গাজীপুরে ‘মন্দের ভালো নির্বাচন’
২৭ জুন ২০১৮ ০৭:৪৯
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: বিএনপির পক্ষ থেকে ব্যাপক ভোট কারচুপি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের অভিযোগ করা হলেও নির্বাচন কমিশন (ইসি) বলছে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলছেন, সর্বশেষ খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনে বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এটিকে একটি ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ ও ‘মন্দের ভালো’ নির্বাচন বলা যেতে পারে।
গাজীপুর সিটির এই নির্বাচনে বড় ব্যবধানে বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারকে পরাজিত করে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম। তবে ভোট শুরুর আগে থেকেই নেতা-কর্মীদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগ করেছে বিএনপি। অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলার কারণে ৯টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিতের ঘোষণাও দিতে হয়েছে নির্বাচন কমিশনকে। তবে সরকার ও ইসি বলছে, সুষ্ঠু একটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে বিএনপি।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রি. জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্বাচনে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠেছে। আর আপাতদৃষ্টিতে সবকিছু ঠিক ছিল মনে হলেও এসব অভিযোগের সত্যতা কতটুকু, তা নির্বাচন কমিশন ও সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখতে হবে। তবে নির্ধারিত সময়ে এই নির্বাচনটি না হওয়ায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়েছে— এটা বলতে পারি।’
এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, গত দেড় মাসে প্রার্থীরা ভোটারদের ইফতারি খাইয়েছেন, ঈদের উপহার দিয়েছেন। সব প্রার্থীর এমন ব্যয়ের সক্ষমতা ছিল কি না, বা কিভাবে তারা এত অর্থ ব্যয় করেছেন— সেটাও দেখতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘পুরো প্রক্রিয়াটিতে বলা যায়, একটি দ্বিখণ্ডিত নির্বাচন হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে বা নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হলে হয়তো এই সমস্যা হতো না।’
গোটা নির্বাচন নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য না করে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘সেটা বলা খুব আর্লি হয়ে যাবে। আরও অন্তত দুয়েকদিন পর পুরো বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করা যাবে।’
বিভিন্ন অনিয়ম-অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এই নির্বাচনকে ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে মনে করছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এমন নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল না বলেও মনে করেন তিনি।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘অনেক অভিযোগ আর অনিয়মের কথা উঠেছে, যা খুলনা সিটিতেও ছিল। জাল ভোট, সিল মারা, বিরোধী দলকে হুমকি-ধমকি দেওয়া, এমনকি বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) সমস্যাও ছিল। প্রকৃতপক্ষে এগুলোর কোনো দরকার ছিল না।’
সুজন সম্পাদক আরো বলেন, ‘স্থানীয় জনগণ উন্নয়ন চায়। তাই সরকার দলীয় প্রার্থীকেই ভোট দেবে— এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে ভোটারদের সামনে অর্থপূর্ণ কোনো বিকল্প ছিল না। তারপরও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচন খুলনার চেয়েও খারাপ হয়েছে। এর কোনো দরকার ছিল না।’
বাকি সব বিষয়ের মতো নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমাদের মানদণ্ড নিচু হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক আইন উপদেষ্টা শাহদীন মালিক। সেই মানদণ্ড অনুযায়ী, গাজীপুরে আপাতদৃষ্টিতে সুষ্ঠু মনে হলেও ‘মন্দের ভালো’ একটি নির্বাচন হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
শাহদীন মালিক বলেন, ‘৯টি কেন্দ্রে ভোট স্থগিতসহ কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বিএনপির পোলিং এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে, যা স্বাভাবিক ছিল না। তবে নির্বাচনে কিছু গণ্ডগোল মেনে নেওয়ার হিসাব এখন স্বাভাবিক ঘটনা। এটিই রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই হিসাবে নির্বাচন ভালোই হয়েছে। কিছু কেন্দ্রে গণ্ডগোল হবে— সেটা মেনে নিয়ে বলব, নির্বাচন ভালোই হয়েছে।’
তবে গাজীপুরের এই নির্বাচনে এত কম ভোট পাওয়ার পেছনে বিএনপির দুর্বলতাকেও কারণ হিসেবে দেখছেন শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় বিকল্প কোনো পরিকল্পনা বা বক্তব্য স্থানীয় ভোটারদের সামনে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি। তাদের একঘেঁয়ে ও একমাত্র বক্তব্য খালেদা জিয়ার মুক্তি, যা স্থানীয় ভোটারদের প্রভাবিত করেনি। বিএনপি স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের সামনে যেসব পরিকল্পনা বা বক্তব্য দিয়েছে, তা খুবই দুর্বল ছিল। সব ক্ষেত্রেই তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে এই নির্বাচনেও। স্থানীয় ভোটাররা কেন তাদের ভোট দেবে, তা তারা তুলে ধরতে পারছে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে বিরোধী পক্ষকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা আছে। কিন্তু এটি বিরোধী দলকে জেতানোর জন্য যথেষ্ট না।’
নির্বাচন কমিশনের সাবেক এই আইনজীবী সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে বলেন, ‘সবকিছুর পরও বলব ভোট সুষ্ঠু হয়েছে। তবে সব বিষয়েই আমরা এখন নিচু মানদণ্ডের দেশ হয়ে গেছি। সেই হিসেবে মন্দের ভালো একটি নির্বাচন হয়েছে গাজীপুরে।’
সারাবাংলা/জেডএফ/জেএ/এটি/টিআর
আরও পড়ুন-
গাজীপুর সিটি নির্বাচন: ইভিএম-এর দুই কেন্দ্রে এগিয়ে নৌকা
ভোটগ্রহণ শেষ, চলছে গণনা
** দ্রুত খবর জানতে ও পেতে সারাবাংলার ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে রাখুন: Sarabangla/Facebook