হৃদয়ের স্বপ্নপূরণ, মায়ের মনে স্বাধীনতার সুখ
৮ নভেম্বর ২০১৮ ২৩:১৭
||জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট||
ঢাকা: সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হৃদয় সরকারদের ঘরে এখন আনন্দের বন্যা। ১৮ বছরের এ তরুণের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে তার স্বপ্নপূরণ হচ্ছে। আর হৃদয়ের মা- তারও হয়েছে স্বপ্নপূরণ। এই মা-তো সেই ২১ সেপ্টেম্বর থেকেই অনেকের হৃদয়হরণ করে নিয়েছেন। এবার তার মনে অর্জনের আনন্দ।
সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলো খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। লম্বা-শুকনো একটি ছেলেকে কোলে করে ছুটছেন এক নারী। ছেলেটিকে পরীক্ষা হলে ঢুকিয়ে দিতেই যাচ্ছিলেন তিনি। সে দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী হয়। তারপরে যা হবার তাই। মূলধারার গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যমে সে ছবি ভাইরাল হয়। আর হৃদয় নয়, তার এই বীর মাই তখন হয়ে ওঠেন সবার কাছে আগ্রহের।
সাধারণের সে আগ্রহ হৃদয় কেড়ে নেয় তার পরীক্ষা পাসের মধ্য দিয়ে। নিজের মেধায় সে পাস করে যায় বটে। তবে তীব্র প্রতিযোগিতার এই পরীক্ষার মেধা তালিকার তার অবস্থান ছিলো এমনই যে তার ভর্তি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কলা অনুষদের অধীন খ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় পাস করা ৪ হাজার ৭৪৭ জনের মধ্যে হৃদয়ের মেধাক্রম ছিল ৩৭৪০। একটাই সুযোগ তখন প্রতিবন্ধী কোটা। কিন্তু বাধ সাধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবি হৃদয় শারিরীক প্রতিবন্ধী। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী, শ্রবণ, বাক ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর বাইরে অন্যকোনো ধরনের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য কোটা নেই। আর তাই তাকে ভর্তি করা যাবে না। অন্য প্রতিবন্ধীদের তুলনায় মেধাক্রমে এগিয়ে থেকেও ভর্তির সুযোগ পাওয়া যাবে না।
সারাবাংলা.নেটে প্রকাশিত হয় সে খবর। নিয়মের গ্যাঁড়াকলে থমকে যাবে মা-ছেলের লড়াই!
এরপর শুরু হয় আরও আলোচনা-সমালোচনা। সারাবাংলা.নেট সেসব বিষয়েও দিতে থাকে একের পর এক খবর। সেসব খবরে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কথা থেকে জানা যায়, রাষ্ট্র ‘সেরিব্রাল পালসি’কে প্রতিবন্ধিতা হিসেবেই ঘোষণা দিয়েছে রাষ্ট্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় সে বিধি মানতে বাধ্য। তা না করলে সেটা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
হৃদয়কে ভর্তি না করার অধিকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কে দিয়েছে?- এমন প্রশ্নও তোলেন কেউ কেউ। মন্তব্য আসে, যে আইন বা ব্যবস্থা সঠিকভাবে একজন প্রতিবন্ধীকে চিহ্নিত করতে পারে না, সে আইন-ব্যবস্থা নিজেই প্রতিবন্ধী।
বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও গড়ে ওঠে জনমত। আইনজীবীরা হৃদয়ের পক্ষে মামলা লড়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে তা আর করতে হয়নি। দেরিতে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পেরে হৃদয়কে প্রতিবন্ধী কোটায় ভর্তির সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। বৃহষ্পতিবার ( ৮ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন’স কমিটির বৈঠকে হৃদয় সরকারকে ভর্তি নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় হৃদয়কে ভর্তি করাবে এ ঘোষণার পর সারাবাংলা.নেট’র কথা হয় হৃদয় সরকার এবং তার মা সীমা সরকারের সঙ্গে। গণমাধ্যমে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হৃদয় বলেন, এতোদিন আমার মতো যারা আছে, তাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে। আমাকে দিয়ে সে বৈষম্য দূর হওয়া শুরু হলো, এখন অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাবে- এ জন্য যতোটা নিজের জন্য ভালো লাগছে, তার চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে এই কথাটা ভেবে যে একটি সঙ্কটের অবসান ঘটবে।
আর তার মা জানালেন, ছেলের এই ভর্তির সুযোগ তার মধ্যে এমন আনন্দানুভূতি তৈরি করেছে, তার মনে হচ্ছে অনেক সংগ্রামের পর তিনি যেনো স্বাধীনতা অর্জন করলেন।
হৃদয় এখন আছেন পরিবারের সঙ্গে তার নিজের শহর নেত্রকোণায়। সেখানেই টেলিফোনে কথা হচ্ছিলো মা ও ছেলের সঙ্গে। হৃদয় জানালেন, আগামী রোববার ঢাকায় আসবেন, এবং ভর্তি হবেন তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে।
হৃদয় সারাবাংলাকে বলেন, আমি মনে করি, দেরিতে হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটা সময়োপযোগী, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমি তাদের এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই, তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
হৃদয় বলেন, আমার মতো যারা পুরো জীবনে অনেক স্ট্রাগল করে পড়াশোনা করেছে, যাদের স্বপ্ন উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া- তাদের জন্য আজকের এ সিদ্ধান্ত স্বপ্নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিলো আমাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবো- এটাই সবচেয়ে বড় সংবাদ আমাদের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সর্ম্পক বিভাগে পড়তে চাই জানিয়ে হৃদয় বলেন, ‘এ বিভাগে পড়ে ‘ফরেন ক্যাডারে’যেতে চাই, আমার দেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চাই, বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, আমাদের। দেশের জন্য কিছু করবো-এটা আমার স্বপ্ন।’
হৃদয়ের মা সীমা সরকারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিলো এই প্রতিবেদকের তিনি শুধুই কাঁদছিলেন।
‘অনেক সংগ্রাম করেছেন ছেলেকে নিয়ে-কেমন লাগছে’- প্রশ্ন করলে ফোনের অপর প্রান্ত খানিকক্ষণ নীরব থাকার পর শোনা যায় ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। এরপর হাউমাউ করে কাঁদলেন আরও কিছুটা সময়। ধীরে ধীরে নিজেকে সামলিয়ে সীমা সরকার বললেন, ‘অনেক সংগ্রামের পর স্বাধীন হলে কেমন লাগে বলেনতো আপা….আমার তেমনই লাগছে, আমার স্বাধীনতার মতো সুখ লাগছে।’
‘খবরটা শোনার পর হাতে কোনও কাজ উঠতেছে না, আমার যে কেমন লাগছে-এটা আমি নিজেই বুঝতেছি না,’ যোগ করেন সীমা সরকার।
তিনি বলেন, ‘এইদিন যে আমার জীবনে আসবে- এ আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। শেষবার যখন ডিন স্যার না করলেন, বলে দিলেন হৃদয়কে ভর্তি নেবেন না, তখন সেখান থেকে বের হয়ে হৃদয় বলছিলো, মা-শেষবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয়টাকে দেখে নেই, আরতো আসতে পারবো না। সেসময় আমার আর ওর বাবার চোখের জল…..।’
কথা শেষ হয় না সীমা সরকারেরর, আবার ফোনে তার কান্নার শব্দ শোনা যায়।
নেত্রকোণা শহরের কুরপাড় এলাকার সমীরণ সরকার এবং সীমা সরকারের দুই ছেলে। হৃদয় সরকার ও অন্তর সরকার। মা সীমা সরকারের ভাষায়- ‘হৃদয় বলেন আর অন্তর বলেন, বিষয়তো একটাই। তাই দুই নামে এক জিনিসকেই আমরা ধারণ করেছি।’
বড় ছেলে হৃদয় সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলেন আর অন্তর পড়ছে নেত্রকোণায় সপ্তম শ্রেণিতে।
সীমা সরকার জানালেন, হৃদয়ের জন্মের দুই মাস পরেই ছেলের আচরণে তার সন্দেহ হতে শুরু করে। ছেলে নড়ে না, কাঁদে না ঠিকমতো। আর তারপর থেকেই যুদ্ধ শুরু হয় তার। প্রথমে নেত্রকোণাতে, ময়মনসিংহে, তারপর ঢাকার অনেক হাসপাতালে ছোটাছুটি।
‘প্রতিমাসে ঢাকায় যেতাম ছেলেকে নিয়ে। তিন বছর বয়সে বসা শিখলো, কোলে নিলে হাত দিয়ে পেছনের দিকে মাথা ধরতে হতো, নইলে মাথা হেলে পরে যেত। এভাবেই শুরু করলাম। তারপর সাড়ে তিনবছর বয়সে কলকাতায়। সেখানে দীর্ঘ আট ঘন্টা এমআরআই মেশিনের ভেতরে সাড়ে তিনবছরের ছেলেটাকে যখন রাখা হলো, সেই রুমে আমি আর আমার ছেলেটা আর কেউ নেই। সেই আট ঘন্টার স্মৃতি আমি কোনওদিন ভুলবো না। তারও আটঘন্টা পরে ছেলের জ্ঞান ফিরলো। আমরাতো ভেবেছিলাম- ছেলেটাকে আর বাঁচানোই যাবে না।
কলকাতাতেই জানতে পারি, ওর জন্মের সময়ে নানা জটিলতার কারনে ওকে যে অক্সিজেন এবং ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল তার নাকি মেয়াদ ছিল না। সেই অক্সিজেন এবং ইনজেকশনের কারণেই ছেলের এ অবস্থা হয়, বলেন সীমা সরকার।
তিনি বলেন, দুই মাস বয়স থেকে চিকিৎসা শুরু করলাম, দুই হাতের মুঠি এক করা ছিল-ব্যায়াম। সেটা করতে করতে মুঠিটা খুললেও বাম হাতের সমস্যা এখনও যায় নি, কেবল ডান হাতে লিখতে পারে। প্রতিদিন ব্যায়াম করিয়েছি, নেত্রকোনাতে ফিজিও থেরাপির একটা সেন্টার ছিল-সেখানে সপ্তাহে দুইদিন নিয়ম করে নিয়ে গেছি।
সীমা বলেন, ‘পাঁচ বছর বয়সে পড়ার জন্য প্রস্তুত করলাম। প্রথমে বাসায়, তারপর কেজি স্কুল। এরপর প্রাইমারি। আর এরপরতো মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে।
আমার আরেকটি ছেলেকে সময় দিতে পারিনি বড় ছেলের জন্য। কাজের মানুষ ছিল না, তাই অনেক কষ্ট হতো।
তবে স্বামী, প্রতিবেশী এবং হৃদয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতা ছাড়া ছেলেকে নিয়ে আমি এ লড়াই লড়তে পারতাম না, কৃতজ্ঞতা স্বীকার সীমা সরকারের।
তিনি বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় সিট পরে তিনতলায়। কলেজের স্যাররা বলেছিলেন, ওর জন্য নিচতলায় আলাদা ব্যবস্থা করে দেবেন। কিন্তু আমি না করেছি। বলেছি, একা একা পরীক্ষা দিলে ওর মনটা ছোট হবে, পরীক্ষা খারাপ হবে- বরং বন্ধুদের সঙ্গে একসঙ্গে পরীক্ষা দেবে।
স্যারদের বলেছি, ‘তারে নিয়া আমি তিনতলায় উঠতে পারি, আমার কোনও সমস্যা হয় না।’
সীমা সরকার বলেন, ‘হুইল চেয়ারে ছেলেকে আমি কমই দেই, কোলে নিয়ে সব জায়গায় যাই।’
ওর বাবা সকালে ওর সব কাজ করিয়ে দেয়, ছোট ছেলে অন্তর ভাইয়ের সব কাজে সহযোগিতা করে-এভাবে চলেছে।
‘আমার খুব স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবো ছেলেকে…। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও তাকে ডাকলো না, আমি ডিন স্যারের নম্বর সংগ্রহ করে স্যারকে ফোন দেই। তিনি বলেন, কেন আসবেন-আপনার ছেলেরতো ‘কোটা’ নাই, শারীরিক প্রতিবন্ধীরতো কোনও কোটা নেই। সে মুহূর্তে আমার পুরো জীবনের সংগ্রাাম যেন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
একথা বলে আবার চুপ হয়ে যান সীমা সরকার।
পুরো শিক্ষা জীবনে ছেলেকে কোলে করে সবজায়গায় নিয়ে গেছেন জানিয়ে সীমা সরকার বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষার দিনেও কয়েকটি ছেলে বলেছিল, আমাদের কাছে দেন-হুইল চেয়ারে করে নিয়ে যাই, আমরা বসিয়ে দেব। আমি বলেছি, না। আমি নিজে গিয়ে বসাইয়ে দিয়ে আসবো-করেছিও তাই, হুইল চেয়ারে আমি আমার ছেলেকে বসাইনি।
আমার ছেলের জন্য আপনারা গণমাধ্যম যা করেছেন, পুরো দেশ যা করেছে-সে কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে, আরেক দফা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ সীমা সরকারের।
সারাবাংলা/জেএ/এমএম