Saturday 10 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বরেণ্য সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১০ মে ২০২৫ ১১:২৯

মুস্তাফা জামান আব্বাসী।

‎ঢাকা: ‎বরেণ্য সংগীতশিল্পী, গবেষক, লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই।  শনিবার (১০ মে) সকাল ৭টায় রাজধানীর বনানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মেয়ে শারমিন আব্বাসী মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

‎জানা গেছে, বেশ কিছুদিন ধরে বাধ্যর্কজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন ৮৭ বছর বয়সী সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী। শুক্রবার (৯ মে) শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।

‎মোস্তফা জামান আব্বাসী ভারতের কোচবিহার জেলার বলরামপুর গ্রামে ৮ ডিসেম্বর ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। উপমহাদেশের এক প্রখ্যাত সংগীত পরিবারের সন্তান মুস্তাফা জামান আব্বাসী। তার পিতা আব্বাস উদ্দীন আহমেদ পল্লীগীতির কিংবদন্তী শিল্পী। এ দেশের পল্লীসংগীতকে তিনিই প্রথম বিশ্বের দেশে দেশে জনপ্রিয় করেছেন। চাচা আব্দুল করিম ছিলেন পল্লীগীতি ও ভাওয়াইয়া ভাটিয়ালি গানের জনপ্রিয় শিল্পী। বড় ভাই বিচারপতি মোস্তফা কামাল আইনবিশারদ। মোস্তফা কামালের কন্যা নাশিদ কামালও একজন বরেণ্য শিল্পী। বোন ফেরদৌসী রহমান দেশের প্রথিতযশা বহুমাত্রিক প্রতিভার সংগীতজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত।

‎তার শৈশব ও কৈশোর কাল কলকাতায় কাটে। এই পরিবারটির সাথে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা ছিল। প্রত্যেক বড় মানুষের শৈশব ও কৈশোরে ছড়িয়ে থাকে নানা উজ্জ্বল রঙের বিভা। ব্যতিক্রম নন মুস্তাফা জামান আব্বাসীও। আব্বাসীর শৈশব ও কৈশোরও ছিল আনন্দময়, স্মৃতি স্নিগ্ধ, কোমল ও মধুর। তার বেশিরভাগ সময় কেটেছে ছায়াসুনিবিড় প্রাকৃতিক পরিবেশের বলরামপুরে।

মুস্তাফা জামানের শিক্ষাজীবন কলকাতায় শুরু হয়। শৈশব থেকেই আব্বাসী ছিলেন প্রখর মেধাশক্তির অধিকারী। পড়াশোনা করেছেন বলরামপুর হাই স্কুল, কুচবিহারের জেনকিনস্ স্কুল, পার্ক সার্কাসের মডার্ন স্কুল, ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল, ঢাকা কলেজ ও সবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

‎এখান থেকে ইতিহাসে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। মাধ্যমিক পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় একাদশতম এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ১৩তম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পাস করেন।

‎তিনি সঙ্গীতসাধনা ও সাহিত্যচর্চায় নিজস্ব অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। সঙ্গীত বিষয়ক গবেষণাতেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তিনি বেতার ও টেলিভিশনে সঙ্গীতবিষয়ক অনেক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। পত্র-পত্রিকাতে তিনি একজন সুখপাঠ্য কলাম লেখক হিসেবেও সুপরিচিত।

‎দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ফোক মিউজিক রিসার্চ গ্রুপের পরিচালক ও সংগ্রাহক হিসেবে কয়েক হাজার গান তার সংগ্রহে ছিল। বাংলা লোকসঙ্গীতের মূল্যবান লালনের গান, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা ছিল তার সংগ্রহে। সম্পাদিত ‘দুয়ারে আইসাছে পালকি’ ও স্বাধীনতা দিনের গান’ উল্লেখযোগ্য সংকলন গ্রন্থ। ‘জার্নাল অব ফোক মিউজিকের’র সম্পাদক ছিলেন তিনি। ‘লোকসংগীতের ইতিহাস’, ‘ভাওয়াইয়ার জন্মভূমি’, (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), ‘ভাটির দ্যাশের ভাটিয়ালি’ প্রথম খণ্ডে সর্বমোট ছ’শত গান স্বরলিপি ও বিবক্ষণসহ প্রকাশিত, দেশে বিদেশে প্রশংসিত।

বিজ্ঞাপন

‎ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স ও এমএ, হার্ভার্ড গ্রুপ থেকে মার্কেটিং অধ্যয়ন, দীর্ঘদিন শিল্পগোষ্ঠীর মহাব্যবস্থাপক ছিলেন, ছিলেন ব্যবসা সফল ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবেও নিযুক্ত ছিলেন তিনি। ২৫টি দেশে ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদী, ভাওয়াইয়া, চটকা, নজরুলগীতি পরিবেশন করে খ্যাতি অর্জন করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ও সঙ্গীত পরিবেশন করেন। ইউনেস্কোর ছত্রছায়ায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল কমিটি অব মিউজিকের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন ১১ বছর, একাধিকবার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন সঙ্গীতজ্ঞদের বিশ্ব অধিবেশনে।

বিজ্ঞাপন

‎কবি, লেখক ও গবেষক মুস্তফা জামান আব্বাসীর ২১টি গ্রন্থ পাঠকনন্দিত। জীবনকালে তিনি নানা পদকে ভূষিত হয়েছিলেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, লালন পুরস্কার, নজরুল একাডেমি পুরস্কার, আব্বাসউদ্দিন গোল্ড মেডেল, এ্যাপেক্স ফাউন্ডেশন পুরস্কার, একুশে পদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক পুরস্কার, সিলেট মিউজিক পুরস্কার, মানিক মিয়া পুরস্কার, নাট্যসভা উপস্থাপক পুরস্কার, বাংলা সন চৌদ্দশতবার্ষিকী পুরস্কার ইত্যাদি। এশিয়া মিডিয়া সামিট, আন্তর্জাতিক রুমি কর্মকাণ্ড, আন্তর্জাতিক সুফি সম্মেলন, লোকসংস্কৃতি সেমিনার, রেডিও টেলিভিশনে বক্তব্য ও গানের জলসা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি।

‎মুসলমানের ছেলেমেয়েরা গান শিখবে, গাইবে-এ কথা কেউ ভাবনায়ও আনতেন না। সেই প্রায় নিষিদ্ধ সময়ে মুসলিম পরিবারের সন্তান হয়েও, মুসলিম নাম ধারণ করে আব্বাসউদ্দিন গানের জগতে নাম লেখান এবং কালজয়ী শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তার এই চলে যাওয়া দেশের সংগীত অঙ্গনের এক অপূরণীয় ক্ষতি।

সারাবাংলা/এনএল/ইআ

মুস্তাফা জামান আব্বাসী সংগীতশিল্পী