ঢাকা: দল ভারী করতে আওয়ামী নেতা-কর্মীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে বিএনপি। আওয়ামী লীগের কারা কারা বিএনপিতে যোগ দিতে পারবে— এটা নিয়ে অব্যহাতভাবে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন বিএনপি নেতারা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ হারানো আওয়ামী লীগ নেতারা অন্য দলে ভেড়ার আগেই নিজেদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। এ নিয়ে দলটির মধ্যম সারির নেতা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
ঘটনা সূত্রপাত ৮ মে। ওই দিন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, “যারা দীর্ঘদিন রাজনীতি করেননি অথবা আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের আমলের আগেই দল থেকে চলে গেছেন এবং আওয়ামী লীগের দুঃশাসন, লুটপাট, টাকা পাচারের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, তারা বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দিতে পারবেন।’’
তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাচ্ছি, সমাজের যারা সজ্জন মানুষ, একদম ভদ্র মানুষ, যারা হয়ত অবসরে গেছেন, অন্তরে জাতীয়তাবাদ রাজনীতি লালন করতেন, তিনি একজন শিক্ষক হতে পারেন, ব্যাংকার হতে পারেন, সরকারি কর্মকর্তা হতে পারেন, এনজিও কর্মকর্তা হতে পারেন, কৃষক ও শ্রমিক হতে পারেন, তারাও প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন। এক্ষেত্রে বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী মানুষরাই বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন।’
এক কোটির বেশি সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করে ১৫ মে থেকে সদস্য পদ নবায়ন এবং নতুন সদস্য সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করে বিএনপি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বিএনপি নেতারা বিপদগ্রস্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের জন্য একটা সুযোগ দিতে চান। এতে করে চাপে থাকা আওয়ামী নেতা-কর্মীরা এনসিপি বা জামায়াতে না ভিড়ে বিএনপিতে ভিড়তে পারবেন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এ রকম চিন্তা-ভাবনা থেকেই বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী শনিবার (১৭ মে) চট্টগ্রামে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দোসররা বিএনপির সদস্য হতে পারবেন না। তবে, একজন ভালো লোক, আওয়ামী লীগের চিহ্নিত দোসর নন, হয়তো আওয়ামী লীগকে সমর্থন করতে পারেন, আমরা জানি না। তিনি কাকে ভোট দিয়েছেন, সেটও জানি না। কিন্তু সমাজে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি, কখনো রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করেননি। বিএনপির কার্যক্রমকে প্রতিহত কিংবা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেননি। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করেননি, পারলে পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। তাদের সদস্য করতে বাধা নেই।’’
আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীর এই বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের কৌতুহলের জন্ম দেয়! কী কী শর্ত পূরণ করলে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপিতে যোগ দিতে পারবেন, সে ব্যাপারে একটা পরিষ্কার নির্দেশনা বা ঘোষণা দিয়ে দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন কেউ কেউ।
কবির য়াহমদ নামে এক ব্যক্তি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের কারা বিএনপিতে যেতে পারবে— এটা নিয়ে একটা আলোচনা শুরু করছেন নেতারা। অর্থাৎ যোগ্যতা বিষয়ক একটা সিলেবাস প্রণয়নে ব্যস্ত তারা। অথচ দেয়ালে কান লাগিয়ে শুনুন— আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা দিন শুরু করে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে। ঘুমুতে যায় স্বপ্নকে সঙ্গী করে। স্বপ্ন আর বাস্তবতার দূরত্ব কতটুকু— এটা ভাবছে না এখনো তারা। এটা কেবলই আওয়ামী লীগের জন্যে প্রযোজ্য তা না, সকল দলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। এদের কেউ কেউ দলবদল যদিও করে, তবে প্রাসঙ্গিক হবে সিনেমার সেই সংলাপ—‘আমার দেহ পাবি, মন পাবি না’।’’
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, দলের মধ্যম সারির নেতা এবং মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। তারা বলছেন, বিএনপি গণমানুষের দল। এ দলের কোটি কোটি কর্মী-সমর্থক আছে। এই কর্মী-সমর্থকরাই দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করে বিএনপির রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। দল ভারী করার জন্য ক্ষমতাচ্যুৎ আওয়ামী লীগ বা অন্য দল থেকে সুবিধাবাদীদের বিএনপিতে ঢোকানোর প্রয়োজন নেই।’’
অনেকেই বলছেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী আওয়ামী সমর্থকদের বিএনপি করার সুযোগ দিতে ‘‘যেসব আওয়ামী নেত-কর্মী, সমর্থকেরা কখনো রাজনৈতিকভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করেননি। বিএনপির কার্যক্রমকে প্রতিহত কিংবা বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেননি। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি করেননি’’— শর্তগুলো জুড়ে দিলেও জুলাই আন্দোলনে হামলাকারী, ইন্ধনদাতা ও হামলার সমর্থনকারীদে ব্যাপারে কিছুই উল্লেখ করেননি। সুতরাং এখানে বড় ধরনের একটা ফাঁক-ফোকর রয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘‘অতিকথন সব সময়-ই খারাপ। বিএনপি এখন এমন অবস্থায় নেই যে, ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করে হলেও আওয়ামী সমর্থকদের ডেকে ডেকে দলে ভেড়াতে হবে। বিএনপির জন্য কোটি কোটি মানুষ কাজ করেছে, তারাই বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হবে, নেতা হবে, নেতৃত্ব দেবে।’’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সারাবাংলাকে বলেন, ‘‘কারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবে, সে সম্পর্কে আমাদের গঠনতন্ত্রে স্পষ্টভাবে বলা আছে। যারা বাংলাদেশি জাতীয়তবাদে বিশ্বাস, যারা শহিদ জিয়ার দর্শনকে ওউন করে, যারা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যারা সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত না, তারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন।’’
‘‘আমার বিশ্বাস, এ কথাগুলোই দায়িত্বশীল নেতারা তাদের ভাষণ-বক্তৃতায় বলছেন। হয়তবা বলার ধরনটা স্থান-কাল-পাত্র এবং পরিবেশভেধে একটু এদিক ওদিক হচ্ছে। এটাকে মেজর ইস্যু বানিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া সমীচীন নয় বলে আমি মনে করি’’— বলেন গয়েশ্বর চন্দ্র রায়।