বেলজিয়াম: ৩ মে সারাবিশ্বে পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব মুক্ত গণ্যমাধ্যম দিবস’। ২০২৫ সালে এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সাহসী নতুন বিশ্বে রিপোর্টিং-স্বাধীন গণমাধ্যমে এআই এর প্রভাব’। প্রতিবছর দিবসটিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আয়োজন থাকে ইউনেস্কোর। এবারও প্রতিপাদ্যের সঙ্গে মিল রেখে আয়োজন করা হয়েছিল পাঁচ দিনব্যাপী সেমিনার। যেখানে সারাবিশ্ব থেকে মেধাবী ও যোদ্ধা সাংবাদিক এবং মানবাধিকার সংগঠনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিরা অংশ নেন। বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে উঠে এসেছে সাংবাদিকদের সাফল্য, প্রতিবন্ধকতা ও ভবিষ্যত পরিকল্পনাসংক্রান্ত নানাদিক। পাঁচ দিনব্যাপী এই আয়োজনে ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে অংশ নিয়েছিলেন সারাবাংলার এই স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।
৫ মে ব্রাসেলস কানাডিয়ান অ্যাম্বাসিতে সাউথ এশিয়া আর্টিকেল ১৯-এর সহযোগিতায় ইউনেস্কোর উদ্যোগে আয়োজন করা হয় বিশ্বে নারী সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে এক আলোচনাসভা। যেখানে সাহসী সাংবাদিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তিন নারী সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা জানতে চাওয়া হয়। সেইসঙ্গে, নারী সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরা হয়। আয়োজনে বাংলাদেশ ছাড়াও ব্রাজিল থেকে অংশ নেন ফাভেলার কমুনিকেট রিপোর্টার গিজেল মার্টিন্স ও ক্রোয়েশিয়ার ফ্যাক্টোগ্রাফের সিইও আনা ব্রাকাস।
ইউনেস্কো সেমিনারে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেওয়া সারাবাংলার এই স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (ফারহানা নীলা) সাংবাদিকতায় জেন্ডার-সমতা ইস্যু নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকতায় জেন্ডার ইস্যু একটি ফ্যাক্ট। বাংলাদেশের মিডিয়ায় বিষয়টি এখনো প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। নিউজরুমে বড় পদগুলোতে নারী সাংবাদিকদের সংখ্যা খুবই কম। এমনকি একজন পুরুষ সাংবাদিকের চেয়ে নারী সাংবাদিকের বেতনও কম। এছাড়া, কোনো কারণে কর্মী কমাতে হলে, শুরুতেই টার্গেট হয় নারী। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানেই ছাঁটাই প্রক্রিয়া চলছিল। সেই পরিস্থিতিতে চাকরিচ্যুত হন প্রায় ২০০ নারী সাংবাদিক। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠে মিডিয়া ফের ব্যবসা সফল হলেও ওই ২০০ নারীর অনেকেই কিন্তু তাদের চাকরি ফিরে পাননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কর্মস্থলে ঊর্ধ্বতনদের দ্বারা যৌন হয়রানির ঘটনাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এমন অনেক নারী সাংবাদিক আছেন যারা যৌন হয়রানি থেকে বাঁচতে নীরবে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। আর যেসব নারী সাংবাদিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তারা বিচার পাওয়া তো দূরে কথা উল্টো চাকরি হারাতে হয়েছে। এমনকি ওই প্রতিবাদী নারী সাংবাদিকদের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে আর চাকরিও হয়নি।’

বেলজিয়ামে ইউনেস্কো আয়োজিত সেমিনারে কথা বলছেন সারাবাংলার স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ফারহানা নীলা। ছবি: সংগৃহীত
সেমিনারে কমিউনিটি রিপোর্টিং ও নারীদের হুমকি নিয়ে বক্তব্য দেন ব্রাজিলের সাংবাদিক গিজেল মার্টিন্স। তিনি বলেন, ‘আমার আলোচনার বিষয় হলো আবাসন সমস্যা, যা আমাদের সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত সমস্যা। এই দরিদ্র, কৃষ্ণাঙ্গ, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে আবাসনের অধিকার কখনো দেওয়া হয়নি। আমার আরেকটি আলোচনার বিষয় হলো জননিরাপত্তার প্রশ্ন। পুলিশ নিয়মিতভাবে ফাভেলাগুলোতে বসবাসকারী এবং কর্মরতদের ওপর আক্রমণ করে। এখানকার নারী সাংবাদিকরা নিয়মিতভাবে যৌন হয়রানি ও মানসিকতার মুখোমুখি হন। কিন্ত রাষ্ট্র এই এলাকার সহিংসতা বন্ধে এবং সেখানে কর্মরত তৃণমূল সম্প্রদায় ও নারী সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। গত ১০ বছরে এই পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।’
সেমিনারে অনলাইন হ্যারেজমেন্ট নিয়ে কথা বলেন ক্রোয়েশিয়ার ফ্যাক্টোগ্রাফ’র সিইও আনা ব্রাকাস। তিনি জানান, ফ্যাক্টোগ্রাফ মূলত ফ্যাক্ট চ্যাকিং ইস্যুগুলো তুলে ধরে। ২০২৩ সালে ফ্যাক্টোগ্রাফ অনলাইন হয়রানির ওপর একটি গবেষণা করে। যেখানে উঠে এসেছে, শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকাই নয়, সারাবিশ্বে সবচেয়ে বেশি অনলাইনে হয়রানির শিকার হন নারী সাংবাদিকরা। তাদের নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়। কিংবা তাদের ব্যাঙ্গাত্মকভাবে প্রচার করা হয়। এছাড়া, অনলাইনে হুমকিও দেওয়া হয়। পুলিশের কাছে রিপোর্ট বা মামলা পর্যন্ত যাতে না পৌঁছায়, সেজন্য অনলাইনে হয়রানি থেকে শুরু করে ভয় দেখানো ও বিপজ্জনক হুমকিগুলো চলমান থাকে।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশি অ্যাডভোকেসি সংস্থা ভয়েসের উপ-পরিচালক মুশারাত মাহেরা বলেন, ‘আমারা নারী সাংবাদিকদের ওপর একটি গবেষণা করেছি। আমরা দেখেছি যে, প্রাতিষ্ঠানিক ও পদ্ধতিগতভাবেই আমাদের নারী সাংবাদিকরা বৈষম্যের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে হয়রানি- এই বিষয়টিতো আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে তাদের অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা। যেমন: প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিশুদিবাযত্নকেন্দ্র নেই। একজন মা ছয় মাসের শিশুকে বাসায় রেখে কীভাবে ৮-১২ ঘণ্টা কাজ করতে পারে। আবার মাতৃত্বকালীন ছুটিও অনেক সময় থাকে না। মাতৃত্বকালীন ছুটিতে গেলেও অনেক সময় চাকরিও হারাতে হয় নারীদের। আর কর্মক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হন, এমন সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু সবাই মুখ খুলতে চান না। সংসার ও পরিবারের কারণে নারীরা নীরবে চাকরি ছেড়ে দেন। সামাজিকতা ও ধর্মান্ধতার কারণেও তারা চুপ থাকেন।’
সেমিনারে অন্যান্য বক্তাদের মধ্য থেকে উঠে আসে যে, মেধা, দক্ষতা ও নিজস্ব কৌশল দ্বারাই নারী সাংবাদিকদের নিজেকে নিরাপদ রাখতে হবে। নীরবে সয়ে যাওয়া কিংবা চাকরি ছেড়ে দেওয়া কোনো সমাধান নয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে হবে। আর সেইসঙ্গে মানবাধিকার, নারী অধিকার ও সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।