Sunday 28 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেন এই দূরত্ব?
বিএনপির ‘পাত্তা না দেওয়া’, নাকি অলির ‘উচ্চাভিলাষ’!

ফারহানা নীলা স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:২০ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০০:৩৯

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বীরবিক্রম। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই—এই বাক্যটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আবারও সত্য প্রমাণিত হলো। তবে এবারের বিষয়টি বেশ নাটকীয় এবং অনেকের জন্যই অপ্রত্যাশিত। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ যখন জামায়াতের আমিরের পাশে বসে নির্বাচনি জোটের ঘোষণা দেন, তখন রাজনীতির হিসাব-নিকাশে নতুন করে সমীকরণ কষতে শুরু করেন বিশ্লেষকরা।

রোববার (২৮ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে যে দৃশ্য দেখা গেল, তা বিএনপির নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট। একসময়ের বিএনপির প্রতাপশালী নেতা, যিনি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দলটিকে সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, সেই অলি আহমদ আজ বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের বাইরে।

বিজ্ঞাপন

শুধু বাইরেই নয়, তিনি হাত মিলিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন নতুন ৮ দলীয় জোটের সঙ্গে। কিন্তু কেন এই দূরত্ব? কেন বিএনপির ‘ঘরের লোক’ হিসেবে পরিচিত অলি আহমদ আজ অন্য জোটে? এই দূরত্বের কারণ কি শুধুই আসন ভাগাভাগি, নাকি এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত অভিমান ও অবহেলা?

কর্নেল অলি আহমদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং বিএনপির ইতিহাস সমান্তরালভাবে চলেছে দীর্ঘকাল। ১৯৭১ সালে জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার সাক্ষী তিনি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোভনীয় চাকরি এবং নিশ্চিত ভবিষ্যৎ উপেক্ষা করে তিনি জিয়াউর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে বিএনপি গঠনে অংশ নিয়েছিলেন। তার নিজের ভাষায়, তখন তার চাকরির মেয়াদ ছিল আরও নয় বছর। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা এবং ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে যমুনা সেতুর কাজ শুরু—সবই তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের সাক্ষী।

তবুও ২০০৬ সালে তিনি বিএনপি ছেড়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করেন। যদিও পরবর্তী সময়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে যে, সেই পুরনো ক্ষত এবং নতুন অবহেলা মিলে দূরত্বকে যোজন যোজন বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিএনপির সঙ্গে অলি আহমদের দূরত্বের প্রধান কারণ হিসেবে ‘যোগাযোগের অভাব’ এবং ‘মূল্যায়নের সংকট’কে চিহ্নিত করা হচ্ছে। প্রেস ক্লাবের সংবাদ সম্মেলনে অলি আহমদ নীরব থাকলেও, তার পূর্ববর্তী মন্তব্যগুলো পরিস্থিতি বুঝতে সহায়ক।

কর্নেল অলি বলেন, ‘গত আড়াই বছরে বিএনপির কেউ যোগাযোগও করেনি। একটা দিন ছিল যখন সবাই আমার বাসায় আসতো, আমাকে ফোন দিত। আমি তাদের কাছে ১৪ জনের একটা শর্ট লিস্ট পাঠালাম। তারা আমাকে একটা ফোন দিয়েও বলেনি—একজন প্রতিনিধি পাঠান, আসেন আমরা আলোচনা করি। তাই আমার মনে হয়েছে আমাকে হয়তো বিএনপির প্রয়োজন নাই।’

এই বক্তব্যই প্রমাণ করে সংকটটা কেবল আসনের দরাদরি নয়, বরং ‘সম্মান’ ও ‘স্বীকৃতি’র। একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী হিসেবে তিনি বিএনপির কাছ থেকে যে নূন্যতম সৌজন্যবোধ আশা করেছিলেন, তা পাননি বলে অভিযোগ তার। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে অলি আহমদের এই ‘কমিউনিকেশন গ্যাপ’ বা যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা হুট করে তৈরি হয়নি। এটি দীর্ঘদিনের অবহেলার ফসল।

রাজনীতির মাঠে গুজব ছিল, এলডিপি প্রধান অলি আহমদ বিএনপির কাছে সম্মানজনক সংখ্যক আসন দাবি করেছিলেন। সূত্র মতে, তিনি চেয়েছিলেন অন্তত ছয়টি আসন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে সেই দাবি পূরণে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। উল্টো, অলি আহমদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী এবং এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ দল ত্যাগ করে বিএনপিতে যোগ দেন এবং কুমিল্লা-৭ আসনে বিএনপির মনোনয়ন বাগিয়ে নেন।

নিজ দলের মহাসচিবের এভাবে দলত্যাগ এবং বিএনপির তাকে লুফে নেওয়া—বিষয়টি অলি আহমদকে মানসিকভাবে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এটিকে তিনি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ এবং তাকে দুর্বল করার বিএনপির একটি কৌশল হিসেবে দেখেছেন। নিজের ঘর ভাঙার পেছনে বিএনপির ইন্ধন রয়েছে—এমন সন্দেহ থেকেই জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে ভেড়ার সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. রমিত আজাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি বিএনপির কৌশলগত ভুল’। কর্নেল অলির এই দলবদল এবং বিএনপির সঙ্গে দূরত্বের বিষয়ে কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বিএনপির বর্তমান রাজনীতিতে জোট ব্যবস্থাপনায় বড়ধরনের দুর্বলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কর্নেল অলি আহমদ কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, তিনি বিএনপির ইতিহাসের একটি অংশ। তাকে ধরে রাখতে না পারা বিএনপির জন্য কৌশলগত ভুল।’

তিনি বিশ্লেষণ করে আরও বলেন, “জামায়াতে ইসলামী এখন তাদের ‘যুদ্ধাপরাধী’ তকমা ঝেড়ে ফেলে নতুন ইমেজ গড়ার চেষ্টা করছে। তাদের জোটে অলি আহমদের মতো একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাকে পাওয়া বিশাল বড় বিজয়। এটি জামায়াতকে রাজনৈতিক বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা দেবে। অন্যদিকে, বিএনপি তাদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত মিত্রকে হারাল, যা ভোটের মাঠে খুব বড় প্রভাব না ফেললেও মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে বিএনপিকে পিছিয়ে দেবে। অলি আহমদের অভিযোগ—‘কেউ খবর নেয়নি’—এটি প্রমাণ করে যে বিএনপি তাদের শরিকদের ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ মনে করছে, যা জোট রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত।”

অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কর্নেল অলি আহমদকে সবসময় শ্রদ্ধা করি। কিন্তু রাজনীতির মাঠ এখন অনেক কঠিন। তিনি যেসব দাবি করেছিলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের আবেগ ও দলের স্বার্থ বিবেচনা করে তা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাছাড়া, জোট রাজনীতিতে ছাড় দেওয়ারও একটি সীমা থাকে।’

যোগাযোগ না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে ওই নেতা বলেন, ‘রাজনীতিতে যোগাযোগ দ্বিপাক্ষিক বিষয়। তিনি নিজেই তো দল ছেড়ে নতুন দল গঠন করেছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম তিনি আমাদের সঙ্গেই থাকুন, কিন্তু তার উচ্চাভিলাষ এবং জামায়াতের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা আমাদের অবাক করেছে। ড. রেদোয়ান আহমেদ বিএনপিতে ফিরে এসেছেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছেন মূলধারার রাজনীতি বিএনপির পতাকাতলেই সম্ভব।’

রোববারের সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের পাশে অলি আহমদের উপস্থিতি নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের জন্ম দিয়েছে। ৮ দলীয় এই জোটে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রাধান্য বেশি। সেখানে অলি আহমদের এলডিপি ও জাগপার মতো দলগুলো যুক্ত হয়ে একটি ‘মিশ্র জোট’ বা ‘হাইব্রিড অ্যালায়েন্স’ তৈরির চেষ্টা করছে।

জানা গেছে, এই নতুন জোটে অলি আহমদকে ছয়টি আসন ছাড়ের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যা বিএনপির কাছে চেয়েও তিনি পাননি। এবি পার্টির মতো নতুন দলগুলোও এখানে জায়গা করে নিচ্ছে। জামায়াত আমিরের বাম পাশে অলি আহমদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেয় যে, এই জোটে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘ফিগারহেড’ হিসেবে থাকছেন। জামায়াত তাকে সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে ইসলামি মূল্যবোধের একটি সংমিশ্রণ ঘটাতে চাইছে।

কর্নেল অলি আহমদের জামায়াত জোটে যোগদান কেবল একটি দলবদল নয়; এটি বাংলাদেশের জোট রাজনীতির ভঙ্গুর দশার প্রতিচ্ছবি। বিএনপির সঙ্গে তার দূরত্ব প্রমাণ করে যে, রাজনীতিতে অতীত ইতিহাস বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবসময় শেষ কথা নয়—স্বার্থ, সম্মান ও ক্ষমতার সমীকরণই মুখ্য।

যমুনা সেতুর কাজ যার হাতে শুরু হয়েছিল, যিনি জিয়ার বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন, তিনি আজ জিয়ার হাতে গড়া দলের প্রতিপক্ষ জোটে। এই দূরত্বের জন্য বিএনপি তাদের ‘অব্যবস্থাপনা’কে দায়ী করবে, নাকি অলি আহমদের ‘উচ্চাভিলাষ’কে—তা সময়ই বলে দেবে। তবে আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, অভিমানের দহনে পুড়ে বিএনপির সঙ্গে সম্পর্কের সূতোটি চিরতরে ছিঁড়ে ফেলেছেন বীর বিক্রম অলি আহমদ। আর এই সুযোগটি পূর্ণমাত্রায় কাজে লাগিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। নির্বাচনের মাঠে নতুন মেরুকরণ কতটা প্রভাব ফেলে, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

বিজ্ঞাপন

আরো

ফারহানা নীলা - আরো পড়ুন
সম্পর্কিত খবর