Friday 20 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিটিআরসির জরিমানাসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা চায় ২ প্রতিষ্ঠান

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২০ জুন ২০২৫ ০৮:০১ | আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ ০৪:০১

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। ছবি কোলাজ: সারাবাংলা

ঢাকা: চোরাইপথে ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানির অভিযোগে দেশের পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করেছে টেলিযোগাযোগ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এর মধ্যে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি ব্যান্ডউইথ আমদানি করা ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টোরিয়াল ক্যাবল (আইটিসি) অপারেটর তিনটি। আর দেশের ভেতরে ইন্টারনেট সরবরাহকারী ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) অপারেটর রয়েছে দু’টি। তবে দেশের বাইরে থেকে সরাসরি ব্যান্ডউইথ আমদানি করা প্রতিষ্ঠান আইটিসি’র চেয়ে দেশের ভেতরে ইন্টারনেট সরবরাহকারী আইআইজি প্রতিষ্ঠানকে কয়েকগুণ বেশি জরিমানা করা হয়েছে!

বিজ্ঞাপন

এদিকে বড় প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ছোট প্রতিষ্ঠানকে অধিক জরিমানার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি ছোট প্রতিষ্ঠান দুটি ন্যায় বিচারও চেয়েছে। অভিযোগের দায় অস্বীকার করে বিটিআরসির কাছে পুনঃতদন্ত ও জরিমানা পুনর্বিচেনার জন্য আবেদনও করেছে তারা। শুধু তাই নয়, অযৌক্তিক এই জরিমানার বিষয়টি গড়িয়েছে আদালত পর্যন্তও। উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে একটি আইআইজি প্রতিষ্ঠান। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

তথ্যমতে, চোরাইপথে ব্যান্ডউইথ আমদানির অভিযোগে তিন আইটিসি অপারেটরকে জরিমানা করা হয়েছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। বিপরীতে আইটিসির থেকে ব্যান্ডউইথ কেনা দুই আইআইজি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়েছে ২২ কোটি টাকা। আইটিসির তুলনায় আইআইজিকে কয়েকগুণ বেশি জরিমানা করার বিষয়টি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না প্রতিষ্ঠান দু’টি।

জানা গেছে, বিডি লিংক নামের আইটিসি অপারেটরকে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। আর নভোকম লিমিটেড ও ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল নামের দুই আইটিসি অপারেটরকে ৫০ লাখ টাকা করে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এই তিন আইটিসি অপারেটরের জরিমানার পরিমাণ তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা। বিপরীতে দুই আইআইজিকে ২২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এরমধ্যে লেভেল থ্রি নামের প্রতিষ্ঠানকে ১০ কোটি টাকা ও আর্থ টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেডকে ১২ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে পুনঃতদন্ত ও আপিল চেয়ে বিটিআরসির কাছে আবেদন করেছে আর্থ টেলিকমিউনিকেশন্স। লেভেল থ্রি-ও বিটিআরসির কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে। প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থও হয়েছে।

এ বিষয়ে আর্থ টেলিকমিউনিকেশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘যেসব অপরাধের কথা হচ্ছে, সুইচ ও রাউটার বসানোর জন্য এই জরিমানা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেহেতু বিটিআরসিকে অবহিত করতে হয়, সেটি করা হয়নি। সে কারণে বড়জোর সতর্ক করতে পারে। বিষয়টি বিটিআরসির নজরে এনে আমরা এরই মধ্যেই আপিল করেছি। বিটিআরসিতে আমরা বিস্তারিত ব্যখ্যা দিয়েছি। বিটিআরসির উচিত বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্ত করা। আমরা বিটিআরসির কাছে ন্যয্য বিচার চাই।’

তিনি বলেন, ‘বেনোপোলের ওখান থেকে আমরা সরাসরি কোনো কাস্টমার সার্ভিস দিইনি। ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেড এনটিটিএন-এ দু’টি সুইচ ও দু’টি রাউটার বসিয়েছি। যাতে সেখান থেকে আমরা এনটিটিএন’র মাধ্যমে যশোর, খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় আমাদের গ্রাহকদের কম ল্যাটেন্সি এবং কম ট্রান্সমিশন খরচে সংযোগ দিতে পারি। সেইসঙ্গে রিডান্ডেন্ট বা ড্রিস্ট্রিবিউটেড নেটওয়ার্কের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে পারি। তবে এটি বিটিআরসিকে অবহিত করতে হয়। আমরা সেই সময়ে বিটিআরসিকে অবহিত করতে পারিনি। যেখান থেকে সরাসরি অন ডিমান্ড সার্ভিস দিতে হয়, আমরা সেটিকে পপ বুঝি। কিন্তু বিটিআরসি বলেছে, বেনাপোলের এটিও পপ। যেহেতু বিটিআরসি বলেছে পপ; আমরা বলেছি, সেটি অবহিত করব। মাস দেড়েক পরে বিটিআরসিকে তা অবহিত করা হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বেনাপোল থেকে আগে সব ব্যান্ডউইথ আমরা ঢাকায় নিয়ে আসতাম। এতে ল্যাটেন্সি এবং ট্রান্সমিশন খরচ বেড়ে যেত। ২০২৩ সালে খাজা টাওয়ারে আগুন ধরে। ফলে সারাদেশে আমাদের ইন্টারনেট সেবায় বিপর্যয় ঘটে। যা পুনরুদ্ধার করতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়। পরবর্তী সময়ে বেনাপোল থেকে আমরা যশোর, খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকায় যতটুকু ব্যান্ডউইথ দরকার ততটুকুই আনি। এর সঙ্গে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির কোনো সম্পর্ক নেই।’

আর্থ টেলিকমিউনিকেশনের এমডি বলেন, ‘আমরা কোথাও ওভারহেড ক্যাবল টানিনি। এটি একটি অবাস্তব কাজ। বেনাপোল থেকে ৪৩ কিমি ক্যাবল নিয়ে আসা, এটি কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। কোনোভাবেই এটি বিটিআরসি প্রমাণ করতে পারবে না। আমরা বিষয়টির ব্যাপারে আমাদের আপত্তি জানিয়েছি। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ। এই ভিত্তিহীন অভিযোগের সঙ্গে রাজস্ব ফাঁকি কীভাবে সংশ্লিষ্ট হতে পারে!’ তিনি বলেন, ‘আমরা চুক্তি ছাড়া কোন ব্যান্ডইউথ আনিনি। আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সামিট, ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল, ম্যাংগো ইত্যাদি আইটিসি থেকে ব্যান্ডইউথ নিই। বিটিআরসিতে আমরা যে আইটিসি রিপোর্ট জমা দিই সেখানে কমবেশি দেখানোর সুযোগ নেই।’

জানতে চাইলে লেভেল থ্রি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ জুনায়েদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখানে জরিমানা কম-বেশির কিছু নেই। আমাদের বিরুদ্ধে যে চার থেকে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে, তার একটিও সত্য নয়। সেটি আমরা বারবার বিটিআরসিকে জানিয়েছি। আমরা হাইকোর্টেও গিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমি তো আইটিসি না, ক্রস বর্ডার কানেকশন তো আইটিসি করেছে। ব্যান্ডউইথ আনার ক্ষেত্রে উনারা (বিটিআরসি) বলছে অনুমতি নেই; কিন্তু আমাদের অনুমতি আছে, সব ডকুমেন্টও আমাদের কাছে আছে।

তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা, বিটিআরসি আমাদের কোনো শোকজ ছাড়াই জরিমানা করেছে। নিয়ম হচ্ছে, তিনবার শোকজ করবে। লিখিত কোনো চিঠি আমরা পাইনি। এত বড় একটি জরিমানা করেছে, অথচ কোনো কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়নি।’

লেভেল থ্রি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘গত ১০ বছরে আমরা সরকারের কোষাগারে প্রায় ৬৩০ কোটি টাকা দিয়েছি। এর মধ্যে রেভিনিউ শেয়ার, ভ্যাট-ট্যাক্স ও সাবমেরিনের বিল রয়েছে। গতবছর রেভিনিউ শেয়ার বাবদ বিটিআরসিকে দিয়েছি ২৫ কোটি টাকা। বিষয়টি নিয়ে বিটিআরসির উচিত ছিলো আমাদের সঙ্গে বসা। একটি অভিযোগ দিয়ে দিলেন। আমাদের ভাবমূর্তিও তো নষ্ট হয়। এটি তো হয়রানিও। আমরা কোর্টে সব ডকুমেন্ট দেওয়ার পরেই কোর্ট বিটিআরসিকে রুলস অব ডিরেক্টিভ দিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘উপয়ান্তর না দেখে আমাদের হাইকোর্টের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। হাইকোর্ট বিষয়টি পর্যালোচনা করে মতামত দিয়েছেন যে, এক্ষেত্রে টেলিকম আইনের নির্ধারিত ধারাগুলোতে প্রক্রিয়াগুলো সঠিকভাবে পালন না করায় অবজার্ভেশন দিয়ে বিটিআরসিকে ওই প্রক্রিয়াগুলো পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা কোর্টে সব ডকুমেন্ট এবং আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করার পরেই কোর্ট বিটিআরসিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। কোন ভিত্তিতে এই জরিমানা করা হয়েছে আদালত তা জানতে চেয়েছে। বিষয়টি এখন সম্পূর্ণভাবে হাইকোর্টের এখতিয়ার। বিটিআরসি এখন আমাদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে হলে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নিতে হবে। হাইকোর্ট সবকিছু বিবেচনা করে ফাইনাল ভার্ডিক্ট দেবে। তবে তাতে কিছু দিন সময় লাগবে। তবে আমরা শতভাগ বিশ্বাসী যে, সব প্রক্রিয়া শেষে রায় আমাদের পক্ষেই আসবে।’

কোম্পানির এক কর্মকর্তা জানান, বিটিআরসি শোকজ বা কারণ দর্শানোর নোটিশ না দিয়েই কেন জরিমানা করেছে- তা জানতে চেয়েছেন আদালত। আর আদালত লেভেল থ্রিকে বিটিআরসিতে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা (রিকনসিডারেশন) জন্য আবেদন করতে বলেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিটিআরসির এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনারা (আর্থ কমিউনিকেশন) ঈদের আগে আবেদন করেছেন। এখনো বিষয়টি নিয়ে কিছু হয়নি। আমাদের পক্ষ থেকে একটি রিপ্লাই যাবে, আমরা এখনো সেই রিপ্লাই দিইনি।’ তিনি বলেন, ‘ইনসপেকশন টিমের রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে এটি করা হয়েছে। কমিশন সেটি বিবেচনা করেই তাদের জরিমানা করেছে।’

জানতে চাইলে বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মো. এমদাদ উল বারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুটি কোম্পানিই আমাদের কাছে আপিল করেছে।’ তবে লেভেল থ্রি নামক আইআইজির কোর্টে যাওয়ার বিষয়টি এখনো অবগত নন বলে জানান বিটিআরসি চেয়ারম্যান।

আইটিসির চেয়ে আইআইজিকে বেশি জরিমানা করার কারণ জানতে চাইলে বিটিআরসির ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এটি কমিশন করেছে। অপরাধের ধরন শুধু চোরাই ব্যান্ডউইথ নয়, আরও কিছু ব্যত্যয় আছে। নন কমপ্লায়েন্স, পপ ডিক্লেয়ার করেনি, চুক্তি করেনি।’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপিল বিষয়ে আমরা একটি কোম্পানির চিঠি পেয়েছি। চিঠিতে তারা যেসব বিষয় দাবি করেছে তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।’

প্রসঙ্গত, আইটিসি অপারেটরগুলো সাবমেরিন ক্যাবলের বিকল্প হিসেবে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানি করে থাকে। সামিট কমিউনিকেশন, ফাইবার অ্যাট হোম গ্লোবাল লিমিটেড, ম্যাংগো টেলিসার্ভিস, ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স, বিডিলিংক কমিউনিকেশন এবং নভোকম লিমিটেড নামের এই ছয় প্রতিষ্ঠানের আইটিসি অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স রয়েছে। আইটিসি অপারেটরদের আমদানি করা ব্যান্ডউইথ ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক তথা এনটিটিএনের মাধ্যমে পৌঁছায় আইআইজি অপারেটরদের কাছে। তবে গত এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, কয়েকটি আইটিসি অপারেটর অনুমোদনহীনভাবে ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আনছে। আর সেই ব্যান্ডউইথ এনটিটিএন ছাড়াই সরাসরি যাচ্ছে কয়েকটি আইআইজি প্রতিষ্ঠানের কাছে।

আইটিসি প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিদর্শনে আইটিসি গাইডলাইন এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১-এর ব্যত্যয় পেয়েছে বলে দাবি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির। ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইনের ব্যত্যয়, বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া সরাসরি আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে ব্যান্ডউইথ ক্রয়, কমিশনে ১০০ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথের তথ্য প্রদান না করা এবং চুক্তি সম্পাদন ছাড়া ব্যান্ডউইথ ব্যবহার, বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রদান, ‘পপ’ (পয়েন্ট অব প্রেজেন্স) হিসেবে ঘোষণা ছাড়াই ব্যান্ডউইথ ব্যবহার, এনটিটিএনের বদলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঝুলন্ত অপটিক্যাল ফাইবার স্থাপন এবং চুক্তি ছাড়া ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করার অভিযোগে জরিমানাগুলো করা হয়েছে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/পিটিএম

আইআইজি ইন্টারনেট জরিমানা বিটিআরসি ব্যান্ডউইথ সিদ্ধান্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর