ঢাকা: ‘কেবল নয় ফলাফলমুখী শিক্ষা, বিকশিত হোক মানবতার দীক্ষা’ শ্লোগানকে সামনে রেখে দেশের শিক্ষা বিভাগের রথি মহারথীদের এক মঞ্চে এনেছেন নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা। শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণে বিকশিত করে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার প্রত্যয়ে এক অভূতপূর্ব মিলনমেলার সাক্ষী হলো নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ জেলার শিক্ষার উন্নয়নে এই সভাকে এক যুগান্তকারী প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। এই অনন্য আয়োজনে দেশের শিক্ষা খাতের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের শীর্ষ কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, প্রতিষ্ঠান প্রধান, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের এক শিক্ষাবান্ধব প্ল্যাটফর্মে একত্রিত করেছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগে ‘শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা’ শীর্ষক এই সভাটি ছিল দেশের শিক্ষা খাতের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের একত্রিত করার অনন্য প্রয়াস। জেলার প্রশাসক জাহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে এই সম্মেলন হয়ে উঠেছিল এক শিক্ষাবান্ধব প্ল্যাটফর্ম।
শিক্ষা উপদেষ্টাসহ সরকারের দুই জন গুরুত্বপূর্ণ সচিবকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেখা গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আবরার প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জ জেলার প্রখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা, অভিভাবকরা এবং বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী।
সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে এই অনুষ্ঠান রূপ নেয় এক মহাসমাবেশে, যেখানে সকলের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয় এক অভিন্ন অঙ্গীকার— ‘কেবল নয় ফলাফলমুখী শিক্ষা, বিকশিত হোক মানবতার দীক্ষা।’
এই আয়োজন নারায়ণগঞ্জে শিক্ষা খাতের সমন্বিত ও নৈতিক উন্নয়নের নতুন পথচলার দিগন্ত উন্মোচন করেছে। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিয়ার মহতী উদ্যোগ শুধু প্রশাসনিক দক্ষতার নয়, বরং মানবিক নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে থাকবে বলে জানিয়েছেন উপস্থিত সবাই।
অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে আমাদের তরুণ সমাজ। তারা আমাদেরকে নাগরিক হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। আমাদের যে নাগরিক অধিকার সেটা পুনপ্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে এই তরুণ সমাজ। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম জীবদ্দশায় প্রজা হিসেবেই মৃত্যু হবে। কিন্তু আবার নতুন করে নাগরিক হিসেবে বাঁচার সুযোগ পেয়েছি সেটা তরুণ প্রজন্ম এবং শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের কারণে হয়েছে। সে কারণে আমরা দায়বদ্ধ।’
শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার তার বক্ততায় বলেন, ‘সয়লাব হয়ে যায় এ প্লাস এবং গোল্ডেন জিপিএ ইত্যাদি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ৯০ ভাগ ফেল করে। এমনভাবে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে ছাত্র যে মার্ক অর্জন করেছে তাই পাবে। রাষ্ট্র তাকে খয়রাতি কোনো মার্ক দিবে না। আমরা এই সস্তা জনপ্রিয়তা নেওয়ার জন্য সেটা করবো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষক যে সম্মানের দাবিদার যে মর্যাদার দাবীদার সেটাকে আমরা নিশ্চিত করবো। অনেক সময় পেনশন পেতে ঘুরতে হয় সেগুলো আমরা দেখবো। আপনারা যেন মর্যাদার সঙ্গে আচরণ করা সেই বিষয়গুলো নিশ্চিত করবো। এগুলো আমাদের দায়িত্ব।’
অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, ‘আমরা সমস্ত স্কুলকে ভালো স্কুলে পরিণত করতে চাই। পাশাপাশি ভালো স্কুলে ভর্তি হতে না পারলে অভিভাবক হতাশ হবেন সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। স্কুলগুলোকে এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই যেন ছাত্ররা স্কুলে যেতে আগ্রহী থাকে। ছাত্ররা যদি স্কুলে না যায় এটা উদ্বেগের বিষয়।’
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব তার বক্ততায় নারায়ণগঞ্জ জেলার শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসুচিতে অংশগ্রহণে তুলনামূলক কম আগ্রহের জন্য অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমার কাছে যখন এই তালিকা আসে, তখন দেখি সেই দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার চেয়েও নারায়ণগঞ্জ জেলার শিক্ষকগন প্রশিক্ষণে কম উপস্থিত।
দেশের বিভিন্ন জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা করে তিনি আরও বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ জেলার রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গরা এতদিন কোন বিষয়ে মনোযগী ছিলেন, আমি বুঝতে পারি না। বিভিন্ন জেলার একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখেছি দুই তিনটি নতুন ভবন নির্মিত হয়েছে। সেখানে নারায়ণগঞ্জ জেলার অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো খুবই দুর্বল ‘
নারায়ণগঞ্জ জেলার শিক্ষার সামগ্রিক মান উন্নয়নে যা যা করার, তিনি সেটা করার আশ্বাস দেন।
কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম স্কুল কলেজের ম্যানেজিং কমিটি গঠন নিয়ে বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, এই সমস্যা সমাধানে আমাদের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা দিতে হবে। ম্যানেজিং কমিটিতে আসলে যে মধু খাওয়ার সুযোগ থাকে, সেটা সরিয়ে দিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ এনটিআরসির হাতে দিয়ে দিতে হবে। আর তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগ জেলা প্রশাসকের হাতে দিয়ে দিন। তাহলে দেখবেন যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানায় দোকান-পাট কিংবা মার্কেট আছে,সেইগুলা ছাড়া অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটিতে আসার মতো আগ্রহী লোকই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তিনি শিক্ষাখাতে উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা জুরুরি বলেও মন্তব্য করেছেন।’
গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শহরের ন্যায় স্কাউটিং কার্যক্রম রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ড. খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গ্রামে স্কুলে ছাত্র থাকার সময় মাথায় করে স্কুলের উন্নয়ন কাজে মাটি এনেছি। কিন্তু বিগত দিনে স্কাউটিংকে রাজনৈতিক কারণে একদম নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। যদিও স্কাউটিংয়ের মূল আদর্শই ছিল সেবা করা।’
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম মিঞা বলেন, ‘‘শিক্ষা মানব সভ্যতার বিকাশের অন্যতম উপাদান হলেও তা আজ সংকুচিত হয়ে পড়েছে কেবল জিপিএ-৫ অর্জন ও চাকরি পাওয়ার মধ্যে। কিন্তু ‘পাস’ করা আর ‘শিক্ষিত’ হওয়া এক কথা নয়। পাসের হার বাড়লেও গুণগত শিক্ষা বাড়ছে না। সন্তান কতটা মানসম্মতভাবে শিক্ষা অর্জন করছে, সে দিকেই এখন অভিভাবকদের নজর নেই— সবাই ব্যস্ত শুধু সার্টিফিকেট অর্জনের পেছনে।’’
জেলা প্রশাসক আরও বলেন, ‘অর্থের বিনিময়ে অর্জিত শিক্ষায় দেশপ্রেম, ভদ্রতা, মানবিকতা ও মূল্যবোধ আজ বিলুপ্তির পথে। তরুণ প্রজন্ম এখন কল্পনার জগতে বসবাস করছে। তারা কাকে অনুসরণ করবে, কাদের আদর্শে নিজের স্বপ্ন গড়বে, সেই পথনির্দেশনাও পাচ্ছে না। বাস্তবতা ও মানবিক গুণাবলি না শেখাতে পারলে এই প্রজন্মকে সঠিক পথে আনা কঠিন হয়ে পড়বে।’
শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা অনেক সময় তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করতে পারছে না। আগ্রহ তৈরি না হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছে আকর্ষণ হারাচ্ছে। এর ফলেই আমরা পরীক্ষা-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে হতাশা, মানসিক চাপ ও ক্লান্তিতে ভোগা শিক্ষার্থীদের দেখতে পাই, যারা পরবর্তীতে ভাঙচুর বা বিশৃঙ্খলার মতো কাজেও জড়িয়ে পড়ছে। এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার নৈতিক ও মানসিক দুর্বলতার প্রতিফলন।’
এই মতবিনিময় সভার সভাপতিত্ব করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব, যিনি নারায়ণগঞ্জ জেলারই সন্তান সিদ্দিক জোবায়ের। বিশেষ অতিথি হিসেবে সভায় অংশ নেন কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব ড. খ ম কবিরুল ইসলাম। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আজাদ খান। মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মনিনুর রশিদ।
সভায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী, ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. খন্দকার এহসানুল কবির, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মো. জুলফিকার হায়দার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিববৃন্দ— নুজহাত ইয়াসমিন, বেগম বদরুন নাহার এনডিসি, মো. মিজানুর রহমান, মো. মজিবর রহমান এবং সৈয়দ মামুনুল আলম। বক্তব্য দেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। এছাড়াও সভায় ছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের প্রধান প্রকৌশলী মো. আলতাফ হোসেন, জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাগণ, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের কর্মকর্তারা।