Thursday 19 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

টপ সয়েল ধ্বংস ও বিরামহীন চাষাবাদ
উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, ফসল উৎপাদনে বাড়ছে ঝুঁকি

তহীদ মনি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
১৯ জুন ২০২৫ ০৮:০০ | আপডেট: ১৯ জুন ২০২৫ ০৮:১৩

চলছে টপ সয়েল ধ্বংসের মহা উৎসব। ছবি: সংগৃহীত

যশোর: যশোরের প্রতিনিয়ত মাটির উপর চাপ বাড়ছে। দিন দিন উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি। উর্বরতা কমতে কমতে এক সময় মাত্রা অতিক্রম করলে উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনকারী জেলা হিসেবেখ্যাত যশোর ফসল উৎপাদনে পিছয়ে পড়তে পারে। একই জমিতে বার বার একই জাতীয় ফসল উৎপাদন, মাটির বিশ্রাম ছাড়াই চাষাবাদ, টপ সয়েল ধ্বংস, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার নির্ভরতা, সচল নদী না থাকায় কোনো কোনো অঞ্চলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া, ফসলি জমিতে মাছের ঘের, মাটির জৈব উপাদান দিন দিন কমে যাওয়া, পানিরস্তর নিচে নেমে যাওয়া, আবহাওয়া ও পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়াসহ রাসায়নিক উপাদানের ঘাটতি দিন দিন মাটির স্বাস্থ্য নষ্ট করছে। স্বাস্থ্যহীন মাটির ক্রমাগত ব্যবহার উর্বরতার উপর চাপ সৃষ্টি করছে এবং আগামীতে ফসল উৎপাদনের ঝুঁকি তৈরি করছে।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটি সৃষ্টি করা যায় না। তাই যে মাটি রয়েছে তার সঠিক ও সুষ্ঠু ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের খাদ্য চাহিদা যোগানের উৎস হিসেবে কাজে লাগাতে হবে বলে মৃত্তিকা সম্পদ বিভাগের সূত্র জানিয়েছে। সূত্র মতে, মাটির কিছু পুষ্টি চলে যায় ফসলের সঙ্গে। ফসল যত ফলে মাটির পুষ্টিগুণ তত কমে। উদ্ভিদ মাটি থেকে যে পুষ্টি নেয় সে পুষ্টি পূরণের চেষ্টা করা হয় সার দিয়ে। মাটির উর্বরতা কম হওয়া এটা শুধু যশোরের সমস্যা নয়, দেশ ও একটি বৈশ্বিক সমস্যা। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলছে। জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য উৎপাদন ও একই জমির বহুবিধ ব্যবহার বাড়ছে, যা মাটির স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর। এখনই এর প্রতিকারে ও মাটির স্বাস্থ্য ও উর্বরতা বৃদ্ধির ব্যপারে সচেতন না হলে ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

যশোরে মাটির উর্বরতা নষ্ট হওয়ার বড় কারণের মধ্যে একটি হলো- এর উপরিভাগ বা টপ সয়েল ধ্বংস করা। জেলার শতাধিক ইটের ভাটায় যে পরিমাণ মাটি প্রতিনিয়ত ধ্বংস করা হচ্ছে তাতে প্রকৃতির যে শৃঙ্খলা আছে তা ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। এখনই এসব ইটভাটায় মাটি পোড়ানো বন্ধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্ম ফসল উৎপাদনের জন্যে মাটি খুঁজে পাবে না বলেও কৃষি বিভাগ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, মাটির উপরিভাগ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত গভীরে ফসলের জন্যে পুষ্টি উপাদান থাকে। উপরের মাটি বিক্রি ও পোড়ানো বা অন্য উপায়ে তা ধ্বংস করার ফলে উর্বরতা কমে যাচ্ছে। ওই মাটিতে পরবর্তী সময়ে ফসল ফলাতে কৃষক অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার প্রয়োগ করছে। এতে মাটির স্বাস্থ্য শৃঙ্খলা আরও বিনষ্ট হচ্ছে। এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী বলেও মনে করছে কৃষি বিভাগ।

মাটি গবেষকদের মতে, প্রতিবছরে বেশ কয়েক লাখ নতুন মানুষ জনসংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। এদের জন্য খাদ্যের জোগান যেমন দরকার, একইভাবে দরকার আবাসন। মাটির আরও কিছু কারণে উর্বরতা হারায়। নির্মাণ কাজের সময় মাটিতে বর্জ্য পড়ে। বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়াও মানুষ জমিতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে, বসবাসের জন্য পাকা ভবন বানাচ্ছে। ভবন বা বড় অবকাঠামো নির্মাণের সময় ইট, বালু, সুরকি, সিমেন্ট মাটিতে পড়ে। এতে মাটির স্বাভাবিক গুণ নষ্ট হয়।

এদিকে ফসলি জমিতে মাছের ঘের করে স্থায়ী জলাব্ধতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। যশোরের বেশিরভাগ অঞ্চলে ফসলের মাঠ খালি পড়ে থাকে না। এখানকার মাটির বিশ্রাম নেই। একটি ফসল উঠলেই অন্য ফসলের চাষ করা হচ্ছে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতি ব্যবহারে মাটি নিঃস্ব, দুর্বল, রোগগ্রস্ত হয়। মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে মাটি বিষাক্ত হয়ে পড়ে। এই স্থায়ী টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যশোরসহ পুরো বাংলাদেশকে যেতে হবে। এই সমস্যাগুলো বহুমাত্রিক। এতে প্রতিদিনই মাটির ওপর চাপ বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য আমাদের জোরালো প্রস্তুতি প্রয়োজন।

যশোর সদরের কৃষক আইয়ুব হোসেন, আব্দুল মতিন, রোস্তম আলীসহ কয়েকজন সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখন সার ও কীটনাশক ছাড়া ধান পাট উৎপাদনের কথা ভাবাই যায় না। আমাদের ছোটবেলায় জমিতে এত রাসায়নিক সার দিতে হতো না। কীটনাশকও এত ব্যবহার করতে হতো না। এখন দিন যত যাচ্ছে, ফসল উৎপাদনের জন্যে সার কীটনাশক ও সেচ বা পানির ব্যবস্থা আগে করতে হচ্ছে।’

সার ব্যসায়ী মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পুরো বোরো মৌসুম তো কৃষককে সার কীটনাশক দিতে হিমশিম খেতে হয়। ধান লাগানোর আগে চাষের শুরুতেই সার কেনা শুরু করে কৃষকরা। তরকারি বা অন্য ফসলেও সার ও কীটনাশক দেওয়া হয়। এখন মানুষ রাসায়নিক সার ও ওষুধ ছাড়া ফসল উৎপাদনের কথা ভাবতেই পারে না। কৃষকরা কীটনাশক ব্যবহারের কুফল না জানলেও তাদের ধারণা জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। তারা জানেনও না, কোথায়- কেমনভাবে মাটি পরীক্ষা করাতে হয়। তারা জানেন শুধু, মাটির উর্বরতার জন্যে সার লাগবে। আগে কম লাগলেও এখন বেশি লাগছে।’

এসব বিষয়ে যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত উপপরিচালক(শস্য) সমরেণ বিশ্বাস সারাবাংলাকে জানান, যশোরাঞ্চলের ভবদহ অধ্যুষিত এলাকায় দীর্ঘদিন পানি জমে থাকায় সেখানকার মাটির উর্বরতা কিছুটা কমছে। গত মৌসুমেও কয়েক হাজার হেক্টর জমিতে ফসল ফলানো সম্ভব হয়নি। সেখানে নদীর পানি ঢুকে লবণাক্ততাও বেড়েছে। যশোরের কৃষকরা বেশিরভাগ জমিতে তিন ফসল ফলান। কোনো কোনো জমি ব্যবহৃত হয় চার ফসলের জন্যেও। এতে জমি ‘রেস্ট’ পায় না, জমির জৈব উপাদান কমে যায়। জমির উর্বরতা ও পুষ্টিগুণ কমে যায়। সাধারণত জমির জৈব উপাদান ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেলে সে জমিকে অনুর্বর জমি বলে। যদিও অনুর্ববতার আরও কারণ থাকে।

তিনি বলেন, ‘নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশসহ বিভিন্ন উপাদান মিলেই জমির উর্বরতা ঠিক রাখে। তবে জৈব উপাদান প্রথমেই ঠিক রাখতে হবে। অন্য অনেক জেলার চেয়ে এই জৈব উপাদান যশোরে ভালো। এখানকার কৃষকরা জৈবসার ও কম্পোস্ট ব্যবহারে পারদর্শী ও আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তারপরও বার বার একই জমিতে একই জাতীয় ফসল উৎপাদন, জমির ক্ষয়, পানির স্তর নেমে যাওয়া যশোরের জমির উর্বরতাকে কমিয়ে দিচ্ছে। এখনই ব্যবস্থা নিতে না পারলে আগামীতে যশোর উদ্বৃত্ত ফসল উৎপাদনের জেলার তকমা হারাতে পারে।’

যশোর মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোস্তাসিম বিল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকগুলো কারণ মাটির উর্বরতা রক্ষায় কাজ করে। মাটি আসলে সৃষ্টি করা যায় না। তার উপাদান, পুষ্টি ও সংরক্ষণের মাধ্যমে মাটিকে আমাদের ব্যবহার উপযোগী করে রাখতে হয়। ফসল উৎপাদনের জন্যে মাটির বিকল্প নেই। তাই মাটির উর্বরতা ও পুষ্টিগুণ ধরে রাখতে সরকার, কৃষিবিভাগ, কৃষক ও সমাজের সকল মানুষের সমন্বয় দরকার। যশোরের মাটিতে নিয়মিত এবং অতিরিক্ত ফসল ফলানো হচ্ছে। কোনো কোনো অঞ্চলের মাটিতে জৈব উপাদান কমে যাচ্ছে। আমাদের গ্রীষ্ম কালের শুরুতে পানিরস্তর নেমে যাচ্ছে কয়ক বছর। ভবদহ এলাকার মতো আবার কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতাও তৈরি হচ্ছে। এ সব কিছু মাটির স্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি স্বরূপ। এটা মাটির স্বাস্থ্যের জন্যে ভবিষ্যতে আরো প্রকট হতে পারে।’

যশোরের মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের অফিস প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. বোরহান উদ্দিন সারাবাংলাকে জানান, যশোরের মাটিতে সালফার ও ফসফরাসের ঘাটতি রয়েছে। জৈব উপাদান এখনো মারাত্মক আশঙ্কাজন অবস্থায় পৌঁছায়নি। এখানে এখনো সার প্রয়োগের মাধ্যমে ফসল ফলানো হচ্ছে। এই ধারা অব্যহত থাকলে সামগ্রিক অবস্থা খারাপ হতে পারে। মাটির কিছু সমস্যা বহুল আলোচিত, সমাধানেরও কিছু চেষ্টা হয়েছে। এখন ফসলের অবশেষ (নাড়া, কুটা) মাঠে রেখে আসার প্রবণতা ও পরিমাণ বেড়েছে। এতে জমির জৈবগুণ বাড়ছে। তাছাড়া সারের যৌক্তিক ব্যবহার আগের চেয়ে বেড়েছে।’

যশোরের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের সাবেক উপপরিচালক ড. সুশান্ত কুমার তরফদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা টপ সয়েল পুড়িয়ে ইট তৈরি করছি। মাটির জৈব গুণ ধ্বংস করছি। অনেক সম্পদশালীরা রাজধানীসহ শহরাঞ্চলে বাড়ি করে মাঠের মিকে মূল্যহীন মনে করে, মাটি বিক্রি করে, আবার অনেক কৃষক জমি সমান কররার নামে মাটি ভাটায় বিক্রি করে। এতে টপ সয়েল ধ্বংস হচ্ছে আর মাটির উর্ববরতা ও পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে।’

তিনি পরামর্শ ও সুপারিশ হিসেবে বলেন, ‘প্রত্যেক কৃষকের উচিত বাড়িতে ভার্মি কম্পোস্ট, ট্রাই কম্পোস্ট তৈরি করে জমিতে দেওয়া, বোরো বা আমন ধান ওঠার পর বেশি বীজ ছিটিয়ে পাট, ডাল জাতীয় ফসল লাগানো এবং কিছুদিন পর বড় হলে তা মাটির সাথে সমান করে দেওয়া। তাতে নাইট্রোজেন ও জৈব পদার্থ বাড়বে, প্রাকৃতিক সার পাবে মাটি। একইসঙ্গে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা ও উর্বরতাও বাড়বে।’

তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক কৃষকের পরিচিতি কার্ড থাকা দরকার এবং যেকোনো ফসল লাগানোর আগে মাটি পরীক্ষা করে কোন মাটির জন্য কতটুকু সার প্রয়োজন তা নিশ্চিত করা। আমাদের অনেক কৃষক মাটি পরীক্ষা ছাড়াই অতিরিক্ত ইউরিয়া সার প্রয়োগ করে। এরকম করা মাটির স্বাস্থ্যের জন্য সত্যিই ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে ফসল উৎপাদন ঠিক রাখতে এখন থেকেই মাটি সংরক্ষণ ও মাটির স্বাস্থ্যের প্রতি আরও বেশি সচেতন হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

সারাবাংলা/পিটিএম

উর্বরতা ঝুঁকি টপ সয়েল ধ্বংস ফসল উৎপাদন বিরামহীন চাষাবাদ মাটি

বিজ্ঞাপন

৪৯৫ রানে অলআউট বাংলাদেশ
১৯ জুন ২০২৫ ১১:৩০

আরো

সম্পর্কিত খবর