‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৮:০০
ঢাকা: সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার আট বছর পূর্ণ হলো। মামলার তদন্ত কয়েক দফা হাত বদলেছে, কিন্তু তা শেষ হয়নি। সবশেষ ৭১ বার আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ পিছিয়েছে। অর্থাৎ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে আট বছরেও চার্জশিট দেওয়াই সম্ভব হলো না। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দৃশ্যমান যেটুকু চোখে পড়ে তা হচ্ছে— প্রতিবছর দিনটি এলে সাগর-রুনির সহকর্মীরা জাতীয় প্রেস ক্লাব বা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সামনে মানববন্ধনে দাঁড়ান। নিজেদের হতাশা, ক্ষোভ জানান।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি— নিশৃংস হত্যাকাণ্ডের আট বছরে তরুণ সাংবাদিকরা এতটাই বিরক্ত যে তারা এ নিয়ে আর কথাই বলতে চান না। আর সিনিয়ররাও আইন-বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় প্রচণ্ড হতাশ, রীতিমতো ক্ষোভ তাদের কণ্ঠে।
আট বছরের মাথায় এসে নতুন করে হতাশার কথা জানান বেশ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিক। সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত দেরির বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল সারাবাংলাকে বলেন, শুধুমাত্র সাংবাদিক দম্পত্তি নয়, একজন সাধারণ মানুষেরও দ্রুত বিচার পাওয়া অধিকার রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আট বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় আমরা আশাহত। তারপরও প্রত্যাশা করব, দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রশাসন এ হত্যার রহস্য উন্মোচন করবে। সম্প্রতি আমরা দেখেছি বেশ কয়েকটি পুরানো মামলা পিবিআই তদন্ত করে রহস্য উন্মোচন করেছে। সাগর-রুনির হত্যার রহস্যও একদিন উন্মোচিত হবে। এটি উন্মোচন করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। কেননা এ মামলাটি শেষ করতে না পারা রাষ্ট্রের জন্য বিব্রত অবস্থা তৈরি করছে।’
দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ শ্যামল দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে বহু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়ে গেল, অথচ আমাদের দু’জন সহকর্মীর মর্মান্তিক হত্যার বিচার আজও শুরুই হলো না। এ মামলার তদন্ত করে দোষীদের কেন শনাক্ত করা যাচ্ছে না, তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। আমরা চাইব, দু’জন সাংবাদিকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অন্তত এটির সুরাহা হোক।
এ হত্যাকাণ্ডটি সাংবাদিকতার জগতে একটি কালো তিলক হিসেবে থেকে যাবে জানিয়ে শ্যামল দত্ত বলেন, সাংবাদিক মেরে ফেললে আট বছরে তদন্ত শেষ হয় না— এমন ধারণা যখন তৈরি হবে, তখন বহু অপরাধী আরও উৎসাহী হবে। এ রকম উৎসাহী হওয়া মানে আমাদের জন্য ঝুঁকি বেশি। সুতরাং সরকার মুখে মুক্ত গণমাধ্যম বা স্বাধীন সংবাদপত্রের কথা বলে এ হত্যাকাণ্ডের সুরাহা না করলে সাংবাদিকতার জগতে এটি একটি কালো তিলক হয়ে থেকে যাবে।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা হলো সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার না হওয়া। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হওয়ার লক্ষণও নেই। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্তের নামে যে কালক্ষেপণ চলছে, তা আমাদের বিস্মিত করেছে। আমরা হতাশ হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে কোথাও একটা প্রচেষ্টা আছে যেন এই হত্যার বিচার না হয়।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সাগর-রুনি হত্যার পর সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করেছিল মাঠে। কিন্তু সাংবাদিকরা আন্দোলন করতে পারে, কর্মসূচি পালন করতে পারে, লিখতে পারে, মত তৈরি করতে পারে। এর বাইরে তো তাদের কিছু করার নেই। সাংবাদিক সমাজ বারবার রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়েছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্র এই জায়গায় যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেনি।
‘কোনো কারণে এই জায়গায় সবার এক ধরনের নিষ্ক্রিয়তা রয়েছে। আর এই নিষ্ক্রিয়তার কারণে আমরা এখন ভুগছি। এর আগেও সাংবাদিকরা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন। আমরা সেগুলোর বিচার চেয়েছি। কিন্তু সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পরে সাংবাদিকদের ওপর নতুন এক ধরনের নির্যাতনের পথ তৈরি হয়েছে। এ কারণে আমরা এখন সাংঘাতিকভাবে অনিরাপদ বোধ করছি,’— বলেন সোহেল হায়দার চৌধুরী।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, বার বার সময় চেয়ে সাগর-রুনি হত্যার বিচার কাজকে বিলম্বিত করা হচ্ছে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’। এর অর্থ, বিচার দেরি করার অর্থ হলো বিচার থেকে বঞ্চিত করা। হচ্ছে তো সেটাই।
সাগর-রুনি হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিক সমাজ এর থেকে পিছু হটবে না বলেও জানান রফিকুল ইসলাম আজাদ। বলেন, ৪০ বছর পর হলেও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, সাগর-রুনিসহ প্রতিটি সাংবাদিক হত্যার বিচারও একদিন হবে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু সাংবাদিকবান্ধব, আশা করি তিনি এ হত্যার বিচারের উদ্যোগ নেবেন।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, সাগর-রুনি হত্যার বিচারে আমরা দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করেছি। বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়েছি। ওই সময়ে প্রশাসনে যারা দায়িত্বে ছিলেন, তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু দেখা গেল, তাদের প্রতিটি আশ্বাসই ছিল মিথ্যা। এ মামলাটি নিয়ে এত ‘নাটক’ করার কোনো দরকার ছিল না— এমনটিই মত রিয়াজ চৌধুরীর।
সাংবাদিকদের পাশাপাশি ক্ষোভ জানিয়েছেন আইনজ্ঞরাও। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে সময় ক্ষেপণ নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, এত লম্বা সময়েও তদন্ত শেষ না হওয়া দুঃখনজক। কী কারণে তদন্ত শেষ হচ্ছে না— এমন প্রশ্ন আমারও জাগে। কাজের গতি দেখে মনে হয় না নিষ্ঠার সঙ্গে তদন্ত চলছে। এভাবে তদন্ত কাজে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করলে মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয় বলেও মনে করেন সাবেক এই আইনমন্ত্রী।
এদিকে, দীর্ঘ আট বছরেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন হাইকোর্ট। এ মামলার সন্দেহভাজন এক আসামির করা জামিন আবেদনের শুনানির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৪ নভেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।
আদালত বলেন, আদালত প্রত্যাশা করে র্যাব অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে এই মামলার তদন্ত শেষ করে হত্যার রহস্য উন্মোচন এবং প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত ও গ্রেফতার করে বিচার শুরু করতে সক্ষম হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করতে না পারলে র্যাবের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে বলেও মনে করেন আদালত।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরের দিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
সাগর রুনি তদন্ত প্রতিবেদন সাগর-রুনি হত্যা মামলা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড