দীর্ঘ প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে স্বদেশে ফিরেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তাকে দেওয়া বিশাল গণসংবর্ধনার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে দেন আগামীর বার্তা। তারেক রহমানের এই বক্তব্যে উঠে এলো বিশ্বখ্যাত নাগরিক অধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের সেই কালজয়ী উক্তি ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’। তার প্রসঙ্গ টেনে তারেক রহমানও বলেন ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’।
তারেক রহমানের বক্তব্যের পর জনমনে কৌতূহল জেগেছে— কে এই মার্টিন লুথার কিং?
‘বর্ণবৈষম্যের অন্ধকারে আশার আলোকবর্তিকা এবং সাম্যের অদম্য কণ্ঠস্বর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। বিংশ শতাব্দীর এই মহানায়ক কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতাই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের অনুপ্রেরণা। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, ঘৃণা বা সহিংসতা নয়, বরং ভালোবাসা আর সাহসের মাধ্যমেও পাহাড়সম বৈষম্য জয় করা সম্ভব।
১৯২৯ সালে জর্জিয়ার আটলান্টায় জন্মগ্রহণ করেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। শৈশব থেকেই তিনি তার বাবার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তার বাবা ছিলেন একজন চার্চ যাজক, যিনি দৈনন্দিন জীবনে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াতেন। ১৯৩৬ সালে কিং-এর বাবা ভোটাধিকার বৈষম্যের প্রতিবাদে কয়েকশ আফ্রো-আমেরিকানকে সঙ্গে নিয়ে আটলান্টা সিটি হল অভিমুখে একটি পদযাত্রার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
হাইস্কুলে পড়ার সময় ডিবেট টিমের সদস্য হিসেবে কিং তার অসাধারণ বাগ্মিতার জন্য পরিচিতি লাভ করেন। তার গম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং শব্দভাণ্ডার সবাইকে মুগ্ধ করত। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি হাইস্কুলের পাঠ চুকিয়ে আটলান্টার মোরহাউস কলেজে ভর্তি হন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ব্ল্যাক ইউনিভার্সিটি, যেখানে তার বাবা এবং মাতামহও পড়াশোনা করেছিলেন।
১৯৪৮ সালে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করার পর, কিং তার বাবার দেখানো পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি পেনসিলভেনিয়ার একটি সেমিনারি থেকে ধর্মতত্ত্বে পাঠ গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বোস্টনে থাকাকালীন তিনি ‘টুয়েলভথ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ’-এ সহকারী মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেন। সেখানেই তার সঙ্গে পরিচয় ও বিয়ে হয় নিউ ইংল্যান্ড কনজারভেটরি অব মিউজিকের শিক্ষার্থী করেট্টা স্কটের সঙ্গে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৫৫ সালে কিং ডেক্সর্টা অ্যাভিনিউয়ের ব্যাপটিস্ট চার্চের যাজক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি সরাসরি কৃষ্ণাঙ্গদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে শুরু হয় ঐতিহাসিক বাস ধর্মঘট।
ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৯৫৫ সালের ১ ডিসেম্বর, বাসের আসনকে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই বাসের সামনের দিকে বসার অধিকার ছিল না কালোদের। শ্বেতাঙ্গ উঠলে সংরক্ষিত আসন ছেড়ে দিতে হবে এই নিয়ম মানলেন না কৃষ্ণাঙ্গ নারী রোজা পার্কস। তিনি প্রতিবাদ করলেন। এটা ছিল সরকারি আইনের লঙ্ঘন। রোজাকে থানায় নিয়ে ১০ ডলার জরিমানা করা হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে লুথার কিং ও অন্য কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিস্টান ধর্মযাজকেরা বাস সার্ভিস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। টানা ৩৮১ দিন নানা প্রতিকূলতার পরেও কৃষ্ণাঙ্গদের সরকারি বাস বয়কট চলতে থাকলে সুপ্রিম কোর্ট বাসের এই বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষণা করেন। অবশেষে বাসে তাদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ আন্দোলনে জয়ের পর কিংয়ের নাম ছড়িয়ে পরে গোটা আমেরিকায়। তার এই অহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে এগিয়ে আসেন বহু কৃষ্ণাঙ্গ নেতা। গোটা আমেরিকা জুড়েই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জেগে উঠতে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় কিং ১৯৬৩ সালে সরকারের নেওয়া বৈষম্যমূলক আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ঘোষণা করেন। কিং তার অনুসারীদের নিয়ে দুই মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যান। এর মূল লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের শ্বেতাঙ্গদের সমান অর্থনৈতিক সুবিধা দিতে হবে, কালোদের সর্বত্র প্রবেশাধিকার থাকতে হবে এবং শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে।
এমনি এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশে অ্যালাবামার পুলিশ সমবেত জনতার ওপর দমনমূলক নিপীড়ন চালায়। মার্টিন লুথার কিংসহ আরও অনেকেই সে সময় গ্রেফতার হন। এই ঘটনা ব্যাপক সাড়া জাগায় বিশ্বব্যাপী। এরপর তিনি স্থির করেন দেশ জুড়ে শুরু করবেন ফ্রিডম মার্চ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শুরু হয় ওয়াশিংটন অভিমুখে পদযাত্রা।
১৯৬৩ সালে ২৭ আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালে সমাবেত হয় প্রায় আড়াই লাখের বেশি মানুষ। তাদের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন কিং, ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ (আই হ্যাভ আ ড্রিম)। ভাষণে তিনি বলেন, কীভাবে বর্ণবৈষম্য গোটা জাতিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তিনি তুলে ধরেন ভবিষ্যতের আমেরিকা নিয়ে তার আশাবাদ। যেখানে সব আমেরিকান হবে সমান। এটাই হবে সত্যিকারের স্বপ্নের আমেরিকা। তার এই বিখ্যাত ভাষণের প্রভাবেই ১৯৬৪ সালে আমেরিকায় নাগরিক অধিকার আইন ও ১৯৬৫ সালে ভোটাধিকার আইন প্রণয়ন করা হয়।
সেই বছর টাইমস পত্রিকা কিংকে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার দেয়। ১৯৬৪ সালে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদানের জন্য মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল টেনেসির মেমফিস শহরে তার হোটেল কক্ষের ব্যালকনিতে দাঁড়ানো অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে নিহত হন।
১৯৮৩ সালে মার্কিন কংগ্রেস প্রতি বছর জানুয়ারির তৃতীয় সোমবারকে ‘মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে।
তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার ছাড়াও মরণোত্তর ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম’ এবং ‘কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল’ লাভ করেন। কিং-এর আদর্শ আজ বিশ্বজুড়ে নিপীড়িত মানুষের অনুপ্রেরণা।
১৯৫৭ সালে এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘মুক্তির চেয়ে বড় আর কিছুই নেই। এর জন্য জেলে যাওয়া, চাকরি হারানো এমনকি মৃত্যুবরণ করাও সার্থক।’