জন্ম থেকেই নিয়োগ-বিয়োগ, ৬ বার ভাঙন এরশাদের জাপায়
১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:৪৮
ঢাকা: এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিতে জন্ম থেকেই চলছে নিয়োগ-বিয়োগ ও তোষামোদের রাজনীতি। এ কারণে দলটিতে একাধিকবার ভাঙন দেখা দিয়েছে। এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা নতুন করে রাজনীতিতে প্রকাশ্য হওয়ায় আরেকবার ভাঙনের মুখে পড়ল দলটি।
জাপা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন— এবারের লড়াইয়ে প্রকাশ্যে এসেছেন এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা। তার সঙ্গে রাজনীতিতে রয়েছেন এরশাদ পরিবারের কয়েকজন। তারা কৌশলগত কারণে কেউ এখন প্রকাশ্যে আসছেন না। তবে পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এরশাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার এবং শপথ করেছেন তারা।
হযরত শাহজালাল (র.) পুণ্যভূমি সিলেট থেকে জাতীয় পার্টিকে নতুন করে গড়া এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে বিদিশা নতুন জাতীয় পার্টির যাত্র শুরু করেন। শিগগরিই তিনি বিভাগীয় শহরসহ জেলা শহরে ঝটিকা সফরে বের হবেন। সময় সুযোগ বুঝে তিনি দলের সম্মেলন ডাকবেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
এ সব বিষয় নিয়ে বিদিশা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরশাদের গড়া জাতীয় পার্টি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। দলটিকে এখন পুনঃগঠন করতে হবে। আমার নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে আরও শক্তিশালী করতে চাই।’
এ বিষয় নিয়ে জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে অনেক আগে তিনি বলেছেন, ‘যে কেউ দল গঠন করতে পারে। তবে তার নিবন্ধন থাকতে হবে।’
সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এ সময় এরশাদ ছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতায়।
১৯৯০ সালে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত দলটিতে ছয়বার ভাঙন হলো। এরশাদের জীবদ্দশায় ৫ বার এবং তার মৃত্যুর দুই বছর পর আর একবার ভাঙল দলটি।
এবার এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশার নেতৃত্বে আরেকটি জাতীয় পার্টির যাত্রা শুরু হলো গত ১৯ সেপ্টেম্বর। সিলেটে হযরত শাহজালাল (র.) এর মাজার জিয়ারত করে জাতীয় পার্টি পুনর্গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন বিদিশা। তিনি জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান বলে ঘোষণা দেন।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন মূল অংশটি জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত। দলটি নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। নির্বাচনী প্রতীক লাঙল। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) নিবন্ধিত বাই সাইকেল প্রতীক নিয়ে, নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে। কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির আরেক অংশ। এ ছাড়া তাসমিনা মতিনের নামে জাতীয় পার্টির নিবন্ধন আছে। জাতীয় পার্টির নেতা এম এ মতিনের নেতৃত্বে এ অংশটি আলাদা হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদিশার নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)।
জাতীয় পার্টির একাধিক নেতা-কর্মীর সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে— জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কোনো ভবিষ্যত নেই। নিজস্ব সাংগঠনিক কোনো শক্তি নেই। এরশাদের জীবদ্দশায় যতটুকু ছিল তার মৃত্যুর পর শূন্যতে নেমে এসেছে। দলটির শীর্ষ নেতারা জাপার আদর্শ ও নীতি থেকে সরে গিয়ে তোষামোদি বেছে নিয়েছেন।
নাম গোপন রাখার শর্তে ওই নেতা জানান, এখন যারা এমপি হিসেবে সংসদে রয়েছে তাদের অনেকেই নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না। দলটির চেয়ারম্যানের যে কতজন উপদেষ্টা রয়েছে তার কোনো হিসাব নেই। দলের মধ্যে একনায়কতন্ত্র চলার কারণে ত্যাগী এবং দল থেকে বহিষ্কার হওয়া নেতারা বিদিশার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। দলটির অনেক কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী নেতারাও সময় হলেই বিদিশার পক্ষ নিয়ে প্রকাশ্যে চলে আসবেন।
দলের একজন প্রভাবশালী নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল থেকে নেতাদের বাগিয়ে গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি। দলটি বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে ভাঙনের মুখে পড়ে।’
জাপার ওই নেতার ভাষ্যমতে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া নিয়ে, কখনও মন্ত্রী হওয়ার ইস্যুতে দলটি ভেঙেছে।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে জাপায় এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে জাতীয় পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়। সেই বিভাজন এখনও আছে।
১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে চার দলীয় জোটে চলে যায়। সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করেন। এই অংশের নেতৃত্বে দিচ্ছেন আন্দালিব রহমান পার্থ। এই দল থেকে বের হয়ে গিয়ে এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। ১/১১ এর সময় জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন। দলটির অতিরিক্ত মহাসচিব সাইদুর রহমান টেপা সারাবাংলাকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে এখন ভাঙনের সুযোগ নেই। বিদিশা জাতীয় পার্টিও কেউ না। তিনি এরশাদের সাবেক স্ত্রী। ওই সময় জাতীয় পার্টি থেকে বিদিশার প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিল করা হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিদিশা যদি এখন জাতীয় পার্টি নামে রাজনৈতিক দল করেন, তবে তার টুঁটি তো চেপে ধরা যায় না। তবে বিদিশার কারণে জাতীয় পার্টির কোনো ক্ষতি হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় পার্টিতে কখনও নিয়োগ-বিয়োগের রাজনীতি চলেনি। যারা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’
আরও পড়ুন
ভাঙনের আওয়াজ পাওয়া যায় জাপায়
হঠাৎ জোটে ভাঙন, চরম অস্বস্তিতে বিএনপি
হ য ব র ল জাপার করুণ অবস্থা, ফের ভাঙনের শঙ্কা!
মুখোমুখি রওশন-জি এম কাদের: ভাঙন ঠেকবে জাপা’র?
রওশন-জিএম কাদেরের ‘ঠাণ্ডা লড়াই’, জাপায় ভাঙনের সুর
দেবর-ভাবির ঠাণ্ডা লড়াই প্রকাশ্যে, ফের ভাঙনের মুখে জাপা
আওয়ামী লীগ-বিএনপি কেউই জাপার বন্ধু নয়— জি এম কাদের
জাপার ভাঙন রক্ষা: বিরোধীদলীয় নেতা রওশন, চেয়ারম্যান জিএম কাদের
সারাবাংলা/এএইচএইচ/একে