ঢাকা: গোপন ডিটেনশন সেলে বন্দিদের ওপর নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। তবে কিছু পরিস্থিতিতে প্রহরী বা অফিসারের আচরণে অস্বাভাবিক মানবতার ঝলক দেখা যায়। বন্দিরা এসব মুহূর্ত আজও মনে রাখেন। এমনই এক ভূক্তভোগী তার দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন— ডিটেনশন সেলে নির্যাতন এতটাই নৃশংস ছিল যে দুই নারী অফিসার সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম তার ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে এসব নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন।

ফেসবুক পোস্ট।
তার লেখা ফেসবুক পোস্টটি সরাসরি তুলে ধরা হলো—
“আমরা রেগুলারলি ভিক্টিমদের থেকে গোপন ডিটেনশন সেলে ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনা শুনি। এসব নির্যাতন প্রায়ই এতটা নিষ্ঠুর হয় যে তাদের শরীর ও মনে স্থায়ী ক্ষত রেখে যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ভিক্টিম এমন ঘটনার বর্ণনাও দেন যেখানে আচমকা এক ধরনের অস্বাভাবিক মানবতার ঝলক দেখা যায় – কখনো কোনো প্রহরীর থেকে, কখনো কোনো অফিসারের থেকে। ভুক্তভোগীরা এসব মুহূর্ত ভোলেন না। তাদের মাধ্যমে, আমরা এখন এমন অনেক স্মৃতির রিপোজিটরি হয়ে গিয়েছি যা আমাদের যথেষ্ট ভাবায়।
একজন তরুণ ছাত্র, যিনি টর্চারের চোটে আজ স্থায়ীভাবে অসুস্থ, আমাকে বলেছিলেন যে টর্চারিং অফিসার মারতে মারতে দুটো ইন্সট্রুমেন্ট ভেঙে ফেলে পরবর্তীতে তৃতীয়টি দিয়ে টর্চার চালিয়ে যান। নির্যাতন এতটাই নৃশংস ছিল যে সেই ঘরে থাকা দুই নারী অফিসার কান্নায় ভেঙে পড়েন। যদিও তিনি অর্ধচেতন ছিলেন, সেই দুজনের কান্নার দৃশ্যটি তার আজও মনে গেঁথে আছে।
আরেকজন বন্দি আমাকে বলেছিলেন এক রাতে তিনি তাহাজ্জুদ পড়ছিলেন। তার সুরেলা তিলাওয়াত শুনে এক প্রহরী খুব কাঁদতে থাকে। অতঃপর ক্ষমা চাইতে চাইতে বলে, “আমি জানি আপনারা নির্দোষ, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না।” পরিবর্তীতে যখন বন্দিকে কিছু সময়ের জন্য সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে আবার ফেরত আনা হয়, সেই প্রহরী আবেগাপ্লুত হয়ে যায়, “আপনি বেঁচে আছেন! আমি ভেবেছি আপনাকে মেরে ফেলতে নিয়ে গিয়েছে। তাই আমি বাড়ি ফিরে নামাজে দাঁড়িয়ে আপনার জন্য অনেক কান্না করেছি।”
একজন অফিসারকে বলা হয়েছিল তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকার একটিভ রাজনৈতিক কর্মীদের তালিকা জমা দিতে। পরে যখন তিনি জানতে পারেন সেই তালিকার প্রতিটি মানুষকে এলিমিনেট করা হয়, তিনি প্রচণ্ড মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে পড়েন, ইনফ্যাক্ট সুইসাইডাল হয়ে যান।
কিছু গোপন বন্দিশালায় বন্দিদের জন্য বরাদ্দকৃত খাবারের পরিমাণ ছিল প্রহরীদের আনুমানিক অর্ধেক। কিন্তু এসব বন্দিশালার কিছু ভিক্টিম আমাদের বলে, “নিষ্ঠুর প্রহরী বহুত ছিল কিন্তু ভাল প্রহরী ডিউটিতে থাকলে আমরা একটু বেশি খাবার পেতাম।” প্রথমে ব্যাপারটা আমার কাছে কনফিউজিং ছিল কারণ রেশন তো নির্দিষ্ট, এই অতিরিক্ত খাবার কোথা থেকে আসে? কিছু সাক্ষ্য নেওয়ার পর বুঝতে পারি সম্ভবত অল্প সংখ্যক প্রহরী তাদের নিজেদের খাবার বন্দিদের দিয়ে দিত। হয়তো এসব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জেশচারের মাধ্যমে কিছু মানুষ অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে, এক রকম নীরব প্রায়শ্চিত্ত করেছে।
এই ‘প্রায়শ্চিত্ত’ বিষয়টি নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। একজন জুনিয়র অফিসারকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, “আপনি কি হত্যা করেছেন?” তিনি ইতস্তত করে বলেন, “দুইজনকে করতে হয়েছে, আর চারজনকে হতে দেখেছি।” তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “এই কাজের বিনিময়ে যে টাকা পেয়েছিলেন, কী করেছেন?’ তিনি বলেন, ‘গ্রামের মসজিদে দান করে দিয়েছি।’’
তার উত্তরটা আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। ক্রিমিনাল এলিমেন্টটা তো সহজেই বোধগম্য, কিন্তু আমি চিন্তা করেছি তার মনের ভেতরের সেই দ্বন্দ্বটি নিয়ে। যেই দ্বন্দ্বের তাড়নায় ২৭ বছরের ছেলেটা চেষ্টা করেছে হ্যাপহ্যাজার্ডভাবে হলেও নিজের অন্তরকে শোধরানোর। একজন সিনিয়র অফিসার আমার কাছে স্মৃতিচারণ করেছিলেন যে এমন এক অপরাধীকে তিনি বলেছিলেন: “তুমি এখন যেসব নামাজ-কালাম করছ, তা আল্লাহর হক। কিন্তু যে ক্রাইম এর আগে করেছ, সেটা মানুষের হক। আল্লাহ মানুষের হক নিজে ক্ষমা করে না, তোমার বান্দার থেকে ক্ষমা চাইতে হবে। নামাজ is not enough.’’
প্রায়শ্চিত্ত করতে চাইলে আপনাকে এখন কথা বলতে হবে। কমিশনে আমরা সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনি – সে যেই হোক – প্রত্যেককে কনফিডেনশিয়ালিটি অফার করি। যদি আপনার আত্মা কোনো ক্ষত বহন করে, তবে এটাই সময় সেই ক্ষত নিরাময়ের। আমাদের কাছে আসুন, কথা বলুন। বুঝতেই পারছেন অনেকেই এরই মধ্যে বলেছেন।
এই সুযোগ চিরকাল থাকবে না। এখন মুখ না খুললে আপনার soul-এর wound তো unhealed রয়ে যাবেই, আপনি নিজেও নিজের কাছে coward প্রমাণিত হবেন। আগস্ট ৫ তারিখ কবে পার হয়ে গেছে, তবুও আপনি সত্য বলার সাহস করতে পারেননি? নিশ্চিত থাকুন ন্যায়বিচার একদিন হবেই — হয় আমাদের মাধ্যমে, বা পরকালে আল্লাহর দরবারে। It is unavoidable.