ঢাকা: বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, ঐকমত্য কমিশনের কাজ দ্রুত শেষ হলেও ঐকমত্যের প্রক্রিয়া শেষ হয় না। বর্তমানে ঐকমত্য কমিশনের নামে অনৈক্যের প্রতীক তৈরি হয়েছে।
শনিবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে জনসংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জহির উদ্দিন স্বপন এ মন্তব্য করেন।
তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে মতাদর্শভিত্তিক সংলাপ এবং গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করার লক্ষ্যে সেন্টার ফর গভার্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুং (এফইএস)-এর সহযোগিতায় ইতোমধ্যেই পলিটিক্স ল্যাব শীর্ষক বিভিন্ন বিষয়ে চারটি ধারাবাহিক কর্মশালার আয়োজন করেছে। এই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে সিজিএস একটি জন-সংলাপের আয়োজন করেছে।
তিনি বলেন, ‘সংস্কার, বিপ্লব ও নৈরাজ্যের মধ্যে পার্থক্য এখনো অনেকের কাছে স্পষ্ট নয়। সংস্কার মানে মেরামত, কিন্তু তার সীমা কোথায়? বিপ্লব ও নৈরাজ্যের মধ্যকার রেখাটি কী? তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে এই বিভ্রান্তি স্বাভাবিক, তবে অভিজ্ঞ নেতারা সচেতনভাবে এ অস্পষ্টতা উপেক্ষা করলে তা গভীরভাবে বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেশপ্রেম রাখি বা না রাখি, যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আমরা কিছু বিশেষ সুযোগ ভোগ করি— এ বিষয়ে সবাই একমত। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সংস্কার করতে হলে মতবিনিময়, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ঐকমত্যের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াই জরুরি। যদি সবাই ফ্যাসিবাদ মুক্ত দেশ চায়, আলোচনার মাধ্যমে ও ভিন্নমতকে সম্মান জানিয়ে ঐকমত্যের পথেই এগোতে হবে। জাতীয় নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, এবং সৃজনশীল চিন্তা ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব।
তরুণ রাজনীতিকদের মধ্যে মতাদর্শভিত্তিক সংলাপ ও গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে সিজিএস, ফ্রেডরিখ এবার্ট স্টিফটুং (এফইএস)-এর সহযোগিতায় ইতোমধ্যেই ‘পলিটিক্স ল্যাব’ শীর্ষক চারটি ধারাবাহিক কর্মশালার আয়োজন করেছে। এর অংশ হিসেবে সিজিএস একটি জনসংলাপের আয়োজন করেছে।
সংলাপে উপস্থিত ছিলেন আমার বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, এফইএস বাংলাদেশ-এর রেসিডেন্ট রিপ্রেসেন্টেটিভ ফিলিক্স গ্রাদেস, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, জাতীয় নাগরিক পার্টির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, সিজিএস-এর নির্বাহী পরিচালক পারভেজ করিম আব্বাসী। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিজিএস-এর প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান।
জিল্লুর রহমান আশা প্রকাশ করেন, তরুণেরা ‘পলিটিক্স ল্যাব’-এর মাধ্যমে অর্জিত শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সিস্টেম অনুসরণ করি, এবং আমাদের জাতীয় সংসদ ভবনের মতো স্থাপত্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই।
ফিলিক্স গ্রাদেস বলেন, এফইএসের রাজনৈতিক জ্ঞান বিনিময়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বজুড়ে নতুন প্রজন্ম সরকার পরিবর্তনের পর সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে। এটি দেখায়, গভীর সমস্যা সমাধান করতে হলে রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সংলাপ ও গণতান্ত্রিক পথে অগ্রসর হতে হবে। শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্র রক্ষার একমাত্র উপায় নয়, নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম ও গবেষণা খাতকে শক্তিশালী করাই সুশাসনের মূল উপায় হতে পারে।
পারভেজ করিম আব্বাসী বলেন, ‘‘সিজিএস সবসময় সুশাসন ও সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করে এসেছে। ‘পলিটিক্স ল্যাব’-এর লক্ষ্য হলো বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তরুণ রাজনীতিকদের মতবিনিময়ের সুযোগ দেওয়া। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানেরও মূল দাবি ছিল সুশাসন। দেশে ৫১ শতাংশ নারী থাকা সত্ত্বেও অভ্যুত্থানের পর তাদের অধিকার সুরক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। তিনি বলেন, এসব সমস্যার মূল কারণ হলো আমরা এখনো সহনশীলতা চর্চা করতে শিখিনি। সেই সহনশীলতা, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে বহুত্ববাদের অনুশীলনই ‘পলিটিক্স ল্যাব’-এর মূল উদ্দেশ্য।’’
মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতিতে ভিন্ন মতাদর্শের সঙ্গে একসাথে বসা তখন অসম্ভব ছিল, এখন তা সম্ভব হয়েছে। বাস্তবতা হলো মূলধারার দুটি দল ও এনসিপি বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় অদৃশ্য। নির্বাহী ক্ষমতা কমানো দরকার, এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলো না থাকলে রাজনীতি আরও উন্নত হতো।’
নুরুল হক নূর বলেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রান্তিক অঞ্চল থেকে অনেক ছেলে-মেয়ে উঠে এসেছে। তাদের ন্যায্য চাকরি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এখনকার ছাত্ররাজনীতিতে শক্তিশালী শিবির জয়ী হলেও, আন্দোলনের সামনের সারিতে থাকা তরুণরা পরাজিত হয়েছে।’
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন বলেন, ‘দ্রুত অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে গণভোট বিতর্কসহ অন্যান্য রাজনৈতিক সমস্যা দূর হবে। জুলাই সনদে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ প্রতিফলিত হয়নি, তাই তার দল সই করেনি। তিনি বলেন, নির্বাচিত সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে সংস্কারের বাস্তবায়ন।’
তাসনিম জারা বলেন, ‘আমরা এখন এমন এক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তরুণ সমাজ শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল। তবে এই অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য কেবল একজন নেতাকে বিদায় করা নয়, বরং ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকে সংস্কার করা। শেখ হাসিনার হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা ছিল, তার মূল কারণ ছিল সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ ও ফ্লোর ক্রসিং-এর বিধান। সংসদ কখনোই প্রকৃত অর্থে মুক্ত ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভবিষ্যতের প্রতিনিধিরা যেন দলের প্রতিনিধি না হয়ে জনগণের প্রতিনিধি হতে পারেন, সেটাই সবার প্রত্যাশা।’