Friday 13 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দেশে বৈধ কোটিপতি ২৮৩৮৫৯
হাসিনা আমলে ২ লাখ ২৮ হাজার কোটিপতি, সর্বশেষ ৮ মাসে ১১ হাজার

সোহেল রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১২ জুন ২০২৫ ১৭:১৪ | আপডেট: ১২ জুন ২০২৫ ১৭:২৮

– ছবি : প্রতীকী

ঢাকা: অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নানা ধরনের সঙ্কট এবং বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিতেও দেশে কোটিপতির সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বর্তমানে দেশে বৈধ কোটিপতির সংখ্যা পৌনে তিন লাখের বেশি। এর মধ্যে সোয়া দু্ই লাখ কোটিপতি বেড়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আর বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের ৮ মাসে বেড়েছে ১১ হাজারের কিছু বেশি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি পঞ্জিকা বছরের গত মার্চ শেষে দেশের ব্যাংক খাতে ১ কোটি টাকার অধিক আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতার মোট সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৩ হাজার ৮৫৯ জন। এর মধ্যে আমানতকারীর সংখ্যা ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬২ এবং ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ১ লাখ ৬২ হাজার ৪৯৭ জন।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টদের মতে, এটা হচ্ছে ‘রেকর্ডেড’ কোটিপতির সংখ্যা। এর বাইরে ‘আন-রেকর্ডেড’ কোটিপতির সংখ্যা কতো- এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাপ্ত হিসাবের ভিত্তিতে যে প্রতিবেদন তৈরি করে- সেটাই কোটিপতির সংখ্যা নির্ধারণের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি। তবে অবৈধ বিত্তের মালিকরা স্বনামে-বেনামে একাধিক একাউন্টে কিংবা নিজস্ব কোনো ব্যবস্থায় টাকা রাখতে পারেন। তাদের শনাক্ত করা কঠিন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিগত শেখ হাসিনা সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংক খাতে মোট কোটিপতির সংখ্যা ছিল ৪৪ হাজার ৩৬৯ জন। এর মধ্যে আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন এবং ঋণগ্রহীতার সংখ্যা ছিল ২৫ হাজার ২০৬ জন।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুতির আগে গত সাড়ে ১৫ বছরে (জানুয়ারি ২০০৯-জুন ২০২৪) দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭১ হাজার ৩৭৪ জন (আমানতকারী ১,১৮,৭৮৪ ও ঋণগ্রহীতা ১,৫২,৫৯০)। আলোচ্য সময়ে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৫ জন।

সর্বশেষ গত ৯ মাসে (জুলাই ২০২৪- মার্চ ২০২৫) দেশে মোট কোটিপতির সংখ্য বেড়েছে ১২ হাজার ৪৮৫ জন (আমানতকারী ২,৫৭৮ ও ঋণগ্রহীতা ৯,৯০৭)। নয় মাসে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ার মাসভিত্তিক গড় হিসাব ধরে ২০২৪ সালের জুলাইসহ শেখ হাসিনার আমলে মোট কোটিপতি বেড়েছে ২ লাখ ২৮ হাজার ৩৯২ জন। অর্থাৎ গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ। প্রতিবছর গড়ে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ১৪ হাজার ৬৪৫ জন।

আর সর্বশেষ জুলাই-মার্চ পর্যন্ত সময়ে মাসভিত্তিক (গড়ে ১,৩৮৭ জন) হিসাবে অন্তর্বতী সরকারের ৮ মাসে (২০২৪ আগস্ট-মার্চ ২০২৫) দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ১১ হাজার ৯৮ জন। সে হিসাবে বছর শেষে কোটিপতির সম্ভাব্য গড় বৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে ১৬ হাজার ৬৪৪ জনে। এটি বিগত সরকারের তুলনায় অধিক।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রতিটি সরকারের আমলেই কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে। প্রতিবার রাষ্ট্র ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে এক শ্রেণির নব্য কোটিপতির উত্থান ঘটছে।
অন্যদিকে ব্যাংক খাতে কোটিপতি ঋণগ্রহীতার সংখ্যা কোটিপতি আমানতকারীদের তুলনায় প্রায় সব সময়েই বেশি। দেখা যায় যে, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা তাদের শিল্পে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছেন, ব্যাংকে তাদের দেনার পরিমাণ এর চেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ ব্যাংকের কাছে যার যত বেশি ঋণ, সে তত বড় কোটিপতি।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫৯ জন (আমানতকারী ৪৭ ও ঋণগ্রহীতা ২১২)।
জিয়া সরকারের আমল শেষে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৫৪ জন (আমানতকারী ৯৮ ও ঋণগ্রহীতা ৩৫৬)।
এরশাদ সরকারের আমল শেষে (ডিসেম্বর ১৯৯০) দেশে কোটিপতির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬৮ জন (আমানতকারী ৯৪৩ ও ঋণগ্রহীতা ২,১২৫)।
খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামল শেষে (জুন ১৯৯৬) কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ১২০ জন (আমানতকারী ২,৫৯৪ ও ঋণগ্রহীতা ৪,৫২৬)।
শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামল (জুন ১৯৯৬-সেপ্টেম্বর ২০০১) শেষে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৫৮২ জন (আমানতকারী ৫,১৬২ ও ঋণগ্রহীতা ৮,৪২০)।

কোটিপতির শ্রেণী চরিত্র

বাংলাদেশে কোটিপতিদের সম্পদ ও আয়ের উৎস নিয়ে কৌতূহলী প্রশ্ন বিভিন্ন সময়ে উঠেছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে এ-সংক্রান্ত কোনো গবেষণা বা তথ্য-উপাত্ত নেই। তবে বিভিন্ন সময়ে দেশের একাধিক অর্থনীতিবিদদের গবেষণা ও বিশ্লেষণধর্মী লেখায় বাংলাদেশে কোটিপতিদের শ্রেণী চরিত্রের কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।

এতে দেখা যায়, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত-এর মতে, দেশে দুই ধরনের ধনী রয়েছেন। এদের একটি অংশকে বলা হয় ‘বনেদী’, আর অন্যটি হচ্ছে ‘নব্য’। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সময়ের পার্থক্য ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দেশবিভাগের (১৯৪৭ সাল) পর হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করে বনেদীদের যাত্রা শুরু হয়। অন্যদিকে নব্যরা তাদের যাত্রা শুরু করে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানীদের সম্পত্তি দখল করে। এই প্রক্রিয়ার বাইরে যারা আছেন, তারা মুষ্টিমেয় কয়েকজন।

তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশে বৈধ পথে কোটিপতি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। লুটতরাজই আমাদের দেশে কোটিপতি হওয়ার প্রধান পদ্ধতি। বাংলাদেশে কোটিপতিদের আদি সঞ্চয়নও হয়েছে অবৈধ পথে, কালো টাকার মাধ্যমে।’

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এর মতে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিত্তবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এখানে চালু হয়, কেউ কেউ এটাকে তুলনা করেন ‘ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি’র পুঁজি সংগ্রহের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। এই প্রক্রিয়া হচ্ছে- ব্যাপক লুণ্ঠনের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ। পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা ও সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছিল, তারা ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও লাইসেন্স ইত্যাদি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করলেও নিজেরা হয়েছেন কোটিপতি। একই সঙ্গে ব্যাপক চোরাচালান, মজুতদারী, লাইসেন্স পারমিট ব্যবসা এবং ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ছিল কোটিপতিদের উত্থানের একটি স্বর্ণ কাল।

তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশে নব্য ধনীক শ্রেণীর উত্থানের প্রথম পর্বে ছিল লাইসেন্স, পারমিট, চোরাচালানি, মজুতদারি, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানা, সম্পদ আত্মসাৎ ইত্যাদি। এরপর আশির দশক ছিল নব্য ধনিক শ্রেণীর জন্য খুবই সুবর্ণ সময়। এ পর্বে আরও যোগ হয় ব্যাংকঋণ ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা লাভ। ব্যাংকঋণের সুবিধা বাড়ে, ঋণখেলাপিও বাড়ে। ব্যবসা ও সরকারি ক্ষমতার মধ্যে যোগাযোগ ও চুক্তির নতুন বিন্যাস ঘটে।’

বাংলাদেশের নব্য বিত্তবান শ্রেণিকে ‘লুম্পেন কোটিপতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, লুম্পেন কোটিপতি হচ্ছে এমন একটি শ্রেণি, যারা নিজেদের বিত্ত অর্জনের জন্য উৎপাদনশীল পথের চেয়ে দ্রুত মুনাফা অর্জনে অন্যান্য সহজ ও চোরাই পথ গ্রহণে বেশি আগ্রহী থাকে। এগুলোর মধ্যে চোরাচালানি, মাদক ব্যবসা, ব্যাংক ঋণ লোপাট, জবর দখল, জালিয়াতি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

তার মতে, ‘এখন আমরা প্রবেশ করেছি বিত্তায়নের তৃতীয় পর্বে, যখন ব্যাংকঋণের মধ্যে সম্পদ লুণ্ঠন সীমিত নেই। আকাংক্ষা ও সুযোগ দুটিই এখন অনেক বেশি। সর্বজনের সব সম্পদই এখন বাংলাদেশে এই শ্রেণির কামনা-বাসনার লক্ষ্যবস্তু। বৃহৎ চুক্তিতে বৃহৎ কমিশন, জমি-নদী-খাল-বন দখল, সর্বজনের সম্পদ আত্মসাৎ, মেগা প্রকল্পে মেগা চুরির রাস্তা তৈরিসহ পুরো দেশই এখন ভোগ্যবস্তু।’

এর বাইরে কারো কারো মতে, পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জনগণের সঞ্চয় এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য কতিপয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণের জন্য ব্যাংকের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় গত আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঋণ খেলাপী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা উঠে আসেন কোটিপতির তালিকায়।

এর সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে জমি কেনা-বেচা, হাউজিং ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী, নির্মাণ কাজের ঠিকাদাররা কোটিপতির তালিকায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেন।

এ প্রক্রিয়ার বাইরে পেশাজীবীদের মধ্যে উকিল ও ডাক্তারদের অনেকে কোটিপতির তালিকায় রয়েছেন। এছাড়া মাস্তানী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে টোকাই থেকে কোটিপতি হয়েছেন- এমন কথা শোনা যায়।

সারাবাংলা/আরএস

বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা