শাপলা চত্বরের নৃশংসতার দগদগে স্মৃতি নিয়ে বিচারের আশায় হেফাজত
৪ মে ২০২৫ ২২:২২
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০১৩ সালের ৫ মে গভীর রাত। ঢাকার শাপলা চত্বরের মঞ্চে আগুনঝরা বক্তব্য দিচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লাখো নেতাকর্মীর জমায়েত। চারপাশ ঘিরে আছে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা। অবস্থানকারীদের বারবার সরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে হ্যান্ডমাইকে। হঠাৎ বিদ্যুতের আলো নিভে গেল। চারপাশে ভুতুড়ে অন্ধকার।
এর মধ্যেই তিন বাহিনীর সদস্যরা ফাঁকা গুলি আর কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে শুরু করেন। থেমে থেমে ভেসে আসছিল সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ। প্রায় ১০ মিনিট ধরে এমন পরিস্থিতির এক পর্যায়ে মঞ্চের মাইক বন্ধ হয়ে যায়। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে এগোতে শুরু করেন শাপলা চত্বরের দিকে। সৃষ্টি হয় এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির।
একযুগের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সেই বিভীষিকাময় রাতের কঠিন স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে হেফাজতের নেতাদের মধ্যে, তারাই দিয়েছেন এমন বর্ণনা। যৌথ বাহিনীর অভিযান ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’র সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা চিন্তা করে এখনো আঁতকে ওঠেন তারা। সেদিন নিজেদের চোখে দেখা সহযোদ্ধাদের লাশ, আহত ভাইয়ের রক্তাক্ত দেহের ভয়ংকর স্মৃতি এখনও ভুলতে পারেননি তারা। সেই দুঃসহ স্মৃতি এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা।
সেই রাতে আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ নিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দ্বারস্থ হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিদায় নিয়েছে আওয়ামী লীগ, ক্ষমতায় এখন অন্তর্বর্তী সরকার। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হেফাজত নেতারা এখন গণহত্যার জন্য ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ জড়িত সবার বিচার চান। বিচারের আগপর্যন্ত আওয়ামী লীগ যাতে রাজনীতি এবং ভোটে ফিরতে না পারে, এমন দাবিও তাদের।
হেফাজতে ইসলামের সেদিনের অবস্থান কর্মসূচিতে রাতের অন্ধকারে যৌথবাহিনীর অভিযানে ঠিক কতজন মারা গিয়েছিলেন, তার প্রকৃত হিসেব এখনও অজানা। অভিযানে ৬১ জন নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’। তবে সেসময় পুলিশের দাবি ছিল- রাতের অভিযানে সেদিন কেউ মারা যাননি, দিনভর সংঘাতে নিহত হয়েছিলেন ১১ জন। সর্বশেষ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে ৫৮ জন নিহতের তথ্য জানিয়েছেন।
সেদিনের শাপলা চত্বরের ভয়ঙ্কর স্মৃতির বর্ণনা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেদিন যৌথবাহিনী এক লাখ ৫৪ হাজার বুলেট বন্দুকের নল থেকে বের করে আলেম-ওলামাদের বিদ্ধ করেছিল। এ রকম একটি বিভীষিকাময় ও বর্বোরোচিত গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে কারবালার হত্যাকাণ্ডকেও হার মানিয়েছে। সেদিনের বর্ণনা দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই।’
‘গণমাধ্যম সেসব তথ্য দেশ-বিদেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, কীভাবে আমাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে। এ গণহত্যা চালানোর পর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি এনে আমাদের ভাইদের লাশ তুলে নিয়ে গুম করা হয়েছে। শহিদের রক্তে সেদিন ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। ওয়াসার পানি ও সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী এনে সে রক্ত পরিষ্কার করা হয়েছিল, যাতে গণহত্যার কোনো আলামত না থাকে। সেদিনের ঘটনায় অনেকে পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছেন, চোখ হারিয়ে অন্ধ হয়েছেন।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে গণহত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবি জানিয়ে হেফাজতের এ নেতা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবি, খুনি হাসিনাসহ গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কুশীলব সবাইকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেছি। আমাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খুনি হাসিনাসহ নয়জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যদি তাদের বিচার করা না হয়, পরবর্তী সময়ে কোনো রাজনৈতিক সরকার এলে তাদের স্বার্থে এ বিচার কার্যক্রম বিলম্ব করতে পারে।’
কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগসহ ১৩ দফা দাবিতে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবস্থান কর্মসূচি নিয়েছিল ২০১৩ সালে ৫ মে। শাপলা চত্বরে চলছিল মহাসমাবেশ।
হেফাজতের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাপলা চত্বরের সেই মহাসমাবেশে চট্টগ্রাম থেকে প্রায় এক লাখ হেফাজতের নেতাকর্মী যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্যে হেফাজতের মূল কেন্দ্র হাটহাজারীর দারুল উলূম মঈনুল আলম হাটহাজারী মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীই ছিলেন বেশি। যারা যেতে পারেননি, তারা পরদিন স্থানীয়দের নিয়ে ঢাকার সমাবেশে হামলার প্রতিবাদে চট্টগ্রামে করেছিলেন বিক্ষোভ মিছিল। তাদেরই একজন হেফাজতে ইসলাম হাটহাজারী উপজেলার বর্তমান সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুল্লাহ আসাদ।
শাপলা চত্বরে নৃশংসতার পর হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের ওপর নেমে এসেছিল মামলা-নির্যাতনের খড়গ। আসাদউল্লাহ আসাদের নামে করা হয়েছিল ১৩টি মামলা। তার দুই ভাইও মামলা-নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি।
আসাদুল্লাহ আসাদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩ সালের ৫ মে আমরা চট্টগ্রামে ছিলাম। সেদিন ঢাকার মহাসমাবেশে যোগ দিতে প্রায় এক লাখ আলেম-ওলামা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম থেকে গিয়েছিলেন। রাতে ইন্টারনেন্ট বন্ধ করে দেওয়ায় আমরা খুব উৎকণ্ঠায় ছিলাম। বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা শুনতে পেয়েছিলাম আমাদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে গোলাগুলি হচ্ছে। পরে শুনেছি আল্লামা শফি হুজুরকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। সেদিন অনেক আলেম-ওলামা পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে শহিদ হয়েছেন, যাদের অনেকের লাশ আমরা এখনও পাইনি।’
‘এর প্রতিবাদে পরদিন ৬ মে আমরা হাটহাজারীর এলাকাবাসী মিছিল করেছি। সেখানেও পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। আমাদের অনেকেই সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। সাত থেকে আটজন মারা যান ওইদিন। এর পর থেকেই আমাদের নামে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে নিয়ে নির্যাতন করেছে। দেশের আলেম-ওলামাদের ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার জঙ্গি ট্যাগ দিয়ে নাটক সাজিয়ে আয়নাঘরে বন্দি করে রেখেছিল। অনেককে ক্রসফায়ারের নামে খুন করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর হেফাজতের ইসলামের অনেক নেতাকর্মীকে আমরা সে আয়নাঘর ও জেল থেকে বের করে এনেছি। কিন্তু এখনও আমরা মামলার ঘানি টানছি। আমাদের তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধেই মামলা আছে ৩৭টি। আমার বিরুদ্ধে আছে ১৩টি মামলা। মামলার ভয়ে হাটহাজারী মাদরাসার মধ্যেই অনেকদিন লুকিয়ে ছিলাম। সেসব মামলা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।’
হেফাজতে ইসলাম হাটহাজারী উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এমরান সিকদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩ সালে ৫ মে বাংলাদেশের মুসলমান ও তৌহিদি জনতা তাদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে সমবেত হয়েছিলেন। নাস্তিক্যবাদী অপশক্তি থেকে বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডকে রক্ষা করতে হেফাজতের জাগরণ। সেদিন সকল নিরস্ত্র মুসলমানরা শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলেন। আমাদের আমির আল্লামা শফী সাহেব ফ্যাসিস্ট, জালেম আওয়ামী লীগ সরকার থেকে সকালের নামাজ পর্যন্ত সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু ফ্যাসিস্ট সরকার রাতের আঁধারে নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। সেদিন শত শত মুসলমান ভাই শহিদ হন।
তিনি বলেন, ‘সেদিন অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। বাধ্য হয়েই সেদিন রাতেই হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা শাপলা চত্ত্বর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার এমন ভয়ভীতির মধ্যে রেখেছিল যারা সেদিন মারা গিয়েছিলেন তাদের পরিবারের সদস্যরা সংবাদমাধ্যম ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের কাছে কিছুই বলতে পারেনি।’
হেফাজতের এ নেতা বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ১৬ বছর বাংলাদেশে যে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার নিন্দা জানানোর ভাষা নেই। বর্তমান সরকার যারা আছে তাদের কাছে আমরা জোর দাবি, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী জালেমদের যাতে তারা কোনোভাবেই ক্ষমার দৃষ্টিতে না দেখে। প্রত্যেকটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে তাদের যেন বিচারের আওতায় আনা হয়- এটাই আমাদের দাবি।’
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম