Friday 15 Aug 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বেগম খালেদা জিয়া’ হার না মানা এক নারী নেত্রীর নাম

ফারহানা নীলা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৫ আগস্ট ২০২৫ ০৯:১৬ | আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৫ ১২:৩৮

বেগম খালেদা জিয়া।

ঢাকা: ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট, দিনাজপুরের এক ছোট শহরে ইস্কান্দার মজুমদার ও তৈয়বা মজুমদারের ঘরে জন্ম নিলেন এক কন্যা। বাবা মা নাম রাখলেন খালেদা খানম পুতুল। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তৃতীয় সন্তান খালেদা। তার ভাইয়েরা সবাই ছোট। সময়ের আবর্তে তিনি হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ও প্রভাবশালী চরিত্র: বেগম খালেদা জিয়া।

শৈশব:

শৈশবের দিনগুলো কেটেছে সবুজে মোড়া উত্তরবঙ্গের আঙিনায়। পুকুরে ভেসে থাকা শাপলা, আমগাছের নিচে বিকেলের খেলাধুলা— এমন সরল আর নির্ভেজাল জীবনের ছোঁয়া ছিল তার ছেলেবেলায়। স্কুলজীবনে তিনি ছিলেন শান্ত স্বভাবের, কিন্তু মন ভরা ছিল কৌতূহল ও স্বপ্নে।

বিজ্ঞাপন

স্বামী জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়া। ছবি: সংগৃহীত

বিয়ের পর নতুন অধ্যায়:

মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৬০ সালে বিয়ে হয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। বিয়ের পর শুরু হয় সেনা-পরিবারের এক ভিন্ন জীবন। শৃঙ্খলাবদ্ধ, স্থানান্তর-ভরা, দেশের নানা প্রান্তে বসবাসের অভিজ্ঞতা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী ছিলেন সেক্টর কমান্ডার; খালেদা কাছ থেকে দেখেছেন সেই ভয়াবহতা ও বীরত্বের অধ্যায়।

রাজনীতির পথে:

বেগম খালেদা জিয়া একজন বাংলাদেশি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি ১৯৯১-১৯৯৬ সাল এবং ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীরূপে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মাঝে দ্বিতীয় মহিলা সরকারপ্রধান। তার স্বামী জিয়াউর রহমানের শাসনকালে তিনি ফার্স্ট লেডি ছিলেন।

১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর বিএনপির নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা প্রায় শূন্য, কিন্তু আত্মবিশ্বাস অটুট। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন বিএনপির প্রধান।

বন্দী জীবন ও রাজনৈতিক ঝড়:

রাজনীতির পথ কখনোই সহজ ছিল না তার জন্য। ক্ষমতার পালাবদল, বিরোধী দলের আন্দোলন, নানা ষড়যন্ত্র ও মামলার মধ্য দিয়েও লড়াই চালিয়ে গেছেন। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে কাটাতে হয় দীর্ঘ সময়। সে সময় তিনি অসুস্থ হলেও চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি।

বাসা থেকে উচ্ছেদ:

সরকারের সিদ্ধান্তে খালেদা জিয়াকে পুরোনো সরকারি বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

২০১০ সালে সরকারের সিদ্ধান্তে তাকে তার পুরোনো সরকারি বাসভবন ‘ফিরোজা’ থেকে উচ্ছেদ করা হয়। সেদিনের দৃশ্য ছিল হৃদয়বিদারক— দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকদের কান্না, আর খালেদা জিয়ার নীরব মুখ, যা যেন বলছিল— ‘রাজনীতির মঞ্চে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের হিসাব মেলানো যায় না।’

মামলা ও মুক্তি:

২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তাকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। দীর্ঘ কারাবাসে স্বাস্থ্য আরও অবনতি হয়, কিন্তু তবুও তিনি বিদেশে চিকিৎসার জন্য সরকারের শর্ত মেনে দেশ ছাড়েননি। ২০২০ সালের মার্চে করোনাভাইরাস মহামারির সময় তাকে নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়— শর্ত ছিল দেশের বাইরে না যাওয়া ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নেওয়া। সেই মুক্তির পরও তিনি ছিলেন রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু মানসিকভাবে অদম্য।

পদক ও সম্মাননা:

২০১১ সালের ২৪ শে মে নিউ জার্সি স্টেট সিনেটে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ’ফাইটার ফর ডেমোক্রেসি’ পদক প্রদান করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট সিনেট কর্তৃক কোনো বিদেশিকে এ ধরনের সম্মান প্রদানের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম।

পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই তাকে ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ সম্মাননা দেয় কানাডিয়ান হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (সিএইচআরআইও) নামের একটি সংগঠন। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি উক্ত দাবি করার পাশাপাশি কানাডার এই প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া ক্রেস্ট ও সনদপত্র সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করে।

৫ আগস্টের পর নতুন অধ্যায়:

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক পরিবর্তনের ঝড়ে দেশজুড়ে নতুন সময়ের সূচনা হয়। দীর্ঘদিন ঘরবন্দি থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অনেকটাই অবনতি ঘটে। কিন্তু আবারও নতুন করে সাহস ও শক্তিতে সঞ্চারিত হন দেশের মানুষের জন্য। ৫ আগস্টের পর একদিন হঠাৎ-ই দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তা দেন— রাজনীতির ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে শান্তি ও স্থিতির আহ্বান জানান। ঘর বন্দী থেকে মুক্ত হয়ে চিকিৎসার প্রয়োজনে অবশেষে বিদেশ যান।

ঈদে পারিবারিক মুহূর্ত

দীর্ঘ আট বছর পর পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করেছেন খালেদা জিয়া।

এবার দীর্ঘ আট বছর পর পরিবারের সঙ্গে ঈদ পালন করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে ছেলে তারেক রহমান, দুই পুত্রবধূ ও তিন নাতনির সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেন তিনি।

এই ঈদে পরিবারের সঙ্গে তোলা ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন খালেদা জিয়া—ছবিতে তিনি ছিলেন হুইলচেয়ারে বসা, পাশে ছেলে তারেক রহমানের পরিবার, প্রিয় পরিবারের মাঝে হাসিমুখে থাকা এক দৃঢ় নেত্রী। এই ছবি ছিল রাজনীতির বাইরে তার ব্যক্তিগত জীবনের এক কোমল মাতৃত্বের প্রতিচ্ছবি।

বর্তমান শারীরিক ও রাজনৈতিক অবস্থা:

বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটাই স্থিতিশীল। তবে শঙ্কা এখনো কাটেনি। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন জানিয়েছেন, ‘বেগম জিয়া মূলত হার্ট, কিডনি ও লিভারসহ বিভিন্ন ধরনের রোগে ভুগছেন। যেটি তার শারীরিক পরিস্থিতিকে বেশ জটিল করে তুলেছে।’

বিভিন্ন দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার কারণে তাকে নিয়মিত চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

রাজনীতিতে সরাসরি সক্রিয় না হলেও, বিএনপির অভ্যন্তরে তার প্রভাব অটুট। তার উপস্থিতি দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস, যদিও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

আপোষহীন নেত্রী

শৈশবের সবুজ মাঠ থেকে ক্ষমতার প্রাঙ্গণ, বন্দী জীবন থেকে বিদেশে চিকিৎসা— খালেদা জিয়ার জীবন এক অদম্য নারীর গল্প। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যতই শক্তিশালী হোক, বারবার প্রমাণ করেছেন, তিনি সহজে হার মানার মানুষ নন। তিনি শুধু একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি এমন এক নারী, যিনি কখনো সহজ পথ বেছে নেননি বরং প্রতিটি বাঁকে লড়াই করে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন ইতিহাসে।

সারাবাংলা/এফএন/এমপি

‘বেগম খালেদা জিয়া: জীবন ও সংগ্রাম’ বেগম খালেদা জিয়া