ঢাকা: যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের প্রায় ৩৬টি দেশে আম রফতানি হচ্ছে। আম রফতানির তালিকায় এ বছর নতুন করে যুক্ত হয়েছে চীন। দেশটিতে এরই মধ্যে তিন টন আম রফতানি হয়েছে। আর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন পর্যন্ত আম রফতানির পরিমাণ প্রায় ৬০০ টন, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। তবে, বছরটিতে প্রায় চার হাজার টন আম রফতানির স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড ৩ হাজার ১০০ টন আম রফতানি হয়। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৩২১ টনে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে আম রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ টন। এর আগের ৫ অর্থবছরে আম রফতানির পরিমাণ ছিল এক হাজার টনেরও কম। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩০৯ টন আম রফতানি হয়। তা ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৯১ টনে গিয়ে ঠেকে।
অর্থাৎ দেশে আম রফতানির ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। কেবলমাত্র গত বছর পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় আম রফতানি কমেছে। গতবছর আমের ভর মৌসুম জুলাই-আগস্টে দেশে ঘটে যাওয়া জুলাই অভ্যুত্থানের কারণে আম রফতানি কম হয়েছে বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১০০ টন আম রফতানির রেকর্ড ভেঙে এ বছর রফতানিতে নতুন রেকর্ড গড়ার স্বপ্ন দেখছেন উদ্যোক্তারা।
তথ্যমতে, গেল কয়েক বছর ধরেই আম রফতানিতে নতুন নতুন দেশ খুঁজছে বাংলাদেশ। সেই তালিকায় এ বছর চীন যুক্ত হয়েছে। চীনে ৫০ টন আম রফতানির সম্ভবনা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়া। তবে এখন পর্যন্ত দেশটিতে তিন টন আম রফতানি হয়েছে।
তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে ২১টি দেশে ১ হাজার ৩২০ টন আম রফতানি হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আম রফতানি হয় যুক্তরাজ্যে। দেশটিতে রফতানির পরিমাণ ছিল ৪০২ টন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা সৌদি আরবে ২৩৯ টন, তৃতীয় স্থানে সংযুক্ত আর আমিরাতে ১২৪ টন আম রফতানি হয়। এ ছাড়া, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৬টি দেশে রেকর্ড ৩ হাজার ১০০ টন আম রফতানি হয়। সে বছর সবচেয়ে বেশি আম রফতানি হয়েছিলে যুক্তরাজ্যে। দেশটিতে ওই বছর ১ হাজার ৩৮৫ টন আম রফতানি হয়। সে বছর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ইতালিতে ৩৪৪ টন ও তৃতীয় স্থানে থাকা সৌদি আরবে ৩১০ টন আম রফতানি হয়েছিল।
তথ্যমতে, কয়েক বছর ধরেই যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি আম রফতানি হয়ে আসছে। আর একক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যই এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি আমের বড় বাজার। এসব দেশের বাইরে অস্ট্রিয়া, বাহরাইন, বেলজিয়াম, কানাডা, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, গ্রিস, হংকং, আয়ারল্যান্ড, জর্ডন, লেবানন, মালদ্বীপ, নেদারল্যান্ড, ওমান, পুর্তগাল, কাতার, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, সোয়াজিল্যান্ড ও সুইডেনসহ আর কয়েকটি দেশে আম রফতানি হয়ে আসছে।
দেশে রফতানিযোগ্য আমের উৎপাদন বাড়াতে গেল কয়েক বছর ধরে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এই প্রকল্পের অধীনে রফতানিযোগ্য আমের উৎপাদন বাড়াতে সরকার কৃষকদের নানা সুযোগ দিয়ে থাকে। ‘রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প’এর প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর আম রফতানির সম্ভাবনা খুবই ভালো। দেশে প্রতিবছর ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। আমরা গতবছর বা তার আগের বছর ৩৬টি দেশে আম রফতানি করতে পেরেছি। চলতি বছর চীন এ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। চীনে এরই মধ্যে আম রফতানি শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে দেশটিতে তিন টন আম রফতানি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে আম রফতানির নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে।’
আরও পড়ুন
- বাংলাদেশের আমে আগ্রহ চীনের
- যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে যাবে ৪ হাজার টন আম
- ফল উৎপাদনে নীরব বিপ্লব, দেড় দশকে উৎপাদন বেড়ে দ্বিগুণ
তিনি বলেন, ‘গতবছর এই সময়ে যে পরিমাণ আম রফতানি হয়, এ বছর একই সময়ে তারচেয়ে বেশি আম রফতানি হয়েছে। চলতি বছর আম রফতানির প্রবণতা ভালো। আমরা আশা করছি, এ বছর প্রচুর পরিমাণে আম রফতানি হবে।’
এই প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘এবছর এখন পর্যন্ত ৬০০ টন আম রফতানি হয়েছে। এটি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গতবছর পুরো মৌসুমে আম রফতানি হয়েছিল ১ হাজার ৪০০ টন। আর এ বছর ২৮ মে থেকে আনুষ্ঠানিভাবে আম রফতানি শুরু হয়েছে। যদিও তার কয়েকদিন আগে থেকেই স্বল্প পরিসরে কিছু আম রফতানি হয়। আর এ বছর আম রফতানির মৌসুম আছে আরও প্রায় আড়াই মাস। জুলাই-আগস্ট জুড়েই আম রফতানি হবে। আম রফতানির এই ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছর প্রায় চার হাজার টন বা তারও বেশি আম রফতানি হতে পারে।’
এদিকে, কাতারে প্রথমবারের মতো সপ্তাহব্যাপী ফল মেলা শুরু হচ্ছে আগামী ২৫ জুন। কাতার দূতাবাসের উদ্যোগে শুরু হতে যাওয়া সপ্তাহব্যাপী ওই ফল মেলায় ৬০টি স্টল থাকবে। মেলা চলবে আগামী পহেলা জুলাই পর্যন্ত। এর মধ্যে দিয়ে কাতারে আম রফতানি আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে রফতানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আম বাণিজ্য বাড়াতে কাতারে প্রথমবারের মতো ফল মেলা শুরু হচ্ছে ২৫ জুন। মেলা করতে ইংল্যান্ডেরও একটি পরিকল্পনা রয়েছে। চীনের কংমিনেও একটি মেলা হচ্ছে। সবকিছুতে উৎসাহ উদ্দীপনা দেখতে পাচ্ছি। বৈশ্বিক অবস্থা যদি স্থিতিশীল থাকলে এ বছর আম রফতানিতে রেকর্ড হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কাতার ফেয়ারে আগে ভারত ও পাকিস্তান ডমিনেট করতো। কিন্তু এবার আমরা যেহেতু অংশগ্রহণ করছি, তাদের সেই সুযোগ কমে যাবে। প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি কাতারে থাকেন। মেলার মাধ্যমে দেশটিতে বাংলাদেশি আমের ব্যাপক প্রসার ঘটবে। সেখানে আমাদের আমের রফতানি বাড়বে বলে আমরা বিশ্বাস করি।’ তবে আম রফতানিতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, আম রফতানির ক্ষেত্রে দু-তিনটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিমান ভাড়া যদি স্থিতিশীল থাকে ও বিমানের যদি সংকট না হয়, তাহলে এবার ভালো পরিমাণে আম রফতানি হবে।
এদিকে, ২০২৪ সালে আম রফতানি কম হওয়ার কারণ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গতবছর ছাড়া প্রায় প্রতিবছরই আম রফতানি বেড়েছে। আম রফতানির মূল সময় জুলাই-আগস্ট। ২০২৪ সালে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। সঙ্গত কারণেই তখন আম রফতানি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণেই গতবছর পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় কম আম রফতানি হয়েছে। এ ছাড়া, গতবছর বিমান ভাড়াও বেশি ছিল। এ বছর বিমান ভাড়া কিছুটা সহনীয়।’ সংশ্লিষ্ট আরেক কর্মকর্তা জানান, দেশে এবার আমের উৎপাদন ভালো হয়েছে। আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে গত বছর ‘অফ ইয়ার’ ছিল, এ বছর ‘অন ইয়ার’। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ বছর আমের উৎপাদন বেশি হবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশ থেকে ৩০৯ টন আম রফতানি হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে রফতানি হয় ২৩১ টন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩০৮ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৭৯ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৯১ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে এক হাজার ৭৫৭ টন আম রফতানি হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আম রফতানি হয়েছে তিন হাজার ১০০ টন। তবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তা কমে ১ হাজার ৩২১ টনে নেমে আসে।
এদিকে, গত কয়েক বছর ধরে দেশে আমের উৎপাদন ২১ থেকে ২৭ লাখ টনে ওঠানামা করছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে রেকর্ড ২৭ লাখ টন আম উৎপাদন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে দেশে আম উৎপাদন হয়েছিল ২১ লাখ ৪৩ হাজার টন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৩ লাখ ৭২ হাজার টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২২ লাখ ২৯ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার টন।
সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়। অর্থবছরটিতে আমের উৎপাদন ছিল ২৬ লাখ ৭০ হাজার টন। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে যেখানে ১ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছিল, সেখানে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আবাদি জমির পরিমাণও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার হেক্টর।