Wednesday 11 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব, কমছে ভর্তুকি, প্রত্যাহার হচ্ছে কর অব্যাহতি সুবিধা

সোহেল রহমান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৭ মে ২০২৫ ১৯:২৮ | আপডেট: ১৭ মে ২০২৫ ১৯:৩৪

ঢাকা: দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি বেগবান করা, কর্ম সংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করা- ইত্যাদি বিষয়কে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে আসন্ন বাজেট প্রণয়ন করছে অন্তর্বর্তী সরকার।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ২ জুন টেলিভিশনে বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ।

বিভিন্ন সময়ে বাজেট প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অর্থ উপদষ্টা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রথম অগ্রাধিকার দিয়ে বাজেট করা হচ্ছে। এজন্য কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা ও ভাতার পরিমাণ বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয় ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরিতে নজর থাকবে।’

বিজ্ঞাপন

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সার্বিকভাবে আর্থসামাজিকভাবে বৈষম্য কমানোর যে তাড়না থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূত্রপাত হয়েছিল, তা পূরণের উদ্যোগ থাকবে বাজেটে। এছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার, পদক্ষেপ ও কর্মকাণ্ডের ওপর বাজেটে জোর দেওয়া হচ্ছে।

সূত্র মতে, এবারের বাজেটের একটি বড় উদ্বেগের বিষয় ছিল চাহিদা অনুযায়ী অর্থের সংস্থান। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) কর্তৃক চলমান ঋণের কিস্তি ছাড়ের আশ্বাস এবং সেই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক ও এডিবি’র পক্ষ থেকে বাজেট সহায়তার আশ্বাস পাওয়ায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে টাকার সংস্থান নিয়ে সরকারের দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমেছে।

তবে সার্বিকভাবে বাজেট ঘাটতি কমাতে সরকার আগামী অর্থবছরে ব্যাংক ঋণ নেওয়া কমানোর পরিকল্পনা করেছে। তবে বিদেশি ঋণের সুদহার তুলনামূলক কম হওয়ায় বিদেশি ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়তে পারে। আগামী অর্থবছরের ব্যাংক ঋণের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ কমিয়ে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে। সংশোধিত বাজেটে ব্যাংক ঋণ মূল ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা কমে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা দাঁড়াতে পারে।

সূত্র মতে, রাজস্ব আদায়ের বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এবার প্রথমবারের মত বাজেটের আকার পূর্ববর্তী অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় কমছে। মূলত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ কমিয়ে বাজেটের আকার ছোট করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কমিয়ে আনা হচ্ছে ভর্তুকি। তবে কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা ভর্তুকিতে বরাদ্দের পরিমাণ প্রায় অপরিবর্তিত থাকবে। চলতি অর্থবছরে এ দুটি খাতে ভর্তুকিতে বরাদ্দ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে রাজস্ব বাড়াতে কর অবকাশ বা কর অব্যাহতি সুবিধা প্রদানের নীতি থেকেও সরে আসছে সরকার। বর্তমানে যে আদেশ (এসআরও) দুটির মাধ্যমে এই কর অব্যাহতি প্রদান করা হচ্ছে, সেগুলো পর্যালোচনার আওতায় আনা হয়েছে এবং বাতিল করা হতে পারে। এটি কার্যকর হলে অতিরিক্ত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় সম্ভব হতে পারে।

সূত্র মতে, গ্যাস ও বিদ্যুতে আগামী বাজেটে ভর্তুকি কমবে। এর পরিমাণ হতে পারে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বকেয়া ভর্তুক পরিশোধে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে এ দু্ই খাতে ৬২ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ২০২৬ সালের মধ্যে এ দুই খাতে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনার শর্ত দিয়েছিল আইএমএফ। সেখান থেকে অব্যাহতি পেয়েছে সরকার। তবে এ দুটি খাতে ভর্তুকি সীমিত রাখতে হবে সরকারকে। ফলে আসন্ন বাজেটে গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো না-ও হতে পারে।

এছাড়া ২০২৬ সালের নভেম্বরে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে উত্তরণকে সামনে রেখে রফতানিতে নগদ সহায়তা বাবদ ভর্তুকির পরিমাণও কমছে।

সূত্র মতে, কর অব্যাহতি তুলে নেওয়ার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসন্ন বাজেটে বহুল আলোচিত মৎস্য ও পোল্ট্রি খাতের বিদ্যমান আয়কর সুবিধা বাতিল করা হতে পারে। বর্তমানে এসব খাত থেকে আয় করলে তার ওপর ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রদান করতে হয়। তবে আগামী বাজেটে এনবিআরের নতুন পদক্ষেপের পরে এসব খাতের আয়ের ওপর নিয়মিত হারে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হতে পারে।

সূত্র মতে, এ তালিকায় আসতে পারে হাঁস-মুরগি ও চিংড়ি হ্যাচারির আয়ও। এছাড়া তালিকায় যুক্ত হতে পারে—পোলট্রির পেলেটেড ফিড উৎপাদন, গবাদিপশু, চিংড়ি ও মাছের পেলেটেড ফিড উৎপাদন, বীজ উৎপাদন ও বিপণন, গবাদিপশুর খামার, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের খামার, ব্যাঙ উৎপাদন খামার, হর্টিকালচার, তুঁত চাষ, মৌমাছি চাষ প্রকল্প, রেশম গুটিপোকার খামার, মাশরুম খামার এবং ফ্লোরিকালচারের আয়।

পাশাপাশি আগামী বাজেটে কোম্পানির টার্নওভারে বাধ্যতামূলক ন্যূনতম কর বিদ্যমান ০.৬ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হতে পারে। অন্যদিকে ব্যক্তি করদাতার ন্যূনতম কর চারগুণ বাড়তে পারে। ইনডিভিজুয়াল এসেসি’র টার্নওভার ট্যাক্স বেড়ে ১ শতাংশ হতে পারে, যা বর্তমানে ০.২৫ শতাংশ রয়েছে।

মূলত কর ফাঁকি বন্ধ করতে রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতার অভাব এবং রাজস্ব আদায় বাড়াতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের কারণে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে কারো কারো অভিমত।

সূত্র মতে, এবারের বাজেট হবে বিনিয়োগবান্ধব। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বাজেটে নতুন নতুন উদ্যোগ যুক্ত করা হচ্ছে। এজন্য ব্যবসার পরিবেশ সহজীকরণ এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের ঝূঁকি মোকাবিলায় বাজেটে ব্যবসা ও বিনিয়োগসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আইন-কানুন সহজীকরণের ঘোষণা থাকতে পারে। প্রস্তাবিত সংস্কারের লক্ষ্য হচ্ছে- কর প্রশাসন সহজ করা, স্বচ্ছতা আনা এবং বিনিয়োগ ও ব্যবসার উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা। এতে লেনদেন, কর ও শুল্ক-সংক্রান্ত দীর্ঘস্থায়ী জটিলতা দূর করা এবং নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

সূত্র মতে, প্রস্তাবিত সংস্কারের মধ্যে রয়েছে- ব্যবসায়ীদের জন্য নগদ লেনদেনের সীমা শিথিল করা এবং আটটি পর্যন্ত নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ট্যাক্স রিটার্ন (পিএসআর) জমা দেওয়ার প্রমাণ দাখিলের বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়া।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হচ্ছে- আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য নির্ধারণে কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিবেচনাধিকার সীমিত করা। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে আমদানিকারকের ঘোষিত মূল্যই গ্রহণ করতে হবে, ফলে ‘স্বেচ্ছাচারী মূল্যায়ন’-এর অভিযোগ করা থেকে মুক্তি পাবে ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছিলেন।

কর ব্যবস্থার বোঝা কিছুটা কমাতে আরেকটি প্রস্তাবনা হচ্ছে, ন্যূনতম করের আওতায় জমা দেওয়া অতিরিক্ত অর্থ ভবিষ্যতের কর সমন্বয়ে ব্যবহার করার সুযোগ রাখা। এতে ব্যবসা কম মুনাফায় চললে আগের বেশি করের টাকা পরবর্তীকালে অফসেট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

সারাবাংলা/আরএস

আসন্ন বাজেট ২০২৫-২৬

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর