ঢাকা: আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গত জুলাই-আগস্টে দেশের সর্বস্তরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের বুলেটও তাদের স্তব্ধ করতে পারেনি, বরং তা গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়। সরকার পতনের সেই সংগ্রামে দেড় হাজারের বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। আহত হন আরও কয়েক হাজার। জীবনবাজি রাখা সেই যোদ্ধারা আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের যাত্রী।
সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে অনেকেই চিরতরে চোখের আলো হারিয়ে অন্ধ হয়ে গেছেন, আবার বহুজন হারিয়েছেন হাত, পা কিংবা অন্য কোনো অঙ্গ। যার কাঁধে ছিল পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব, তার অঙ্গহানি যেন গোটা পরিবারের জন্য এক নিদারুণ অভিশাপ। আহত এই বীর যোদ্ধাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরা এখন অনিশ্চিত। মাসের পর মাস হাসপাতালের শয্যায় যন্ত্রণা সহ্য করতে-করতে তারা এখন মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত।
সরেজমিনে হাসপাতালে খোঁজখবর নিতে গেলে আহতরা অভিযোগ করে সারাবাংলাকে বলেন, প্রথমদিকে তাদের বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য সহযোগিতা করা হলেও এখন তা করা হচ্ছে না। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে একবার কিছু টাকা পেলেও পরে আর সেখান থেকে তারা সহায়তা পাননি। এমনকি, প্রথমদিকে রাজনৈতিক দলগুলো খোঁজখবরও নিলেও এখন আর নিচ্ছে না।
আহতরা বেশিরভাগই সুস্থ্য হলেও তারা হাসপাতাল ছাড়ছে না- এমন অভিযোগ উঠলে সরেজমিনে দেখা যায়, অনেক আহতরা এখনো হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন। কারো কারো সম্প্রতি ক্ষতস্থানে অপারেশন করা হয়েছে, আবার কাউকে অপারেশনের জন্য শিডিউল দিয়ে রাখা হয়েছে। আর ১১ জন আহতকে ১ থেকে ২ মাসের মধ্যে বিদেশে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত হলেও এখনো পাঠানো হচ্ছে না। কিছু রোগীর অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে রয়েছে যে তারা বাড়িতে গিয়েও চিকিৎসা নিতে পারে। তবে বাড়ি দূরে হওয়ায় হাসপাতালে যাতায়াতে সমস্যা এবং বাড়িতে গিয়ে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ার শঙ্কাও কাজ করছে তাদের মধ্যে। অনেকে আবার পরিবারের একমাত্র উপার্যনক্ষম হওয়ায় বাড়িতে গিয়ে চলার মতো অবস্থা নাই।
জুলাই আন্দোলনে গুলিতে আহত মাসুদ শেখ সারাবাংলাকে বলেন, আমার মেয়ে কলেজে পড়ে। তার সঙ্গে আমি বাড্ডায় আন্দোলনে যাই। ১৮ জুলাই আমার পায়ে গুলি করে বিজিবি। আমার বন্ধুকে আমারই পাশে বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে মেরে ফেলে। তিন ছেলে-মেয়ে নিয়ে দিন যাপন করতে আমার কষ্ট হচ্ছে। বাহিরে চিকিৎসা করাতে আমার ৭-৮ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বাড়ি বন্ধক রেখে আমি চিকিৎসার টাকা সংগ্রহ করি। সরকার থেকে কিছু সুবিধা দিচ্ছে, তবে সেটা অনেক দেরি করে তারা দেয়। আমি ৯ মাস ধরে হাসপাতালে আছি, এছাড়া বাসায়ও ছিলাম। গুলি লেগে আমার এক পা ৩ ইঞ্চি ছোট হয়ে গেছে। চিকিৎসক বলেছেন এটা আর ঠিক হবে না। আমার যে অবস্থা তাতে তো আমি আর কোনোদিন কাজ করতে পারবো না। সরকারের পক্ষ থেকে আমার চলার ব্যবস্থা করে না দিলে আমি সন্তানদের নিয়ে চলতে পারবো না।
আহত এমরান সরদার সারাবাংলাকে বলেন, ৫ আগস্ট সাভারে পুলিশের লাঠিচার্জ এবং আওয়ামী লীগের অস্ত্রের আঘাতে আহত হই। এই হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম তারপর চলে গিয়েছিলাম। অবস্থা খারাপ হওয়ায় আবার আসছি। চিকিৎসক বলেছে আমার অপারেশন করা লাগবে এবং আমার হাত ও পা আগে যেমন ছিল সেরকম হয়তো পুরোপুরি ঠিক হবে না।
অভ্যুত্থানে আহত শামিম সারাবাংলাকে বলেন, ৫ আগস্ট আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে এসে দুইবার সিট চাইলে জানায় তাদের সিট খালি নাই। ঢাকা মেডিকেল ঘুরে বাড়িতে বিভিন্ন জায়গায় গেলাম। পরে বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে দুই লাখ টাকা খরচ করেছি। আবার পঙ্গু হাসপাতালে এলে বলে সিট নাই, পরে সিএমএইচ এ গেলাম। সেখানে দুই মাস আমাকে রাখে চিকিৎসা করানো হয়। সেসময় আমার হাড় জোড়া লেগে গেছিল। পরে ওই হাসপাতাল থেকে আমাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখন আমার হাড় আবার সরে গিয়েছে। চিকিৎসক বলেছে আবার অপারেশন করতে হবে। আমি কি তাহলে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবো না?
জুলাই আন্দোলনে গুলিতে আহত শিশু আফসার হোসেনের মা সারাবাংলাকে বলেন, আমার ১২ বছরের ছেলে উত্তরায় আজমপুরে আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়। প্রায় ৮ মাস হাসপাতালে আছি। কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাই নাই। আমাদের বাড়ি নোয়াখালী। আমার পাঁচ ছেলে মেয়ের মধ্যে সে বড়। অভাবি সংসার চালানোর মত কেউ নাই, তার দেখভাল কেমনে করবো। সরকার বা কারো থেকেই কোনো আর্থিক সহযোগিতা পাই নাই।
সাতক্ষীরায় আহত আলী আহসান সারাবাংলাকে বলেন, আমার বাড়ি সাতক্ষীরা। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুপুরে বিজয় মিছিল নিয়ে আমরা যখন আসি তখন আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন সভাপতির বাড়ির ছাদ থেকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের দোসররা বৃষ্টির মতো গুলি করে। সেদিন তিনজনই গুলি লেগে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। তখন আমি গুলিবিদ্ধ হলে আমাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে খুলনার হাসপাতাল হয়ে ৭ আগস্ট এই হাসপাতালে ভর্তি হই। পরদিন চারটা অপারেশন করা হয়। পা ঠিক না হলে ১৭ আগস্ট আমার পা কেটে ফেলা হয়। ১৫ দিন পর আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দিলে বাসায় যাই। একমাস থেকে তারপর আবার হাসপাতালে আসি। তখন থেকে এ পর্যন্ত হাসাপালে আছি। আরও একটা অপারেশন করতে হবে। আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম। পরিবারে বাবা-মা, ছোট একটি বোন এবং দাদী আছে। আন্দোলন শেষ হওয়ার প্রথম দিকে কিছু লোক সাহায্য করেছিল, আর জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে যেটা দিয়েছিল সেটা ছাড়া আর কিছু পাই নাই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের বিশেষ সেলে আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিতকরণ ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসন বিষয়ক দলের সদস্য তাহমিনা আক্তার মিম সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমানে ১১৬০ জন পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পুরোপুরি সুস্থ আছে ৫-৭ জন এবং বাড়ি ফিরে গিয়ে চিকিৎসা নিলেও চলবে এরকম রয়েছে ৭০ ভাগ। কিন্তু তাদের বাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় তারা যাচ্ছে না। দূরত্বে যাতায়াত তাদের জন্য কষ্টসাধ্য, আর এখানে বসে তারা নিয়মিত ফিজিওথেরাপি দিতে পারছে এটাও একটা কারণ। সবাই পুরোপুরি সুস্থ হতে এখনো অনেক সময় লাগবে। আহত যারা হাসপাতালে ভর্তি আছে তাদেরকে অন্যান্য সাধারণ রোগীদের থেকে ভালো ও আলাদা খাবার দেওয়া হয়।
জুলাই-আগস্ট আহতদের বর্তমান অবস্থা ও চিকিৎসা নিয়ে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কেনান সারাবাংলাকে বলেন, যারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে তাদের অবস্থা এখন স্থিতিশীল। অনেকেই আছেন তাদের হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়। আউটডোর বা বহিঃবিভাগ ভিত্তিতে তারা এসে চিকিৎসা নিতে পারবেন। তারা হয়তো মনে করতেছে এখান থেকে চলে গেলে চিকিৎসা ঠিক মতো পাবে কিনা, আমাদের অন্যান্য দাবি পূরণ হবে কিনা। তারা এসব হয় তো মনে করে থাকতে পারে, সেজন্য যাচ্ছে না। তবে আমরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করায় কিছু কিছু আহতরা হাসপাতাল ছাড়ছে।