ঢাকা: বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের দেশি-বিদেশি ঋণের বিপরীতে সরকার প্রদত্ত ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির কাছে সরকার প্রদত্ত পুঞ্জিভূত ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৮২ কোটি ২০ লাখ টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারের পুঞ্জিভূত ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে সরকারের ব্যাংক গ্যারান্টির স্থিতি বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৯৮৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা।
বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ও বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, সার আমদানি, বাংলাদেশ বিমানের জন্য বোয়িং ক্রয়, জ্বালানি তেল আমদানি, কৃষি ঋণ বিতরণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিসহ বিভিন্ন খাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সংস্থা দেশি-বিদেশি ব্যাংক/আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দাতাসংস্থার কাছ থেকে গত ২০০৪ সাল থেকে সর্বশেষ ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এসব ঋণ নিয়েছে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিভিন্ন সময়ে সরকারের নীতি ও কর্মসূচী বাস্তবায়নের স্বার্থে সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক গৃহীত ঋণের জন্য গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি প্রদান করে থাকে সরকার। কোনো কারণে ঋণ গ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ঋণ যথা সময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হলে এগুলো পরিশোধের দায়-দায়িত্ব তখন সরকারের ওপর বর্তায়।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, খাতওয়ারি হিসাবে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানের শীর্ষে রয়েছে বিদ্যুৎ খাত। এর পরেই রয়েছে কৃষি সার আমদানি (বিএডিসি), ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা প্রকল্প, ইউরিয়া সার আমদানি (বিসিআইসি), বিপিসি কর্তৃক জ্বালানি তেল আমদানি ও বাংলাদেশ বিমানের জন্য উড়োজাহাজ ক্রয়। ঋণের কিস্তি পরিশোধের কারণে কিছু কিছু খাত ও প্রকল্পে ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ কমেছে। তবে এক বছরে টিসিবি’র অনুকূলে প্রদত্ত ব্যাংক গ্যারান্টির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুন।
অর্থ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতের ১৮টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট পুঞ্জিভূত গ্যারান্টির স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৭১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে এ খাতে মোট পুঞ্জিভূত গ্যারান্টির স্থিতি ছিল ৫৩ হাজার ৫৯৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে গ্যারান্টির পরিমাণ প্রায় ৫২৫ কোটি টাকা কমেছে।
বিদ্যুৎ খাতের প্রকল্প ভিত্তিক গ্যারান্টি পর্যালোচনায় দেখা যায়, একক প্রকল্প হিসেবে সবচেয়ে বেশি গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ‘এক্সপোর্ট কাম ইমপোর্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’র ঋণে বাস্তবায়নধীন ‘মৈত্রি সুপার থার্মাল পাওয়ার’ প্রকল্পে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ১৭ হাজার ১১৫ কোটি ১০ লাখ টাকা।
বিদ্যুতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে- ‘পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট’। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ‘বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড’। এই প্ল্যান্ট তৈরি জন্য ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’র কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এই ঋণের ৫০ ভাগের বিপরীতে সরকার গ্যারান্টি প্রদান করেছে। গ্যারান্টির পরিমাণ ১৬ হাজার ১৩ কোটি ১২ লাখ টাকা।
তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে- ‘রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’ ও ‘নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ার লিমিটেড’ কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘পটুয়াখালি ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র’। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যাংক গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৭৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’র কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ খাতের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের মধ্যে- ‘রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’ কর্তৃক ‘ময়মনসিংহ ৩৬০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ নির্মাণে সিঙ্গাপুরের ‘সামিতম মিৎসুই ব্যাংকিং কর্পোরেশন’-কে ১ হাজার ৩০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা;
নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড’ কর্তৃক ‘সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (৩য় ইউনিট-ডুয়েল-ফুয়েল) প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক’-কে ১ হাজার ১৬৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা; ‘ঘোড়াশাল ৩য় ইউনিট রি-পাওয়ার প্রকল্প’ বাস্তবায়নে এইচএসবিসি ব্যাংক-কে ৯৭৮ কোটি ৬৯ লাখ টাকা; ‘নর্থওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড’ কর্তৃক ‘সিরাজগঞ্জ ২২৫ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট (২য় ইউনিট-ডুয়েল-ফুয়েল) প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক’-কে ৯৬৮ কোটি ৬৪ লাখ টাকা; ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ ও ‘রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড’-এর যৌথ উদ্যোগে বাস্তবায়নাধীন ‘শ্রীপুর ১৫০ মেগাওয়াট (এইচএফও ভিত্তিক) পাওয়ার প্ল্যান্ট’ প্রকল্প বাস্তবায়নে ৯৬৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা; ‘ঘোড়াশাল ৩৬৫ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘আইসিবিসি ব্যাংক চায়না’-কে ৯২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা;
‘বড় পুকুরিয়া ২৭৫ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্প্রসারণ (৩য় ইউনিট) প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘আইসিবিসি ব্যাংক চায়না’-কে ৮৪০ কোটি ৯১ লাখ টাকা; ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ কর্তৃক ‘বিবিয়ানা-১১১-৩০০-৪৫০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন’-কে ৮১৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা; ‘বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড’ কর্তৃক ‘শাহজীবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্প’ বাস্তবায়নে ‘এইচএসবিসি’ (সিন্ডিকেটেড ঋণ)-কে ৬২৭ কোটি ৩৬ লাখ টাকা; ‘খুলনা ৩৩০ মেগাওয়াট ডুয়েল ফুয়েল কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নে ‘এক্সিম ব্যাংক অব চায়না’-কে ৫৫২ কোটি ২৬ লাখ টাকা; সৈয়দপুর ১৫০ মেগাওয়াট সিম্পল সাইকেল (এইচএফও ভিত্তিক) বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ’ প্রকল্পে ‘ব্যাংক অব চায়না’-কে ৫২৮ কোটি ১৬ লাখ টাকা এবং আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড’ কর্তৃক ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্প বাস্তবায়নে ‘এইচএসবিসি কর্পোরেট ট্রাস্টি কোম্পানি (ইউকে) লিমিটেড’-কে ৫০১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে।
অন্যান্য খাতের মধ্যে ব্যাংক গ্যারান্টির দ্বিতীয় শীর্ষ তালিকায় রয়েছে ‘বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। সার আমদানির বিপরীতে এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে গ্যারান্টির পরিমাণ ১ হাজার ২৬১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা কমেছে। বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে বিএডিসি’র অনুকূলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও জনতা ব্যাংক-কে প্রদত্ত পুঞ্জিভূত গ্যারান্টির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৯৮৫ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
এছাড়া ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা প্রকল্প বাস্তবায়নে জাপান-এর জেবিআইসি ও এমইউএফজি এবং হংকং-এর এইচএসবিসি ব্যাংক-কে ১০ হাজার ৬৩২ কোটি ৭৮ লাখ টাকা; বিসিআইসি কর্তৃক ইউরিয়া সার আমদানির জন্য চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে (সোনালী ব্যাংক-কে ৩,৯০৩.৪৯ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংক-কে ১,৭৯২.১৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক-কে ১,৫৫১.৯১ কোটি টাকা ও কৃষি ব্যাংক-কে ১,৬২৮.৫২ কোটি টাকা) মোট ৮ হাজার ৮৭৬ কোটি ৭ লাখ টাকা; পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে বিপিসি’র অনুকূলে বাংলাদেশ ব্যাংক-কে ৭ হাজার ৬৯৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা; উড়োজাহাজ ক্রয়সহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ বিমান-কে ১৭টি গ্যারান্টির বিপরীতে মোট ৭ হাজার ৭৪৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা; নিত্যপণ্য ক্রয়ের জন্য টিসিবি’র অনুকূলে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ও রূপালী ব্যাংক-কে ৪ হাজার ৮৯৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা (গত অর্থবছর ছিল ২,৪৩২ কোটি ১১ লাখ টাকা); কৃষি ঋণ প্রদানে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুকূলে ৩ হাজার ১০৮ কোটি ৭৮ লাখ টাকা এবং বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের অধীন রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর চলতি মূলধন ঋণের বিপরীতে সোনালী-জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের অনুকূলে ১ হাজার ১১৭ কোটি ৫১ লাখ টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে।