Monday 12 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজস্ব বোর্ড বিলুপ্তির অধ্যাদেশ
কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন এনবিআর কর্মকর্তারা

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১২ মে ২০২৫ ০০:০৯ | আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ০০:১৬

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: দেশের রাজস্ব আয় বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংস্কারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটিকে দুই ভাগ করার উদ্যোগ নিয়েছে অর্ন্তবর্তী সরকার। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। এনবিআর বিলুপ্তিকরণের এই উদ্যোগে ক্ষুদ্ধ প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে কাস্টমস ও ট্যাক্স ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দুই সংগঠনের পক্ষ থেকে এই খসড়া বাতিলের দাবি জানানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এনবিআর বিলুপ্তকরণের খসড়া অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্যাক্স লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ঢাকা ট্যাকসেস বার অ্যাসোসিয়েশনও। তবে অনেকটা গোপনীয়তার মধ্যেই খসড়াটি সোমবার (১২ মে) অধ্যাদেশ আকারে জারি হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে কোনো ধরণের আলোচনা ছাড়াই এই অধ্যাদেশ গেজেট আকারে জারি হলে বৃহত্তর কর্মবিরতি ও গণইস্তফার ইঙ্গিত দিয়েছেন আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

গেল কয়েকদিন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভবনে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এনবিআর বিলুপ্তকরণের উদ্যোগে তারা অস্তিত্ব সংকটে রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছে উৎকণ্ঠায়। চাপা ক্ষোভ আর অভিমান তাদের চোখেমুখে। কেউ কেউ এনবিআরের চাকরি ছাড়তে চান। প্রতিষ্ঠানটির দুই ক্যাডারের একটি যৌথ জরিপে দেখা গেছে, খসড়া অধ্যাদেশ বাতিলের পক্ষে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির সব ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

সোমবার খসড়া অধ্যাদেশ গেজেট আকারে জারি হতে পারে এমন গুঞ্জন এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআর কর্মকর্তারা সারাবাংলার এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘বর্তমান বাস্তবতায় এটা ক্যাডার সার্ভিসের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা ছাড়াই এই অধ্যাদেশের গেজেট জারি করা হলে প্রয়োজনে কর্মবিরতি ও গণইস্তফার ঘোষণা আসতে পারে।’

সরকারের কাছে প্রস্তাব তুলে ধরতে এনবিআর কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির কয়েকজন সদস্যও কমিটি থেকে পদত্যাগ করবেন বলে গুঞ্জনও রয়েছে। এনবিআর বিলুপ্ত হলে বেশকিছু কর্মকর্তাও এনবিআর ছাড়তে চান। জানা গেছে, রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ থাকলেও খসড়া অধ্যাদেশ অনুমোদনের পর থেকে রাজস্ব আদায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। অস্তিত্ব সংকটে থাকায় কাজে মনযোগ দিতে পারছেন না অনেক কর্মকর্তা। বাজেট প্রণয়নেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কর আইনজীবী ফোরামের প্রধান উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আহমেদ আযম খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এনবিআর বিলুপ্তকরণে কী ধরণের ক্ষতি হবে, রাজস্বে কী বিশাল অংকের ক্ষতি হবে- পুরো বিষয়টিই কিন্তু আলোচনার অপেক্ষা রাখে। আমি মনে করি, এই বিষয়টি ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্রের অর্থ সংগ্রহের মূল জায়গাটি হলো এনবিআর। কাজেই এনবিআরের কোনো পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন, কোনো ভাঙন কিংবা পুনর্গঠন, যেকোনো কিছুর সংস্কারই ব্যাপক আলাপ আলোচনার দাবি রাখে।’

তিনি বলেন, ‘রাজস্ব কর্মকর্তার এখন অস্তিত্ব সংকটে পড়েছেন। গেল দুই মাস ধরে রাজস্ব আহরণের গতি স্লথ। আগামী বাজেটেও এর প্রভাব পড়তে পারে। কাউকে কিছু না বলে তড়িঘড়ি এই সংস্কারে জাতি অন্ধকারে আছে। সেইসঙ্গে এটা নিয়ে তৈরি হয়েছে ও ধোঁয়াশা। এই অধ্যাদেশ পাস করে বাস্তবায়ন করলে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ধ্বস নামতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় বাজেটের অভ্যন্তরীণ উৎসের প্রায় পুরো টাকাই আদায় করে এনবিআর। এই এনবিআর সংস্কার কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এতে কী লাভ হবে, কী ক্ষতি হবে, কর্মকর্তাদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে কি না- তা আলোচনার দাবি রাখে।’ তার মতে, এনবিআর সংস্কারের বিষয়টি সরকার তালিকাভুক্ত করে রেখে যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে জাতীয় সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এনবিআর বিলুপ্তকরণ কিংবা সংস্কারের উদ্যোগ নেবে। কোনো দেশ কিংবা কারও পরামর্শে দ্রুত এনবিআর সংস্কার করা ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য তার।

প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৯ অক্টোবর এনবিআর সংস্কারে পাঁচ সদস্যের পরামর্শক কমিটি গঠন করে সরকার। এই কমিটির সবাই এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তা। সদস্যদের মধ্যে দু’জন সাবেক চেয়ারম্যান। তারা হলেন- ড. মো. আবদুল মজিদ ও ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ। বাকি তিনজন সাবেক সদস্য। তারা হলেন- মো. দেলোয়ার হোসেন (আয়কর), ফরিদ উদ্দিন (কাস্টমস) ও আমিনুর রহমান (আয়কর)। দেশে বিভিন্ন সংস্কার কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশে কোনো গোপনীয়তা না থাকলেও এই কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশে শুরু থেকেই ছিল গোপনীয়তা। অভিযোগ আছে, এই কমিটি সরকারের কাছে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল, খসড়া অধ্যাদেশে তার তেমন কিছুই রাখা হয়নি। কমিটির দুই সদস্যও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

অভিযোগ রয়েছে, অধ্যাদেশের খসড়ায় প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের খুশি করতে দু’টি বিভাগের সচিব তাদের মধ্য থেকেই করার প্রস্তাব এসেছে। এতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে আরও দু’জন সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া সুযোগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, রাজস্ব খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকার পরও কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।

এছাড়া, রাজস্ব নীতি বিভাগের মৌলিক পদগুলো আয়কর, কাস্টমস, ভ্যাট, অর্থনীতি, ব্যবসায় প্রশাসন, গবেষণা, পরিসংখ্যান, প্রশাসন, অডিট, আইন সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে পূরণের বিধান রাখা হয়েছে। মৌলিক পদগুলোতে বর্তমানে দায়িত্ব পালনরত রাজস্ব আহরণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতি প্রণয়নে বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের রাজস্ব নীতি বিভাগে সুনির্দিষ্টভাবে পদায়নের সুযোগও রাখা হয়নি। এ বিভাগে জনবল পদায়নে সুপারিশের জন্য কমিটি গঠনের কথা থাকলেও খসড়ায় কমিটির উল্লেখ নেই। রাজস্ব নীতির কার্যপরিধিতে কর আইন প্রয়োগ ও কর আহরণ পরিস্থিতি পরিবীক্ষণ যুক্ত করা হয়েছে। যা আইনের দৃষ্টিতেও সাংঘর্ষিক।

সংস্কারের অংশ হিসেবে উন্নত বিশ্বের আদলে ২০০৯ সালের দিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজকে ভেঙে দু’জন কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিল সরকার। আমদানিসংক্রান্ত বিষয়ের একজন এবং রফতানিসংক্রান্ত বিষয়ে আরেকজন কমিশনার। তবে এই পদ্ধতি বুমেরাং হওয়ায় ফের আগের ধাঁচে ফিরতে চায় সরকার।

এরআগে ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়কর সরকারের আমলে এনবিআরের নীতি ও প্রশাসন বিভাগ আলাদা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকের চাপ ছিল। ২০০৯ সালে সংসদে অনুমোদন দেওয়া হলেও এনবিআর সংস্কার হয়নি।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

অধ্যাদেশ অনুমোদন এনবিআর কর্মবিরতি খসড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দাবি বাতিল সংস্কার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর