সিলেট: দেশে যে কয়টি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে জাফলং ভ্রমণ প্রিয়দের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট। সরকারি ছুটির দিন ছাড়াও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার এখানে সমাগম ঘটে লাখো পর্যটকের। ঘুরতে আসেন বিদেশি পর্যটকেরাও।
এখানে পর্যটকদের জন্য রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি (ভারতীয়) নানান পণ্য কেনাকাটার জন্য রয়েছে মিনি মার্কেট। জিরো পয়েন্টের মুল স্পটে যাওয়ার প্রায় এক কিলোমিটার আগে মার্কেটগুলো অবস্থিত। যেখান থেকে অনায়াসে পর্যটকরা আর্কষণীয় নানান পণ্য কেনাকাটা করেন।
তবে কেনাকাটার এতসব সুবিধা থাকার পরও জাফলং জিরো পয়েন্ট মুল স্পটে শত শত অবৈধ ভাসমান দোকান বসিয়ে জাফলংয়ের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি করছে পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতি নামের একটি সংগঠন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিলেটের জাফলংয়ের অপার সৌন্দর্য গিলে খাচ্ছে এসব অবৈধ ভাসমান দোকান। এসব দোকানের কারণে পর্যটকদের চলাচল করতে নিত্যদিন নানা বিপত্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। বিনোদন বঞ্চিত সাধারণ মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে প্রকৃতির অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারছেন না। কারণ পুরো জাফলংয়ের সৌন্দর্য গ্রাস করে রেখেছে ভাসমান দোকানগুলো।

অবৈধ ভাসমান দোকান। ছবি: সারাবাংলা
নৈশ্যপ্রহরীর নাম ভাঁঙ্গিয়ে প্রভাবশালী একটি চক্র পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির নামে এসব দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। সরকারের খাস জমির ওপর এসব অস্থায়ী দোকান বসিয়ে রমরমা ব্যবসা চালানো হলেও সে দিকে প্রশাসনের কোনো খেয়াল নেই। এসব অবৈধ দোকান উচ্ছেদের ব্যাপারে এক সংস্থা আরেক সংস্থার উপর দোষারোপ করেই বছরের পর বছর পার করছে। অবৈধ এসব দোকান আর উচ্ছেদ হয় না।
জানা যায়, গত সোমবার (৯ জুন) পর্যটন সমিতির সভাপতি হোসেন মিয়া ও আলমগীর হোসেন তার দলবল নিয়ে চাঁদা তুলছিলেন। এ সময় এক অস্থায়ী ব্যবসায়ী চাঁদা দিতে না পারায় তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন তারা। ঘুরতে যাওয়া একজন সাংবাদিক সেখানে পরিচয় দিয়ে উপস্থিত হলে সঙ্গে সঙ্গে হোসেন মিয়া দলবল নিয়ে সটকে পড়েন।
সরজমিনে দেখা যায়, বিজিবির সংগ্রাম ক্যাম্পের নিচ থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার পথে দু’পাশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ভাসমান দোকান। নিচে সমতল ভূমিতে পসরা সাজিয়ে রয়েছে শত শত দোকান। ওপরে শামিয়ানা ও পলিথিন দিয়ে তৈরি এসব অস্থায়ী দোকান নিয়ন্ত্রণ করছে চাঁদাবাজরা।

জাফলং জিরো পয়েন্ট প্রধান স্পটে শত শত অবৈধ ভাসমান দোকান। ছবি: সারাবাংলা
কয়েকজন অস্থায়ী দোকানীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানে দোকান বসাতে হলে প্রথমে সমিতিকে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা অগ্রীম দিতে হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতি সপ্তাহে নৈশপ্রহরীর বেতন বাবদ প্রতিটি অস্থায়ী দোকান থেকে সমিতির নামে ২০০ টাকা করে চাঁদা তোলা হলেও বর্তমানে ৩০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা চাঁদা তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে তাদেরকে বাড়তি টাকা দিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী জানান, এখানে বর্তমানে ৫০০ শত এর অধিক বেশি অস্থায়ী দোকান রয়েছে। প্রতিটি দোকানের মালিক ৫০০-৭০০ টাকা করে সপ্তাহে চাঁদা দিলে ৫০০ দোকান থেকে প্রতি সপ্তাহে তিন লাখের বেশি চাঁদা ওঠে। সে হিসাবে এক বছরে দুই কোটি টাকার কাছাকাছি চাঁদা তোলা হয় এসব অস্থায়ী দোকান থেকে।
ঈদের ছুটিতে রাজশাহী থেকে ঘুরতে আসা সোহেল রানা নামের একজন পর্যটক সারাবাংলাকে অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি ৫/৬ বছর পূর্বে জাফলং এসেছিলাম তখন এখানে কোনো দোকান ছিল না। এখন দেখছি পুরো পর্যটন এলাকা ভাসমান দোকানে ছেয়ে গেছে। বসার ও হাটার জায়গা পর্যন্ত নেই। এসব অবৈধ দখলকারীদের জন্য জাফলংয়ের সৌন্দর্য হারিয়েছে। পার্শ্ববর্তী ভারতের সীমান্তে তো কোনো ভাসমান দোকান নেই। তাহলে আমাদের কেন দোকান দিতে হবে?’
ঢাকা থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন ব্যাংকার তাসফিয়া তাবাসসুম মিম। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা ভ্রমন প্রিয় মানুষ তাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা সিলেট। আর সিলেট মানেই জাফলং। কিন্তু জাফলংয়ের সৌন্দর্য সেই আগের মত নেই। চারিদিকে ভাসমান দোকান একটা ছবি তোলা যায় না। ছবি তুলতে গেলে ব্যাকরাউন্ডে প্রকৃতির বদলে পলিথিন ঘেরা এসব নোংরা ভাসমান দোকানগুলো ফ্রেমে চলে আসে। পর্যটকদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় শত শত দোকান থাকার পরও এসব ভাসমান দোকান কেন বসিয়েছে আমরা বুঝতে পারছি না। প্রশাসন এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান না নিলে একসময় জাফলংয়ের সৌন্দর্য বিনষ্ট হবে, সঙ্গে পর্যটকেরা মুখ ফিরিয়ে নিবে।’

অবৈধ ভাসমান দোকান। ছবি: সারাবাংলা
সরকারের খাসজমির ওপর নির্মিত এসব দোকান থেকে বছরে কোটি টাকার বেশি চাঁদা তোলা হলেও তার কোনো তথ্য নেই গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসনের কাছে। বছরের পর বছর এই খাত থেকে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা থাকলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অবৈধ দোকান বসিয়ে চাঁদা আদায়ের বিষয়ে গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রতন কুমার অধিকারী সারাবাংলাকে জানান, এখানকার সকল দোকানপাট অবৈধ। এই জায়গা সরকার কাউকে লিজ দেয়নি এবং
এমন অভিযোগ তিনি প্রথম শুনেছেন। খুব শিগগিরই তিনি খোঁজ নিয়ে একশনে যাবেন বলে প্রতিবেদককে জানান।
জাফলং পর্যটন ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হোসেন মিয়ার কাছে মোবাইলে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এই এলাকায় ৬০টি দোকান রয়েছে। এসব দোকান থেকে নৈশপ্রহরীর বেতন তোলা হয়।’ নৈশপ্রহরীর বেতনের জন্য সপ্তাহে দুই লাখ ১০ হাজার টাকা লাগে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে হোসেন মিয়া বলেন, ‘এসব বিষয়ে কথা বলতে চাইলে জাফলং আসেন।’ এরপর তিনি মোবাইলফোনের সংযোগ কেটে দেন।
চাঁদা তোলার ব্যাপারে গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমেদ সারাবাংলাকে জানান, শত শত দোকান রয়েছে এটা ঠিক কিন্তু চাঁদার বিষয়ে তিনি অবগত নন। অভিযোগ পেলে তিনি একশনে যাবেন এবং বিষয়টি তিনি দেখবেন।