বুলেট বুকে জোসনা খাতুনের ৪৭ বছর!
২৫ মার্চ ২০১৮ ২৩:১০
জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা: এই জানুয়ারিতে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ৮০ বছরের জোসনা খাতুন। গলা দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছিলো তার। কাছেই একটি হাসপাতালে নেওয়া হলো। সেখানকার চিকিৎসকরা যক্ষ্মা ভেবে জোসনা খাতুনকে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে পাঠালেন।
সেখানে জোসনা খাতুনের এক্সরে হলো। এক্সরে প্লেট বের হওয়ার পর তা হাতে ধরে চমকে ওঠেন চিকিৎসক।
জোসনা খাতুনের ফুসফুসের ভেতরে কিছু একটা লটকে রয়েছে। নিশ্চিত হতে না পেরে আবার এক্সরে করা হলো। পাঠানো হলো সিটিস্ক্যানেও। আর তার মধ্য দিয়ে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসকরা খুঁজে পেলেন ৪৭ বছরের পুরোনো এক ইতিহাসকে। যে ইতিহাস বাংলাদেশ নামের একটি দেশের সমান বয়সী। যে ইতিহাস বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন দেশের জন্মের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত। সে ইতিহাস একটি বুলেটের ইতিহাস।
হ্যাঁ জোসনা খাতুনের বুকের গহ্বরে যে বস্তুটি আজও লটকে রয়েছে সেটি একটি বুলেট।
চিকিৎসকরা বুলেটের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর যখন জোসনা খাতুনের কাছে জানতে চান, তিনি জানান, ১৯৭১ সালে তার বুকে গুলি লেগেছিল।
আর সেই গুলিই তিনি এতবছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন। কেউ জানতো না সে খবর। না পরিবারের কেউ, না জোসনা খাতুন নিজেও।
রাজধানীর দক্ষিণ শাহজাহানপুরে একটি ঝুপড়ি দালান বাড়িতে জোসনা খাতুনের বাস। ১৯৭১ সালে এই বাড়িতেই ছিলেন তারা। তখন ছিলো ছনের ঘর। এখন সেটি টিন শেড দালান বটে, তবে খসে পড়ছে তার পলেস্তারা। কোথাও কোথাও ইট-কাঠও ভেঙ্গে পড়েছে। তাতেই জোসনা খাতুন থাকেন চার ছেলে মেয়ে, নাতি-নাতনি সবাইকে নিয়ে।
সেখানেই এই প্রতিবেদকের কথা হয় জোসনা খাতুনের সাথে। আশির কোটায় পড়ে শীর্ণ শরীরটি এখন নিজে টেনে ওঠা-বসা করার অবস্থায় নেই। তবে কেউ হাত ধরে বসিয়ে দিলে বসে থাকতে পারেন। কথাগুলো জড়িয়ে যায়।
বড় মেয়ে জোবেদা খানম, মেয়ে জামাই মো জালাল উদ্দিন ও ছেলে বউ হোসনে আরার সহযোগিতা নিয়ে কথা হলো জোসনা খাতুনের সঙ্গে। তাতে জানা গেলো পুরো ঘটনা। জোবেদাও কিছু কিছু স্মরণ করতে পারছেন। তখন তিনি ছিলেন ১১ বছরের কিশোরী। মা ও মেয়েই জানালেন সে সময়ের কথা।
১৯৭১ সালে জোসনা খাতুনের স্বামী বোরহান উদ্দিন খান ছিলেন একটি ব্যাংকের নিরাপত্তারক্ষী। নিজের জমানো টাকায় করা এই বাড়িটি তখন ছিল ছনের বেড়া আর টিনের চালে তৈরি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার পরেও তারা এই বাড়িতেই ছিলেন। তারই একরাতের ঘটনা। অনেক গোলাগুলি হচ্ছিল শাহজাহানপুর এলাকায়। চারদিক থেকে মিলিটারিরা ঘিরে ধরেছে।
দিন তারিখ এখন আর মনে করতে পারেন না সেদিনের ১১ বছরের কিশোরী জোবেদাও। শুধু মনে আছে, ভোররাতের দিকে ঘরে শুয়ে থাকা অবস্থায় জোসনা বেগমের বুকের বাম দিকটাতে এসে কিছু একটা লাগে। খুব একটা ব্যাথা অনুভব করছিলেন না। অন্ধকার রাতটা সেভাবেই পার করে দিলেন। ভোরে আলো ফুটতেই দেখেন তার কাপড় রক্তে ভেজা। দ্রুত জোসনা খাতুনকে নিয়ে যাওয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানে চারদিন থাকার পর ঘরে ফিরিয়ে আনা হয় তাকে। বুকের ভেতর বুলেট আটকে থাকার মতো কোনও কথা তখন চিকিৎসকরা তাকে বলেননি। নিজেও অনুভব করেননি, জানান জোসনা খাতুন।
মেয়ে জোবেদা জানান, কয়েকটা দিন ভাল থাকার পর তার মায়ের বুকে আবার ব্যথা হয়েছিলো। তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাশেই একজন চিকিৎসকের কাছে।
পাশে শুয়ে থাকা জোসনা খাতুন ভাঙা গলায় বলেন, ‘আমতলায় বসতো আলম ডাক্তার। সেই আলম ডাক্তার ৩০ দিনে ৩১টা ইনজেকশন দেয়। তারপর থাইকা আমি ভালো ছিলাম, ব্যাথা-বেদনা কোনওদিন টের পাইনাই।’
ছেলে-মেয়েরা জানালেন, এতদিন সুস্থই ছিলেন জোসনা খাতুন। তবে গত জানুয়ারিতে শরীরে গুলি থাকার বিষয়টি জানার পর থেকেই বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
আর চিকিৎসকরা বলছেন, তার বয়স হয়েছে, কাশি হচ্ছে, কাশির কারণে বুলেটটির অবস্থান পরিবর্তন হচ্ছে, ফলে তার তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।
জোবেদা খানম বলেন, আম্মা ভালোই ছিলেন, চলে-ফিরে, খাওয়া-দাওয়া করতে পারতেন। এতবছর আমরা বলতে পারুম না, আমার আম্মারইতো মনে নাই গুলি লাগার কথা-এখন ধরা পরছে হাসপাতালে নেওয়ার পর।
‘এতবছরতো সংসার করলাম, পোলা মাইয়া বড় করলাম, বিয়া দিলাম, নাতি-নাতকুর হইলো, তাদেরও বিয়া হইছে। কোনওদিন কোনও ব্যাথা হয় নাই, জ্বালাপোড়া কিছুই আছিল না, এখন আবার সেই বুলেটের জ্বালায় আমার জীবন যায়,’ বলেন জোসনা খাতুন।
গুলি যে ভিতরে আছে-সেইটাতো টের পাইনাই, কোনও দুঃখ পাই নাই। শুধু বুঝতাম ভেতরে কেমন জানি করতো, বলেন জোসনা খাতুন।
এখনও কোনও ব্যাথা নাই জানিয়ে জোসনা খাতুন বলেন, খালি ‘রক্তবড়ি’ (রক্তবমি হয় বলে চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ) খাইলেই আমি সুস্থ হইয়া যাই। আর কোনও অসুবিধা আমার নাই।
পুত্রবধু হোসনে আরা বলেন, ১৮ বছর বিয়ে হয়েছে তার। কিন্তু কোনওদিন শোনেননি, শাশুড়ির শরীরে গুলি রয়েছে। তবে মাঝে মাঝে গলা দিয়ে রক্ত বের হলে তারা ঠাণ্ডাজনিত অসুখের কথা ভেবে পাড়ার ফার্মেসি থেকে ঠাণ্ডার ওষুধ এনে দিতেন, আদা দিয়ে চা করে খাওয়াতেন। তাতেই কিছুটা সুস্থ্য হয়ে উঠতেন।
এই গুলির কথা পরিবারের সবাই এতদিন ভুলেই গিয়েছিল। হঠাৎ করে সেটি সামনে আসায় পরিবারটি দিশেহারা হয়ে পড়েছে, বলেন হোসনে আরা।
তিনি বলেন, আমরা যদি আগে জানতাম, মা যদি কোনওদিন কিছু বলতো তাইলেতো ডাক্তারের কাছে যাইতাম, পরীক্ষা হইতো-তখন ধরা পড়তো। কিন্তু এখন এই বয়সে ধরা পড়াতে চিকিৎসাওতো ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। এই শরীর নিয়ে অপারেশন করাতে সাহস পাইনা আমরা কেউ।
গত ২২ জানুয়ারি বক্ষব্যাধি হাসপাতালে ভর্তি হন জোসনা খাতুন। সেখানে বুকে বুলেটের বিষয়টি জানার পর তার চিকিৎসায় ১০ সদস্যের একটি মেডিকেল টিমও গঠন করা হয়।
জোসনা খাতুনের মেয়ে জামাই জালাল উদ্দিন বলেন, আমরা চিকিৎসকদের কাছে কৃতজ্ঞ। তারা যতটা যত্ন নিয়ে মায়ের চিকিৎসা করেছেন, আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন-তা আমাদের জন্য বড় পাওয়া।
বিশেষ বিবেচনা নিয়ে এই রোগীর চিকিৎসা করতে চেয়েছেন বক্ষব্যাধির চিকিৎসকরা। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের আপত্তিতেই তা করা হয়নি, জানালেন জালাল উদ্দিন।
জোসনা খাতুনের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্য ও জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক এবং হাসপাতালেরভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. বশীর আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, বুলেটটি ফুসফুসের ভেতরে এতবছর ধরে ছিল। তার অন্য কোনও শিরা, ধমনী বা হার্টে সেটি আঘাত করেনি। যে কারণে তিনি এতদিন ভালোই ছিলেন। এখন বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরণের জটিলতা দেখা দিয়েছে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনীর একটি বুলেট ৪৭ বছর পরে এক বৃদ্ধার শরীরে আবিষ্কৃত হওয়ার এই ঘটনা চিকিৎসকদের বিষ্মিত করেছে। তারা যথেষ্ঠ দায়িত্বশীলতার সাথে এই বৃদ্ধার চিকিৎসা করেছেন বলে জানান ডা. বশীর আহমদ। তিনি বলেন, ঝুঁকির হলেও আমরা সকল সতর্কতায় বৃদ্ধার বুকের বুলেটটি অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারে প্রস্তুত ছিলাম। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে সাড়া না পাওয়াতে তাদের চাপ দেওয়া হয়নি।
জোসনা খাতুনের মেয়ে জামাই জালালউদ্দিন জানান, এখন তার শাশুড়ির শরীরে প্রতিমাসে রক্ত দিতে হয়, ওষুধের প্রচুর খরচ হচ্ছে। এত টাকা বহন করার মত সক্ষমতা এই পরিবারটির নেই।
জোসনা খাতুনের স্বামী মারা যান সাত বছর আগে। দিন এনে দিন খাওয়া এই পরিবারটি এখন আশায় রয়েছে যদি সরকার কোনও সাহায্য করে।
কথা বলে বের হওয়ার পথে জোসনা খাতুন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সরকারকে বইলো-তারাতো কতজনের জন্য কতকিছু করে, আমারে যদি একটু দেখত, যদি আমার ওষুধের টাকাটাও তারা দিত-তাইলে আমি অন্তত বেদনা থাইকা বাঁচতাম।’
সারাবাংলা/জেএ/এমএম