জলবায়ু পরিবর্তন: বড় সংকটে পানিখেকো ধান, ভাতখেকোদের কী হবে?
১০ জুন ২০১৯ ১৪:৩৯
গোটা বিশ্বে এখন যত শস্য উৎপাদন হয়, তার জন্য ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রয়োজন হয়। আর বিশ্বের অধিকাংশ দেশই এখন শস্য উৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত পানির অভাবে ভুগছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই আবহাওয়ায় নানাবিধ প্রকট দশা আমরা দেখছি। এ অবস্থায় পানির সংকটকেই সবচেয়ে বড় করে দেখা হচ্ছে। আর সে চ্যালেঞ্জ কী করে মোকাবিলা করা হবে, সেটাই এখন গুরুত্ব পাচ্ছে সবার কাছে।
আলোচনায় গবেষকদের মুখে যে শস্যটির কথা সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে, সেটি হলো ধান। এই ধান থেকে আসে চাল, চাল থেকে ভাত হয়। আর ভাত আজও বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের প্রধান খাদ্য। ভাত না হলে তাদের চলেই না। সেই ধান এক বড় পানিখেকো শস্য।
বিশ্বের সবগুলো মহাদেশের আবহাওয়াতেই কম-বেশি ধান উৎপাদিত হয়। আর সে কারণে এর ওপর নির্ভরতাও বেশি। ধান উৎপাদনে চাই পানি। গাছের গোড়ায় পানি জমা করে রাখতে হয় মাসের পর মাস। তাতেই ফলবে শস্যকণা। বলা হচ্ছে— পৃথিবীতে এতটা তৃষ্ণার্ত শস্য আর একটিও নেই।
পরিসংখ্যানও সে কথাই বলে—
এক কিলোগ্রাম ওজনের একটি বাঁধাকপি উৎপাদনে লাগে ২০০ লিটার পানি; এক কিলোগ্রাম আপেল উৎপাদনে লাগে ৭০০ লিটার পানি ও এক কিলোগ্রাম গম উৎপাদনে লাগে ১৩০০ লিটার পানি। সেখানে এক কিলোগ্রাম ধান উৎপাদনে লাগে ৩৪০০ লিটার পানি।
অবশ্য খাবার হিসেবে চিন্তা করলে ধানই যে সবচেয়ে বেশি পানি খাচ্ছে, তা নয়। কারণ এক কিলোগ্রাম পনির উৎপাদনে লাগে ৫০০০ লিটার পানি; আর এক কিলোগ্রাম গরুর মাংস উৎপাদনে চলে যায় ১৫০০০ লিটার পানি।
এদিকে জলবায়ূ পরিবর্তনের পরিক্রমায় বিশ্বেজুড়েই এখন খরা ও বন্যা— দুইই আজ চরম বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে। এ অবস্থায় ভাতের মতো প্রধান খাদ্যকে টিকিয়ে রেখে ভবিষ্যত খাদ্য নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত করা যাবে সেটাই হয়ে উঠেছে বড় চিন্তার বিষয়। বিশ্বের সবখানেই পানির যথার্থ ও কার্যকর ব্যবহার সে কারণেও আজ গুরুত্বপূর্ণ।
এই চ্যালেঞ্জের মাত্রাটি আজ আমরা যতটা ভাবতে পারছি, বাস্তবে হয়তো তার চেয়েও বেশি।
বিশ্বের যতটুকু পরিচ্ছন্ন পানি তার শতকরা ৭০ ভাগই ব্যয় হয় কৃষি পণ্যের তেষ্টা মেটাতে। গবেষকরা দেখেছেন, শস্যগুলোর এই তেষ্টা বেড়েই চলেছে।
বাড়বেই না কেন? জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতির সঙ্গেই এর গতি বাড়ে। বলা হচ্ছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যা এক হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের দেশে দেশে দারিদ্র বিমোচনও হচ্ছে ধীরে ধীরে। গরীবের আয় বাড়ছে। আর সে আয় যতই বাড়বে ততই তারা শ্বেতসার জাতীয় খাদ্যের পাশাপাশি প্রাণিজ আমিষের দিকে হাত বাড়াবে। তাতেও পানির ওপরই চাপ বাড়বে।
এখন কী করণীয়? পরিস্থিতি মোকাবিলায় মাঠ পর্যায়েই সমাধান খুঁজতে হবে। সমস্যার গুরুত্ব মেপে বিজ্ঞানীরা এখন কী করে অপেক্ষাকৃত কম পানি ব্যবহার করে বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদন করা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছেন।
আসুন, সারাবিশ্বে কোথায় কিভাবে পানির ব্যবহার হচ্ছে তার একটি খতিয়ান জেনে নেওয়া যাক—
দক্ষিণ এশিয়া
কৃষি: ৯১.২%, শিল্প: ৬.৯%, গৃহস্থলী: ২.০%
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা
কৃষি: ৮৫.৩%, শিল্প: ৯.০%, গৃহস্থলী: ৫.৭%
সাব-সাহারান আফ্রিকা
কৃষি: ৮০.৭%, শিল্প: ১৪.৭%, গৃহস্থলী: ৪.৬%
ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয়
কৃষি: ৭২.১%, শিল্প: ১৬.৯%, গৃহস্থলী: ১১.০%
পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল
কৃষি: ৭১.৮%, শিল্প: ১১.৭%, গৃহস্থলী: ১৬.৩%
ইউরোপ ও মধ্য এশিয়া
কৃষি: ৩৫.৭%, শিল্প: ৩০.৭%, গৃহস্থলী: ৩৩.৫%
তো যে কথা হচ্ছিল, গবেষকরা বিকল্প পথ খুঁজছেন। বিবিসি’র একটি প্রতিবেদনে এসব তথ্য দিয়ে বলা হয়েছে, গবেষকরা বের করার চেষ্টা করছেন কম পানির খরচে বেশি ধান উৎপাদনের পথ। খরা দশাতেও যেন ধান গাছ টিকে থাকতে পারে এবং ফল দেয়, সেটাই তাদের প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগে কিছুটা অগ্রগতি দেখিয়েছেন যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ডের গবেষক অধ্যাপক জুলি গ্রে। প্রতিকূলতায় টিকে থাকার জন্য গাছের নিজেরই কিছু শক্তি থাকে। নিজেরাই নিজেদের রন্ধ্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে কতটুকু কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করছে, কতটুটু পানি শরীর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তার হিসাব-নিকাশ রাখতে পারে। এদিকে উদ্ভিদ বিজ্ঞান যতটুকু এগিয়েছে, তাতে এখন গাছের এই সক্ষমতা আরও বাড়িয়ে তোলা সম্ভব।
গ্রে বলেন, ধানের গাছগুলোতে রন্ধ্র বাড়ানো-কমানো যায়। যে আবহাওয়ায় যতটা প্রয়োজন, ততটা নিশ্চিত করা সম্ভব। ফলে খরা কিংবা উচ্চ তাপমাত্রায় গাছগুলোর রন্ধ্র বাড়িয়ে তুললে তাতে গাছের জীবনচক্রজুড়ে পানি ধরে রাখা যায়।
তবে কেবল ধান গাছের সক্ষমতা বাড়িয়েই হবে না, ভাতকে প্রধান খাদ্য হিসেবে পেতে হলে কৃষকদের মাঠ পর্যায়ের নিতে হবে কিছু উদ্যোগ। সেখানে কিভাবে বেশি সময় পানি ধরে রাখা যায়, সেটি দেখতে হবে।
সারবাংলা/এমএম