গের আরেক নজির। বিশেষজ্ঞরা এমন পরিস্থিতিতে বলছেন, এভাবে স্বাস্থ্যবিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। আর এমন অবস্থায় দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (২ এপ্রিল) এমবিবিএস কোর্সের (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তি পরীক্ষা সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ভর্তি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২২ হাজার ৮৭৪ জন। রাজধানী ঢাকাসহ ১৯টি কেন্দ্রে ৫৫টি ভেন্যুতে এ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, কেন্দ্রের ভেতরে পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষার্থীদের ও কেন্দ্রর বাইরে অপেক্ষমাণ অভিভাবকদের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখতে বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা থাকবে।
কিন্তু বিভিন্ন কেন্দ্রে সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে দেখা যায়, পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই। শুধুমাত্র তাই না কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।
বিভিন্ন কেন্দ্রে পরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রের ভেতরেও স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয়নি। তিন ফুট দুরত্ব বজায় রেখে পরীক্ষা গ্রহণের কথা থাকলেও দেখা গেছে ছোট বেঞ্চে তিনজন, চারজন করেও পরীক্ষার্থী বসানো হয়েছে। একই সঙ্গে কোনো কেন্দ্রে চার জন বা দেখা গেছে ছয় থেকে সাতজন শিক্ষার্থীও বসানো হয়েছে।
রাজধানীর তেজগাঁও কলেজ, মিরপুর বাংলা কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন কেন্দ্রের ভেতরে বসার ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ জানিয়েছে শিক্ষার্থীরাও। আর এমন অবস্থায় শুধুমাত্র পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে নয় বরং ভেতরেও যে অব্যবস্থাপনা তার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগের দায় আছে বলে জানান বিভিন্ন কেন্দ্রে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসকরা। শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয় প্রায় একই রকম অব্যবস্থাপনার সংবাদ পাওয়া গেছে দেশের অন্যান্য পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতেও।
তবে এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগ অস্বীকার করে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সারাদেশে এমবিবিএস কোর্সের প্রথম বর্ষের (২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ) ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে দাবি করেছেন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন।
পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৩ ফুট দূরত্ব নিশ্চিত করা হয়নি, পরীক্ষাকেন্দ্রের বাইরে অনেক জনসমাগম ছিল— দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার এই চিত্র কতটুকু ঝুঁকিপূর্ণ, তা জানতে চাওয়া হয় অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, ‘সব পরীক্ষাকেন্দ্রেই তিন ফিট দূরত্বে বসেছে সবাই। যদি কোনো ব্যাতিক্রম ঘটে থাকে, সে বিষয়ে জানালে আমরা সেই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলব। পরীক্ষাকেন্দ্রে সবকিছু দেখার দায়িত্ব আমাদের। সেটি আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই করেছি। সবার মুখে মাস্ক ও সবার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজারের সরবরাহ আমরা নিশ্চিত করেছি। স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এই ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে যে জনসমাগম, সেটি তো আসলে আমাদের দায়িত্ব না।’
একইদিন দুপুরে সরেজমিনে বায়তুল মোকাররমের সামনে হেফাজতে ইসলামের বিক্ষোভ সমাবেশে ছিল না স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বালাই। এ সময় পুলিশ প্রশাসনের সদস্যদেরও দেখা যায় নিষ্ক্রিয়।
প্রায় একই অবস্থা দেখা গেছে দিনের শেষ ভাগে বইমেলাতেও। এদিন তরুণ-তরুণীদের পাশাপাশি শিশু-কিশোর ও বৃদ্ধা-বৃদ্ধদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। এরমধ্যেও মাস্ক ছাড়া ঘুরতে দেখা গেছে, পুলিশ থেকে শুরু করে বইমেলার বিক্রেতাদেরও।
দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এভাবে যদি সবাই ঘোরাঘুরি করে তবে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হবে কীভাবে? করোনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখালে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হবে? আমরা সবাই কী এখন উৎসব পালন করছি করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য? ১৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেগুলোই তো মানা হচ্ছে না। বর্তমান অবস্থায় দেখা যাচ্ছে সরকারের দেওয়া ১৮ দফা নির্দেশনাকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হচ্ছে। এমন অবস্থায় তো আসলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ হবে না, সম্ভবও না।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে, তখন কী হবে? হাসপাতালে বেড বাড়ানো তো সমাধান না। সমাধান করতে হবে রোগের উৎস ও উৎপত্তি স্থলকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করার মাধ্যমে। সেগুলো না করে যদি এভাবে জনসমাগম করা হয় ও স্বাস্থ্যবিধি অবজ্ঞা করা হয় তবে আমাদের সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।’
দেশে ভ্যাকসিন বিতরণ সংক্রান্ত কোর কমিটির সদস্য ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না। মাস্ক পরার পরেও কিন্তু জনসমাগম এড়ানোটা প্রয়োজন। কারণ আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে অনেকেই একটানা মাস্ক পরে থাকে না। আর এমন অবস্থায় কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে ছড়াবে বেশি মাত্রায়।’
আরও পড়ুন
সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে মানা হয়নি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ
২৩৫ দিন পরে সংক্রমণের হার ২৩.২৮ শতাংশ
‘সরকারের উদাসীনতায় করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে’
করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে ৩১ জেলা